প্রত্ন-শিল্পকলা বেহাত আখ্যান
আজকের শিল্প সামগ্রী অনাগত কালে পূর্বজদের সাংস্কৃতিক চিহ্ন। অতীত শিল্প করণকৌশল, মুন্সিয়ানা, কলাদর্শ। একসময় হয়ে ওঠে প্রত্ন নিদর্শন। প্রাচীনত্বের বিচারে এমন শিল্পকৃতির বাজার দর, জাদুঘর সংগ্রহ তথা, বিরল দর্শনীয় বস্তুর তালিকায় জায়গা করে নেয়। দুনিয়ার ধনবান সংগ্রাহক থেকে শুরু করে দুর্দন্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি, সরকার, জাদুঘর, নিলাম হাউস সকলেই মুখিয়ে থাকে নিজ নিজ সংগ্রহের তালিকা সমৃদ্ধ করতে। এই নিয়ে প্রতিযোগিতার যেন শেষ নেই! যার জন্য অর্থের নিরীহ প্রতিযোগিতা কেবল নয়, নানা ছল-চাতুরী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জালিয়াতি, চুরি, পাচার, বেহাত, হাত বদল, খোয়া যাওয়া, লুঠ ইত্যাদি নানা প্রপঞ্চে এই প্রতিযোগিতা বিদ্যমান।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৬-খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে বেবিলনের সিপপুরে সামাথ নামক একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের নির্মাতার নাম জানার উদ্দেশ্যে সম্রাট নবনিডাস (Nabonidus) ধ্বংসস্তুপের মধ্যে খননকাজ পরিচালনা করেন। তার এই কীর্তির জন্য তাকে পৃথিবীর প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করা হয়। সম্রাটের কন্যা এন্নিগালডি নান্না (Ennigaldi Nanna) খননে প্রাপ্ত এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সংগৃহীত নিদর্শনাদি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন।
প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের সম্পত্তি লুটপাট একধরণের বৈধতা পেয়ে এসেছে। প্রত্ন নিদর্শন বা বলি শিল্প নিদর্শন আজকেও লুটের লক্ষবস্তু হিসাবে সমান আকর্ষণীয়। কবে থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তা ঠিক দিন ক্ষণ নির্দিষ্ট নয়। তথাপি ইরানের আক্কাদের রাজা `নারাম-সিন্`কেই প্রথম প্রত্নসম্পদ লুটের নিদর্শন বলে সাব্যস্ত করা হয়। যতদূর জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ সালে লুল্লুবি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ী `নারাম-সিন্` এর বিজয়ের স্মারকটি তার ১০০০ বছর পরে এলামীটরা যুদ্ধ লুট হিসাবে তা তখনকার ইরানের রাজধানী সুসায় স্থানান্তর করে। ১৮৯৮ সালে ফরাসি প্রত্নতত্ববিদ কর্তৃক খননে তা প্রাপ্ত, যা বর্তমানে প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়।
প্রত্নবস্তু একটি `জাতীয় ধনভাণ্ডার`। যাকে ঘিরে `জাতীয় ঐতিহ্য বনাম মানব ঐতিহ্য` বিতর্ক ও বিদ্যমান। আমাদের এই বাংলা থেকে লুট হওয়া সম্পদের অনেক বড় একটা অংশ গিয়েছিল লর্ড ক্লাইভের পকেটে। ক্লাইভ যখন ব্রিটেন ফেরত যান তখন তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল তৎকালীন বাজারমূল্যে প্রায় ২৩৪,০০০ ইউরো সমমানের। এর মাধ্যমে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। যার মধ্যে পলাশী পরবর্তী মুর্শিদাবাদের কোষাগার ও প্রাসাদ লুঠের সামগ্রীও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রেমব্রা ওল্ড মাস্টার পেইন্টারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে তাঁর একারই সর্বমোট ৩৩৭টি শিল্পকর্ম `আর্টলস` রেজিস্টারের ডাটাবেস তালিকাভুক্ত। এমন বহু বিখ্যাত শিল্পী ভাস্করদের শিল্পকর্ম তছরুপের যেমন অসংখ্য ঘটনা আছে তেমনি আছে তাঁদের `শিল্পকর্মের নকল` প্রবণতা। যার মূল লক্ষ্য ক্রেতা ঠকানো। আছে নকল প্রত্ন নিদর্শনও। এখানে তৎসংশ্লিষ্ট আধুনিক `প্রযুক্তি ও কারিগরি`কাজে লাগিয়ে উন্নত বিশ্বের জাদুঘর এর জালিয়াতিও প্রণিধানযোগ্য। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দুনিয়ার `জাতীয় ঐতিহ্য ধারক প্রত্নবস্তু` প্রদর্শনীর অজুহাতে পশ্চিমা দেশে নিয়ে এসে আসল এর প্রতিরূপ করে উৎস দেশে ফেরত পাঠাবার এমনকি হারিয়ে গেছে বলেও একধরণের জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়টি আর গোপন নয়।
সত্যজিৎ এর `কৈলাসে কেলেঙ্কারি` ও সিনেমায় পুরাকীর্তি
টু ক্যাচ এ থিফ, দ্য মিসিং রেমব্রা, রেফেলস, এমেচার ক্রাক্সম্যান ইত্যাদি ইউরো-আমেরিকান জনপ্রিয় আবেদনময় চলচ্চিত্র। অন্যদিকে ভারতে বাংলা চলচ্চিত্রে কেবলমাত্র প্রত্নতত্ব ইতিহাস বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তেমন উদাহরণ ও রয়েছে। যাদের মধ্যে সোনারকেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, বৈদুর্য রহস্য, কৈলাসে কেলেঙ্কারি, গোয়েন্দা গোকোল ও মিশর রহস্য উল্লেখযোগ্য।
সাল ১৯৪১। সত্যজিৎ রায় তখন তরুণ তুর্কি। সবে কুড়িতে পা। শান্তিনিকেতনে কলাভবনের ছাত্র। খুব সম্ভবত স্টাডি ট্যুরে বেড়াতে গেছিলেন মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে। অজন্তা ও ইলোরার গুহাদর্শনে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রকূট রাজবংশীয় রাজাদের আমলে গড়ে ওঠা সেই শতাব্দী প্রাচীন অভাবনীয় পুরাকীর্তি দেখে ভয়ানক মুগ্ধ হয়েছিলেন সত্যজিৎ। নতুন করে চিন্তাভাবনার রসদ খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব, কলা ও স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে। ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে সেই মুগ্ধতা পরে ছড়িয়ে পড়েছিল তার লেখাতেও। কিন্তু শুধু মুগ্ধতায় থেমে থাকেননি সত্যজিৎ। পাশাপাশি উঠিয়ে এনেছিলেন এইসব পুরাকীর্তি ঘিরে গড়ে ওঠা দুষ্প্রাপ্য ও বহুমূল্য মূর্তি চুরি, ভ্যান্ডালিজম, আন্তর্জাতিক র্যাকেট, শিক্ষিত অপরাধী, মানুষের লোভ লালসার ইতিহাস ও তার চেয়েও বেশি ভারতীয় ঐতিহ্যের গর্বের সম্পদ, প্রাচীন স্থাপত্যকলা নিয়ে দেশের একটি বড় অংশের দুর্ভাগ্যজনক উদাসীনতার কথাও।
এর প্রায় ৩২ বছর পর ১৯৭৩ সালে ফেলুদা সিরিজের অন্যতম 'কৈলাসে কেলেঙ্কারি' বইতে তার অজন্তা-ইলোরা ভ্রমণের তথ্য তুলে ধরেন সত্যজিৎ। একই সঙ্গে, সেই সময় গোয়েন্দা কাহিনীর মোড়কে, তুলে আনেন ভারতীয় স্থাপত্যকলা ধ্বংস ও চুরির কথাও। এই প্রাচীন সমস্যা যথেষ্টই নাড়া দিয়েছিল তাকে। প্রিয় চরিত্র ফেলুদার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন— সারা পৃথিবীতে হীরে জহরত মণিমুক্তো অনেক আছে, ভবিষ্যতে তা হয়তো আরও বাড়বে কিন্তু অজন্তা ইলোরা, খাজুরাহো বা ভুবনেশ্বরের রাজারানীর মন্দির একটি বই, দুটি নেই। এই সব স্থাপত্য-নজির ভারতীয় প্রাচীন কলা সংস্কৃতির বিস্ময়কর নিদর্শন। যারা এই সব মন্দিরের গা থেকে ভেঙে দেশের ঐতিহ্য চুরি করে বিদেশে মোটা দামে বেচে তারা 'ক্রিমিনাল'। তাই তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।
কৈলাস মন্দিরের গুহায় 'ভিলেন' চট্টরাজকে হারিয়ে রাধারানি মন্দিরের দূর্লভ সেই যক্ষীর মাথা ফেলুদা উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও ভারতীয় মন্দিরের গা থেকে মূর্তি চুরির ইতিহাস কিন্তু থেমে থাকেনি। বরং আজও তা অব্যাহত। সম্প্রতি কিছু কেন্দ্রীয় নথিতে পাওয়া গেছে তেমনই ইঙ্গিত৷
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার, পৌত্তলিকতা সমৃদ্ধ এই দেশে মূর্তি ভাঙা-গড়ার ইতিহাস আজকের নয়। গজনীর সুলতান মাহমুদ থেকে নাদির শাহের মতো বহির্বিশ্বের আক্রমণ যতবার ঘটেছে এই উপমহাদেশের বুকে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারতের প্রাচীন পুরাকীর্তিই। লুণ্ঠনের 'কালো` ঐতিহ্যে ঝাঁপিয়েছে ব্রিটিশরাও। হাতছাড়া হয়েছে ময়ূর সিংহাসন বা কোহিনূরের মতো মহামূল্যবান রত্নরাজি। ধ্বংস হয়েছে বহু মন্দির, দেবালয়, মূর্তি ও স্থাপত্যশৈলী। ২
জাতিসংঘ বলছে, প্রাচীন শিল্পকর্মের বেআইনি পাচার সন্ত্রাসবাদের জন্য বিপুল মুনাফার উৎস হিসেবে কাজ করছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সাংস্কৃতিক সম্পদ পাচার হয়েছে নানা দেশে। মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার সংঘাতের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাংস্কৃতিক সম্ভারের লুণ্ঠন, ধ্বংস সাধন ও বেআইনি লেনদেন বেড়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার মালি, মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ও ইরাকের সংঘাত-অস্থিরতায় সাংস্কৃতিক সম্পদ চুরি অনেক বেড়েছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দফতর, ইউএন অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) বলছে, পুরাকীর্তির বেআইনি চোরাচালানে বছরে প্রায় ৬৩০ কোটি ডলারের লেনদেন হয়।
আজকের দিনেও আন্তর্জাতিক `পাচার সিন্ডিকেট` এর সংগঠিত শিল্পসামগ্রীর অসৎ ব্যবসায়ীদের জালিয়াতির মাধ্যমে প্রত্নসামগ্রী লুটপাট, পাচার সমান তালেই চলছে।
যুদ্ধও শিল্পবস্তুর রমরমা বাজার তৈরি করে যুদ্ধকালীন অবশ্যম্ভাবী বিষয় লুটতরাজ। শিল্প লুটপাট সংশ্লিষ্ট পক্ষকে যুদ্ধের জন্য অর্থায়নে ভূমিকা রাখে। আইএসআইএস কর্তৃক লুটকৃত শিল্পসামগ্রী থেকে ঠিক কি পরিমান অর্থের যোগান পেয়েছে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে নির্ধারণ করা দুরহ বা অসম্ভব, কিন্তু রাশিয়া হিসেবে কষে দেখেছে যে, তাদের এই শিল্প লুটের অর্থ সংস্থানের পরিমান ১৫০-২০০ মিলিয়ন ডলার। যা আইএসআইএস অবৈধ প্রত্নদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় বাণিজ্যের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে। লুটতরাজকৃত শিল্প নিদর্শন সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের পুরস্কৃত করার জন্য ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
যুদ্ধকালীন ফ্রান্স থেকে শিল্প জার্মানীতে নিয়ে আসার এক প্রচেষ্টার দারুণ চিত্রায়ণ 'দি ট্রেন' চলচ্চিত্রটি। ছবির সংক্ষিপ্ত কাহিনী, জার্মানদের দখলে ফ্রান্সের প্যারিস শহর। সময় আগস্ট ১৯৪৪। প্যারিসে রয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি সমৃদ্ধ মিউজিয়াম। যাঁদের চিত্র রয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গঁগাঁ, ভ্যানগখ, রেনোয়া, ম্যনে, মিরো ও আরো অনেকে। একজন দখলদার জার্মান কমান্ডার ছবি পাগল কর্নেলের ইচ্ছে এসব অমূল্য চিত্রকর্ম জার্মানির বার্লিন শহরে নিয়ে যেতে হবে এবং তা সযত্নে, কোন রকম নষ্ট না করে। যুদ্ধের মধ্যে তার কাছে একটি উপায়ই আছে সেগুলি নেয়ার, তা হলো ট্রেনে করে ছবিগুলো জার্মানিতে পৌঁছে দেয়া। বহু যত্নে প্যাকিং করে ট্রেনে তোলা হলো ছবিগুলো। এদিকে যুদ্ধে পরাজিত মিউজিয়ামের পরিচালিকা ফরাসি মহিলার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভেবে পান না কীভাবে জার্মান কর্নেলকে নির্বৃত্ত করবেন ফরাসিদের এসব অমূল্য সংগ্রহ, দেশের ঐতিহ্য পাচার করা থেকে। অনেক অনুনয়-অনুরোধ ব্যর্থ হলো। জার্মান কমান্ডারের বক্তব্য একটাই। এসব সাধারণ ফরাসিরা কি বুঝবে চিত্রকর্মের! যারা সত্যিকারের সমঝদার তাদের কাছেই এগুলো থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মিউজিয়ামের পরিচালিকা ফরাসি গুপ্ত বাহিনীর সাহায্য নিলেন। তারা ট্রেন চালকসহ ট্রেনের অন্যান্য কর্মচারী এবং বিভিন্ন রেল স্টেশনের কর্মচারীদের জানিয়ে দিল ট্রেনটিকে কিছুতেই ফরাসির বাইরে যেতে যেন দেয়া না হয়। ট্রেন চালকদের মধ্যে একজনকে নেতা হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলো। তার নাম লাবিশ (Labiche) । নেতা তার সঙ্গীদের নিয়ে কাজে নামার আগে জানালো যদি শেষ পর্যন্ত তারা জার্মান কর্নেলকে রুখতে না পারে তবে ট্রেনটি উড়িয়ে দিতে পারবে। তাদের বলা হলো তা করা যাবে না। কারণ এ ট্রেনে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব ছবি, এগুলো ফরাসি দেশের অংশ, এগুলো ফ্রান্সের স্বপ্ন, ফরাসিবাসীর গর্ব, ফ্রান্সের গৌরব (Art are importance, Part of France, Vision of France, Our Pride, Glory of France) সরলমনা এক গাড়ী চালকের জিজ্ঞাসা এগুলোর কি কোন কপি নেই? অক্ষতভাবে ট্রেনটিকে ফ্রান্সেই রেখে দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু হলো। আর শুরুতেই একজন পাপা বুল (Papa Boule) নামের মোটাসোটা দক্ষ ট্রেন চালক যার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এ ট্রেনে আছে 'Glory of France' (ফ্রান্সের গৌরব) - সে ইঞ্জিন অকেজো করে ট্রেনটা বন্ধ রাখার বোকামি প্রচেষ্টা নিল। ধরা পড়ে তাকে জীবন দিতে হলো। ট্রেন চালানোর দায়িত্ব সরাসরি লাবিশকে দেওয়া হলো। পাহারায় রাখা হলো জার্মান সৈন্য। তারপর কাহিনী এগিয়ে গেছে - ফিসপ্লেট খুলে ট্রেন বন্ধ রাখা হয়েছে, আবার তা ঠিক করে ট্রেন চালানো হয়েছে - যেখানেই বাধা এসেছে সেখানেই বাধাদানকারীদের হত-আহত করেছে জার্মান সৈন্যরা। তারপরও অত্যন্ত চকমপ্রদভাবে ট্রেনচালক ও বিভিন্ন স্টেশনের কর্মচারীরা ট্রেনটি ফ্রান্সেই রেখে দেয়। একের পর এক স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে (সাইন বোর্ড বদলিয়ে) ভুল রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ট্রেন আবার যেখানে থেকে রওনা হয়েছিল সেখানে ফেরত আসে। ইতোমধ্যে জার্মানরা হেরে যাওয়ায় নতুন করে ঐ কর্নেল আর চিত্রকর্ম নিয়ে যাওয়ার দুষ্কর্মটি করতে পারে না। যা পারে তা হল ট্রেনের ইঞ্জিনের দু`পাশে জিম্মি হিসেবে রাখা নিরীহ ও সাধারণ নিরাপরাধ বেশ কিছু ফরাসিকে গুলি করে মেরে ফেলতে। তারপর সেই কর্নেল ও লাবিশ পরস্পরের মুখোমুখি হয়। লাবিশ ক্রোধেক্ষোভে কর্নেলের দিকে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে।
দীর্ঘ এ গল্পটার শানে নযুল -'ফরাসির গৌরব`, 'ফরাসিদের স্বপ্ন`, 'ফরাসির ঐতিহ্য` রক্ষা করতে পেরেছিল গুটি কয়েক মানুষ যাঁরা কোন দেশ বাঁচাতে নয়, কোন অর্থ অর্জনকারী উন্নয়নমূলক শিল্প-সম্পদ বাঁচানোর জন্য নয়, এমনকি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নয়, কেবল 'ফরাসির গৌরব` (glory of France) কিছু চিত্রকর্ম যা তারা নিজেরা কখনো চোখে দেখেনি জীবন দিয়ে তা রক্ষা করেছে তা দেখানো।
ফরাসি পরিচালক দেশপ্রেমের মহৎ উদাহরণ হিসেবে সিনেমাটি তৈরি করেছেন ঠিকই। এই ফরাসীরাই প্রত্ন শিল্প সামগ্রী দখল করে এনে দেশের শত শত জাদুঘর সংগ্রহশালায় জমা করেছে।
আন্দ্রে মারলো`র `সামান্য চুরি` কম্বোডিয়ায় ফরাসি উপনিবেশ
এবার সচিত্রনাট্য নয়, চলুন আরেকটি বাস্তব ঘটনার বৃত্তান্ত জেনে আসা যাক। ভারতবর্ষে যখন ইংরেজ উপনিবেশ বিরোধী স্বরাজ, ইয়ং বেঙ্গল নামে নানা তরজা চলছে তখন অদূরে ফরাসি উপনিবেশ কম্বোডিয়ায় কি হচ্ছিলো?
প্রায় ১০০ বছর আগে কম্বোডিয়া তখন ফরাসি উপনিবেশ। ১৯২১ সালে আন্দ্রে মারলো ও তাঁর স্ত্রী ক্লারা কম্বোডিয়ায় পৌঁছেছিলেন। একটি মন্দির থেকে প্রায় একটন পাথর খোদাই শিল্পকর্ম ও অলংকার সরিয়ে ফেলার অপরাধে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। বিচারের মুখোমুখি করে ১৯২৪ সালের ১৬ জুলাই মারলোকে ৩ বছরের জেল ও ৫ বছরের ভ্রমন নিষেধাজ্ঞার রায় দিয়েছিল আদালত। যদিও মারলো প্যারিসে আবেদন করে কোন রকম কারাভোগ না করেই মুক্তি পান।
ফরাসি উপনিবেশিক রাজ্ কর্মচারীদের দিক থেকে তাদের শিল্প সংগ্রহশালা ও জাদুঘরে বিক্রয় কল্পে এই প্রত্ন সামগ্রী পাচার উদ্যোগ ঘটনাটিকে `le petit voleur` অর্থাৎ `ছোট চোর` বা `সামান্য চুরি` বলে অবজ্ঞার সাথে উল্লেখ করেছিল।
আন্দ্রে মারলো ফ্রান্সের পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক, শিল্প তাত্বিক, প্রেসিডেন্ট চার্লস দি গ্যল প্রশাসনের ১০ বছর উল্লেখযোগ্য মন্ত্রী ছিলেন। মার্লোর এহেন কান্ডে সম্পৃক্ততা নিয়ে এখনো চাপান উতোর অব্যাহত। মারলো `বড় নায়ক নাকি ছোট চোর`? হ্যাঁ, খেমার টাইমস এমনি সংবাদ শিরোনাম করেছিল ২০০০ সালেও। উল্লেখ্য কম্বোডিয়ান উপনিবেশ বিরোধীদের পক্ষে মারলোর অবস্থানকে তখনকার কর্তৃপক্ষ ভালো নজরে না দেখার ফলে এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন বলেও ভিন্নমত আছে। অথচ তিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই দাবিতে অনড় ছিলেন যে, `পন্তি বান্তেসেই`এর মূর্তিগুলির তিনিই আসল মালিক!!!
ব্রিটিশের যুদ্ধের লুন্ঠন, দখল টিপুর হারের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু স্মৃতিচিহ্ন
ব্রিটেনে অথবা ভারতে থাকা ব্রিটিশেরা যুদ্ধের লুট, দখল আর হত্যার মধ্যেই অর্জিত নানান ধরণের সব বস্তুকে গুরুত্বপুর্ণ ভাবতে শিখল। উনবিংশ শতাব্দে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মদতে লুঠের মাধ্যমেই প্রচুর মূল্যবান এবং জনপ্রিয় নানান কারিগরি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র লন্ডনে গিয়েছিল। ১৭৯৯ (বইতে ভুল ছাপা হয়েছে ১৮৯৯ সাল) সালে টিপু সুলতানের হারের পর শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতনের উল্লাসে টিপুর সঙ্গের জুড়ে থাকা বহু দ্রব্য লুঠ হয়ে নিলামের বাজারে চলে এসেছিল। এই লুটে ছিল টিপুর বাঘ, তার মুকুট, দেহবর্ম, সিংহাসন থেকে লুঠ হওয়া বাঘের মাথা, একটি রয়্যাল কার্পেট। এগুলি কোর্ট অব ডিরেক্টর্স এবং রাজপরিবারের সদস্যদের উপঢৌকন দেওয়া হয়। এবং কয়েক বছরের মধ্যেই সেগুলি লিডেনহল স্ট্রিটের মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্যে হাজির হয়।
১৮২০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে শ্রীরঙ্গপত্তনমের বিজয় দেখানো চিত্রকলার চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে এবং তার সঙ্গে লাগোয়া ছোট জাদুঘরটিতে। জেনারেল ডেভিড বার্ডের টিপুর মৃতদেহ সনাক্তকরণ, টিপুর মৃত্যু এবং টিপুর দুই ছেলের আত্মসমর্পণ বর্ণনা করে আঁকা ছবি বিপুল্ভাবে লন্ডনের অভিজাতদের বাড়িতে চাহিদাবন্ত হয়ে উঠল। টিপুর হার আর চিরাচরিত শত্রু এবং শয়তান বাঘ টিপুর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির জিত বর্ণনা করে হাজারো নাটক, ব্যঙ্গ, গীতিকবিতা, ছড়া ইত্যাদি ছেয়ে গেল লন্ডনে।
১৮২০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত যে সব জনপ্রিয় লন্ডন ঘোরার নির্দেশনামা লেখা বইতে ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস এবং তার সংলগ্ন মিউজিয়াম সম্বন্ধে কিছুটা হলেও আলোচনা করেছে। সপ্তাহে মাত্র কয়েকদিন খোলা থাকা মিউজিয়ামে ঢুকতে হত গাঁটের কড়ি খরচ করে। দারোয়ানকে কিছু উপরি দিলে আরও বেশি কিছু দেখার ব্যবস্থা হয়ে যেত। যদিও ফারগুসন এই মিউজিয়ামে অমরাবতী স্থাপত্য দেখেছিলেন বলে দাবি করছেন, কিন্তু সে সময়ের নথি বলছে এই মিউজিয়ামে এধরণের কোন স্থাপত্য ছিল না, শুধু টিপুর হারের আর শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতনে ব্রিটিশ বিজয়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু স্মৃতিচিহ্ন।
টিপু সাবের সোনায় তৈরি বাঘের মাথার আকারে চারপায়া সিংহাসন, চোখ আর দাঁতগুলি ক্রিস্টালের। অসাধারণ সিংহাসন, যা টিপু মহীশূরের সিংহাসনে বসেই তৈরি করান। এটি নিরেট সোনার তৈরি, বসার আসনটা মাটির থেকে তিন ফুট উঁচুতে। বিশাল বিশাল সৌন্দর্যের আর আকারের ক্রিস্টাল, মণিমুক্তো খচিত সোনার স্তম্ভের মাথায় একটা চাঁদোয়ার মত করা। বিজিতরা এটি খণ্ড খন্ড করে কেটে উপহার হিসেবে সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছিল
একটি গানগাওয়া বাঘ, টিপুর প্রাসাদ থেকে পাওয়া। একটা এক ধরণের হ্যান্ড অর্গান, বাঘের আকারে তৈরি করা। বাঘের তলায় একজন মানুষ শুয়ে রয়েছে, বাঘ গর্জন করছে আর মানুষটার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। টিপু সাহেবের অস্ত্রশস্ত্র। সেলাইকরা সুতি আর সবুজ রেশমে আবৃত মাথা আর গায়ের বর্মের সঙ্গে, যে বর্ম যে কোন আঘাত সহ্য করতে সক্ষম।৬
সবকিছুই লুট করা হয়নি…
মোগল সভ্যতার পতন, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থান এবং একটি প্রকৃত রেনেসাঁ আরম্ভে যদুনাথ সরকার উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। প্রথম থেকেই বাংলার বুদ্ধিজীবীরা, রামমোহন থেকে শুরু করে প্রায় সবাই সমভাবাবেগ প্রকাশ করেন। যা হোক সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যদুনাথ রেনেসাঁর শুরুর সময় (১৭৫৭-১৭৭৬) হিসেবে অন্য সবার চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন।
দিউয়ানি লাভের তিন বছরের মধ্যে কোম্পনি ভূমি রাজস্ব প্রায় ৭০ শতাংশ বর্ধিত করে এবং ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের সময়েও কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি, যা জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের প্রাণ কেড়ে নেয়।৮
'বিশ্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণ` 'ঔপনিবেশিক দৃষ্টি`র খোঁড়া যুক্তি 'ও বৈশ্বিক জাদুঘর`
জাতীয়তাবাদী আদর্শ অন্যতম প্রধান প্রণোদনা হতে পারে সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনীয় অনুঘটক হিসাবে। ভারতবর্ষের এক সময়ের প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী হ্যাভেল, আনন্দ কুমারস্বামী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররা `মনে করতেন জাতীয় সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের` বিস্তৃত আন্দোলনের অংশ হিসাবে ভারতীয় শিল্পকে প্রচার করার জন্য লন্ডনে `ইন্ডিয়া সোসাইটি` প্রতিষ্ঠা। তবে ব্রিটিশ জাতীয় জাদুঘরগুলি মনে করেছিল যে `সাম্রাজ্যের জাতীয় পরিচয়` তৈরী করার লক্ষ অর্জনে কাজ করেছে। লক্ষ্যণীয়, মহারাজ রণজিৎ সঘের সোনার সিংহাসনটি লন্ডনে নিয়ে আসা হয় ১৮৪৯ সালে, দ্বিতীয় `আংলো শিখ` যুদ্ধের পর ট্রফি হিসাবে! এই নিদর্শন প্রত্যাবর্তনের দাবি যার পর নাই ইংরেজ সরকার নাকচ করে আসছে!
সারা দুনিয়া থেকে 'সংগ্রহ করা` শিল্প সম্ভারে পূর্ণ পাশ্চাত্যের প্রায় সব বিখ্যাত জাদুঘর। ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার, বিচিত্র সংস্কৃতির প্রত্ন ও শিল্প নিদর্শনের জন্য 'বৈশ্বিক জাদুঘর` বলা হয়। এই তকমার মধ্য দিয়ে 'বিশ্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণে' সংশ্লিষ্ট পক্ষের ইতিবাচক ভূমিকা রাখারও উচ্চ অনুচ্চ দাবি সম্পর্কে বিশ্ব কম বেশি ওয়াকিবহাল। তবে নানা দেশ থেকে লুঠ করা সম্পদ ফেরত না দিয়ে, দুনিয়া জোড়া শিল্পনিদর্শন পাচারের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ না দিয়ে, কেন পাশ্চাত্যের প্রদর্শণ ও সংগ্রহশালাগুলো আকছার শিল্প ও প্রত্ন নিদর্শন কেনা বেচা এবং প্রদর্শন কার্য্য চালিয়ে যাচ্ছে? এমনতরো অবস্থানকে কুক্ষিগত বা একচেটিয়া রেখে কি 'ঔপনিবেশিক দৃষ্টি`র খোঁড়া যুক্তি দিয়ে 'বিশ্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণ` কামিয়াব করা আদৌ সম্ভব?
প্রতিনিয়তই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসভূমিতে প্রত্ন শিল্প নিদর্শন 'ফেরত পাঠানোর` ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে। ইতালি থেকে একসময় লুট হয়ে যাওয়া ২৫টি শিল্পকর্ম আমেরিকার জাদুঘর থেকে সম্প্রতি ফেরত পেয়েছে ইতালি। তার আগে ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অব আর্ট কম্বোডিয়াকে ফেরত দিয়েছে হিন্দু দেবতা হনুমানের দশম শতাব্দীর একটা মূর্তি। ১৯৬০ এর দশকে কম্বোডিয়া প্রদেশ থেকে লুটের পর নানা পাচারকারীর হাত ঘুরে ১৯৮২ সালে হনুমান মূর্তিটি কিনেছিল ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম। এমন পরিস্থিতিতে অনেক জাদুঘরের প্রধান এবং শিল্প-সংগ্রাহকেরাই এখন চিন্তিত। এই চিন্তা কেবল আর্থিক ক্ষতি বা ব্যবসায় মন্দার জন্য যেমন, তেমনি শিল্প-পাচারের নানা কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশে দেশে সংবাদপত্রে বড় বড় শিরোনাম আর বিভিন্ন দেশে শিল্প ও প্রত্নসম্পদ ফেরত পাঠানোর দাবিতে পশ্চিমের জাদুঘরগুলো চাপের মুখে পড়েছে। সারা দুনিয়ার ইতিহাস ও শিল্প-সংস্কৃতিকে উপস্থাপনের দাবিদার হয়ে নিজেদের 'বৈশ্বিক জাদুঘর' অভিধা বজায় রাখা নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়েছে তাঁরা। বিভিন্ন দেশ নিজেদের প্রত্ন ও শিল্পসম্পদ ফেরত আনার দাবি তুলছে, এ পরিস্থিতিতে নিজেদের তথাকথিত `বৈশ্বিক জাদুঘর` এর রক্ষাকর্তা বলে ভাবেন এমন হর্তাকর্তারা মনে করতে শুরু করেছেন যে, হীন জাতীয়তাবাদী স্বার্থেই শিল্পকর্ম ফেরত চেয়ে বিভিন্ন সরকার ও সংগঠন তাঁদের এত দিনের সযত্নে লালিত বহুজাতিক ও বৈচিত্র্যময় সংগ্রহশালার ক্ষতি করতে চাইছে। বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাধর এক্সপার্টরা পাশ্চাত্যের 'বৈশ্বিক` জাদুঘরগুলো সারা দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মানুষের কাছ থেকে আরও গভীর একটা চ্যালেঞ্জের মুখে, তথা সংকটে পড়তে যাচ্ছে।
পশ্চিমা কূটনীতিক ও পেশাজীবীদের প্রত্নপাচার
১৮, ১৯ শতকে অনেক কূটনীতিক ছিলেন (এমনকি এখনো আছেন) যারা নিজেকে শিল্পানুরাগী, সংগ্রাহক, প্রত্নত্ববিদ বা নিছক চোরাচালানকারী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।
বৈরুতের ফরাসী কনস্যুলেটের চ্যান্সেলর (১৮৭৯-৮২), আইমি পেরেটিয় এবং তার সহকর্মী, সাইদায় ফরাসি সহ-উপদেষ্টা, আলফোনস দুরিখেলো, প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক লুই ডি ক্লার্কের কাছে সিরিয়ার পুরাকীর্তির প্রধান সরবরাহকারী ছিলেন। (১৮৩৬-১৯০১) যার সংগ্রহটি ল্যুভর যাদুঘরে তাঁর বংশধরদের দ্বারা ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে দখল করা হয়েছিল (২৪৭ টিরও বেশি গ্রীক, এট্রস্কান এবং রোমান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে অনুদান দেওয়া হয়েছিল)।
নেপলসের দরবারের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার উইলিয়াম হ্যামিল্টনের সংগ্রহগুলি সাতত্রিশ বছর যাবত ব্রিটিশ যাদুঘরে রয়েছে, যা মিশরের কনসাল জেনারেল হেনরি সল্টের কাছ থেকে পেয়েছিল, থিবসের দ্বিতীয় র্যামেসের মূর্তি। ১৮০১ সালে ক্রিষ্টি হ্যামিল্টন ক্রয় করে দেবী আইসিসের একটি স্থায়ী রোমান মূর্তি যা আবার ২০১১ সালে ৯৬২,৫০০৩৪ ডলারে বিক্রি করেছিল।
১০৭০ সালের ১৬ অক্টবর লন্ডনের অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে দুই শতাধিক পুরাতত্ব বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গেছে। বিদেশী নাগরিকদের অন্যন্য পেশার ছদ্মাবরণে তাদের সংস্কৃতিবান আচরণের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রত্ন পাচার কার্যক্রম চলেছে। তার মধ্যে একজন মার্কিন নাগরিক ব্যাপক আলোচিত। ডাঃ ডেভিড নলীন আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক হিসাবে ১৯৬৭-৭০এবং ১৯৭২-৭৭ সাল নাগাদ ঢাকার মহাখালী কলেরা গবেষণা হাসপাতালে কাজ করেন। তাঁর পাচারকৃত প্রত্নসামগ্রী বিশ্বের নানা দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে বিক্রয় করেছেন।
তাঁর প্রত্ন পাচার সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন মোহাম্মদ শাহজাহান (বিচিত্রা, নভেম্বর ১৯৭৭) ও প্রখ্যাত শিল্প ইতিহাসবিদ ড: পারভীন হাসান এর David Nalin: friend or smuggler of antiquities? লেখাটি প্রণিধানযোগ্য।
একদা অটোমান কোর্টের দূত ছিলেন লর্ড এলগিন, যিনি পার্থেনন এর প্রত্নবস্তু লুঠের জন্য দায়ী। লর্ড বায়রন ১৮১১ সালে এই লুন্ঠনের নিন্দা করে `মিনার্ভার অভিশাপ` কবিতায় লিখেছিলেন-
``Some calm spectator, as he takes his view,
In silent indignation mixed with grief,
Admires the plunder, but abhors the thief``
পাশ্চাত্যের `সার্বজনীন` যাদুঘরগুলি কিভাবে অবৈধ শিল্পবস্তু বাণিজ্যের অংশ হিসাবে উপনিবেশ বিরোধী আখ্যানকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে নিদর্শনগুলো সংগ্রহ ও প্রদর্শন করতে পারে তা নিয়ে একের পর এক পরিকল্পনার কমতি নেই।
ফ্রান্সের বর্তমান রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাখো আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নেয়া প্রত্ন সামগ্রী যখন ফেরত দেওয়ার কথা বলেছেন, তখন তাকে `একটি সৎ প্রত্যার্পণ` বলা হচ্ছে। আবার এমন প্রশ্নও আসছে যে এই ফেরত দেয়ার দাবিটি সংশ্লিষ্ট দেশগুলো করছে কী না? ইতিহাসের `উপনিবেশিক সাংস্কৃতিক লুঠ`কে `প্রত্নগণহত্যা` বলেও চিহ্নিত করতে চাইছেন অনেকেই। অমূল্য সাংস্কৃতিক প্রত্নবস্তুর বেহাত রোধ কল্পে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন উপনিবেশিক মানসিকতার পরিবর্তন।
প্রত্নবস্তুর উৎসদেশ তাদের জাতীয় প্রত্ননিদর্শন প্ৰত্যাবর্তনের দাবি করার পরও নামি সব নিলাম প্রতিষ্ঠানের উচ্চ দর প্রতিযোগিতা থেকে যারা আজও সেসব সংগ্রহ করে তারা সবাই মূলত পশ্চিমা সমাজের প্রতিষ্ঠান ও মান্যজন! এই সংগ্রহকে কী, লুঠ হওয়া অন্য দেশের প্রত্নবস্তু ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার বিকৃত সুখ বলা যায়?
- ১. কার্ল মার্কস, ২৪ জুন, ১৮৫৩
- ২. মূর্তি উধাও রহস্য: বর্তমান সময় ও প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলা চুরির আখ্যান, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, ডিসেম্বর ১, ২০১৮, চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম
- ৩. মহাদেব সাহা
- ৪. প্রত্নসম্পদ চুরি: ঐতিহ্যের বিনাশ ও সভ্যতার মৃত্যু,কাজী মোহাম্মদ শীশ, বঙ্গরাষ্ট্র মে ১৭ ২০০৯
- ৫. সৈয়দ নিজার, রাষ্ট্রচিন্তা
- ৬. ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক - সাম্রাজ্যের মন ও মান- বারনার্ড কোহন, অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ
- ৭. দ্য গার্ডিয়ান, যুক্তরাজ্য, ২০১৮
- ৮. পলাশীর যুদ্ধ ও সম্পদ পাচারের সূত্রপাত, এম মোফাখ্খারুল ইসলাম, অনুবাদ: রেহানা পারভীন
- ৯. কনিষ্ক থারুর, দ্য গার্ডিয়ান, যুক্তরাজ্য