লতা মঙ্গেশকর ৯১
আজ সকালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সম্প্রতি অবস্থার উন্নতিও হচ্ছিল। কিন্তু গতকাল শনিবার আচমকা তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। রাখা হয় ভেন্টিলেশন সাপোর্টে। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি ৯২ বছর বয়সী লতাকে।
২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শিল্পী পালন করেন তার ৯১তম জন্মদিন। সে বছর টিবিএস বাংলা অনলাইনে প্রকাশিত লতা মঙ্গেশকরের সাক্ষাতকারের এই অনুবাদটি আজ আবার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
গাইতে রাজি কিন্তু কথা বলতে নারাজ সবচেয়ে কম সাক্ষাৎকার দেওয়া খ্যাতিমানদের অন্যতম লতা মঙ্গেশকরকে কথা বলাতে রাজি করান সুভাষ ঝা। তিনি তাকে জানালেন, নিজের গান শোনেন না। এবং তার এ কথাটাই হলো অনেক কাগজের শিরোনাম। সাধারণভাবে এটাই সঠিক কথা, এমনই হবার কথা। নদী তো নিজের জল পান করে না- লতা মঙ্গেশকর নিজের গান শোনেন না। কিন্তু লতা কেন শোনেন না তার কারণটাও একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, যদি শুনতাম শতশত ভুল ধরা পড়ত! ...আমি সেই আমলেও তাই করেছি, যখন রেকর্ডিং শেষ, সেই গান নিয়ে আমার কাজও শেষ।'
আপনি যখন আপনার বিষ্ময়কর জীবনের দিকে ফিরে তাকান, কেমন বোধ করেন?
লতা : আমি বিস্মিত হই যে মানুষ আমাকে এতো বছর সহ্য করেছে। ৭৫ বছর ধরে তারা আমাকে সহ্য করে আসছে। তাদের আনুগত্য ও ভালোবাসা ছাড়া আমি কিছুই নই। সাফল্যকে কখনো আমি আমার মাথায় ঢুকতে দিইনি। কেবল অহংকারের জন্য আমি বহু শিল্পীর পতন ঘটতে দেখেছি। আমি নিজেকে বিনীত এবং মাটিতে নামিয়ে রাখতে চেষ্টা করা অব্যাহত রেখেছি। ঈশ্বর আমার প্রতি সদয় ছিলেন। আমার শ্রোতারা এমন কি আমার অপরিণত গানগুলোকে কবুল করে নিয়েছে। আমার বাবা-মায়ের আশীর্বাদ এবং আমার জন্য শ্রোতাদের ভালোবাসা আমাকে সবসময় চলমান রেখেছে।
আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি, আগে কখনো ছিল না, ভবিষ্যতেও কখনো আর একটা লতা মঙ্গেশকর জন্মগ্রহণ করবে না।
লতা : আমাকে দ্বিমত করতেই হবে। আমার আগে এবং পরে অনেক মেধাবী শিল্পী এসেছেন।
আপনার তুলনায়?
লতা : হ্যা, কেন নয়? আমার আগে নূরজাহান, শামসাদ বেগম, গীতা দত্ত (তিনি শ্রদ্ধাভরে সবার নামের সাথে জি যোগ করেছেন নূরজাহানজি, শামসাদজি, গীতাজি), আমার পরে আমার বোন আশা সবাই অত্যন্ত মেধাবী। এখনকার শিল্পীদের মধ্যে অলকা ইয়াগনিক, শ্রেয়া ঘোষাল এবং সুনিধি চৌহান।
জয়া বচ্চনের হয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, তিনি আপনাকে আইডল মনে করেন। প্রশ্নটি হচ্ছে, পর্দার নায়িকাদের মধ্যে কে আপনার সুরের প্রতি সর্বোচ্চ সুবিচার করেছেন বলে আপনি মনে করেন?
লতা : এটা কঠিন প্রশ্ন। প্রত্যেক নায়িকা মধুবালা ও মীনাকুমারী থেকে শ্রীদেবী ও মাধুরী দীক্ষিত সবাই আমার গানের সাথে বিশেষ কিছু যোগ করেছেন। তবে যদি আমাকে একজন নায়িকার কথাই বলতে হয়, তা হলে তিনি নতুন। তিনি নিজেও সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। তিনি যখন পর্দায় আমার গানটির সাথে ঠোঁট মেলাতেন, তিনি গাইতেনও। তিনি যেমন করে আমার গান গেয়েছেন তা উদাহরণ হয়ে আছে। জয়া বচ্চনজিও আমার প্রিয়দের একজন। আমি মনে করি তিনি যেভাবে আমার গাওয়া বহেন মে চলে আশ (অনামিকা)র সাথে অভিনয় করেছেন তাতে গানটির জনপ্রিয়তায় আরো যোগ হয়েছে।
আপনার প্রিয় নায়িকা কে?
লতা : হেমা মালিনী সব সময়ই আমার প্রিয়
আমি নার্গিস ও মীনা কুমারীর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। মীনাজি আর আমি অবিরাম কথা বলে যেতাম, তা কখনো যেন শেষ হবার নয়। আমার দীর্ঘ লম্বা চুল তিনি পছন্দ করতেন, তখন পেছন মেঝে স্পর্শ করত। আমি পূজা ভাটকেও অনেক পছন্দ করতাম। তিনি কি এখনও অভিনয় করেন?
আজকাল কি আপনি বাড়িতে সিনেমা দেখেন?
লতা : আমার অসুস্থতার পর ডাক্তার আমার কাজকর্ম ভীষণভাবে ছেঁটে দিয়েছেন, তার মধ্যে সিনেমা দেখাও পরে গেছে। আজকাল আমি আমি সিআইডি আর আদালত ছাড়া টেলিভিশনে অন্য কিছু দেখিনা। দুটোই অনেক বছর ধরে আমার প্রিয়।
আপনি কি নিজের গান শোনেন?
লতা : কখনো না। যদি শুনতাম আমার গান গাওয়াতে শত ভুল ধরা পড়ত। এমনকি সেকালে যখন একটি গানের রেকর্ডিং শেষ হতো, এর সাথে আমারও পাট চুকতো।
কোন কোন গান ক্যারিয়ার তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে?
লতা : ১৯৪৯ সালের মহল চলচ্চিত্রে আয়েগা আনেওয়ালা আমার ক্যারিয়ারে একটি টার্নিং পয়েন্ট। তারপর বলব মুঘল-ই-আজম ছবির 'প্যায়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া' গানটির কথা। যখন সিনেমা চলত তখন দর্শক সিনেমার পর্দার উপর পয়সা ছুঁড়ে মারত। আমি আমার মীরার ভজনের অ্যালবামটা খুব পছন্দ করি। চলে ওহে দেশ ছবির জন্য আমার ভাই হৃদয় নাথ (মঙ্গেশকর) সুর রচনা করেছে। জগজিৎ সিং-এর সাথে যে অ্যালবামটা করেছি 'সাজদা' এটাও আমার প্রিয়।
আপনার গাওয়া গানের সুরকারদের মধ্যে সবচেয়ে কড়া কে ছিলেন?
লতা : সাজ্জাদ হোসেন। তার সুরে গান গাইবার সময় আমি ঠিক হলো কিনা এ নিয়ে সন্ধিহান থাকতাম তিনি যেভাবে চাচ্ছেন সেভাবে গাইতে পারছি তো। কোনো কোনো সুরকারের সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগের কারণে নির্ভয়ে গাইতে পারতাম, যেমন মদন মোহন ভাইয়া। এমন নয় যে সাজ্জাদ সাহেব আমাকে বকাঝকা করতেন, তিনি এমন সব জটিল সুর তৈরি করে আমাকে দিয়ে গাওয়াতেন যে আমাকে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হতো।
আর কোন সুরকার আপনার মেধাকে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছেন?
লতা : সলিল চৌধুরী। তার সাথে আমার দারুণ সম্পর্ক ছিল। তিনি বুঝতে পারতেন কোন সৃষ্টি আমার গলায় সবচেয়ে যুৎসই হবে। তার সুরে গান গাইতে আমি ভয় পেতাম। তার চেয়ে বরং তার গানগুলো গাইতে আমার বেশি ভালো লাগত। আমি তার সুর পছন্দ করতাম। তার মতো সুরকারের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তার সুর এবং গানে উৎসের কথা ভাবুন। তিনি সাধারণত বাংলায় লিখতেন। তার বাংলা কবিতাগুলো অসাধারণ, উত্তর-পূর্ব ভারতীয় লোক সঙ্গীতে উপর ছিল তার অসাধারণ দখল। কমিউনিস্ট হিসেবে তিনি ছিলেন ঈশ্বরের ব্যাপারে সন্ধিগ্ধ। কাজেই ঈশ্বর নিয়ে তার সাথে আমার অনেক দ্বিমত হতো। মদন মোহনের ছিল একবারে অনবদ্য একটি শৈলী। শঙ্কের জয় কিশান যুগলের জয় কিশান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। অত্যন্ত সৃজনশীল। শঙ্করজির গান ছিল খুবই উপভোগ্য। তারা যখনই অনুভব করতেন পাশ্চাত্যের গান কাজে লাগাতেন। তবে পাশ্চাত্যের সুরে সবচেয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন সলিলদা। তিনি পশ্চিমের সিম্ফনি শুনতেন এবং নিজের গানে এর সংযোজন ঘটাতেন।
ও পি নায়ার একবার বলেছেন রাহুল দেব বর্মণ তার শ্রেষ্ঠ গানগুলো আপনাকে দিয়েছেন, অবশিষ্টগুলো আশা ভোসলেকে। আপনি কি তা স্বীকার করেন?
লতা : (হেসে) আমি তা জানি না। তবে তিনি যদি তা করে থাকেন নিশ্চয়ই তার কারণ রয়েছে। পঞ্চম (আর ডি বর্মন) আমার সাথে খুব যোগাযোগ রাখতেন। আমাকে দিদি ডাকতেন এবং বোনের মতো ভালোবাসতেন। আমার জন্য তিনি পারলে হৃদয়টা উজাড় করে দিতেন। (আমার জন্য তিনি একটি স্পেশাল স্টাইল তৈরি করে ফেলেন। তিনি সহজাত বোধ থেকেই বুঝতে পারতেন কোনটা আমার কণ্ঠে আর কোনটা আশার কণ্ঠে বেশি মানাবে। লক্ষীকান্ত পেয়ারিলাল আমার জন্য যে সুরগুলো করতেন তাও ছিল আমার প্রিয়। ১০-১২ বছর তারা সত্যি কিছু অসাধারণ গান সৃষ্টি করেছেন।
এস পি বালা সুব্রামানিয়াম যার সাথে আপনার অনেক হিট গান রয়েছে, গত শুক্রবার ( সেপ্টেম্বর) মারা গেলেন।
লতা : নিজের একজন সহকর্মীর বিদায় ভীষণ বেদনার। বালাজি এবং আমি অনেক হিট গান গেয়েছি। 'এক দুজে কে লিয়ে,' 'ম্যায় তেয়ার কিয়া, 'হাম আপকে হ্যায় কৌন' এবং আরো অনেক গান। তিনি খুব ভালো গায়ক ছিলেন, তার চেয়ে ভালো মানুষ ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি ভালো শিল্পী হতে হলে বিশুদ্ধ আত্মা থাকতে হবে।
আপনার ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য আপনার জন্মদিনের বার্তা কি?
লতা : আমরা সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যারা আপনার চেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত তাদের জন্য সদয় ও উদারহস্ত হতে কার্পণ্য করবেন না। আপনার অন্তরের ঐশ্বর্য মুঠিতে চেপে ধরে রাখার সময় এটা নয়- প্রেমের গঙ্গা যেন বয়ে যায়।
সঙ্গীতের লতা বিংশ শতকে একজনই জন্মেছিলেন। একবিংশ শতকের অন্তত কুড়ি সাল পর্যন্ত লতার সমকক্ষ আর কারো নাম বলা যাবে না। মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও এমনকি বাংলা গানেও সমভাবে শ্রোতাদের দশকের পর দশক অভিভূত করে রেখেছেন।
হিন্দি কিংবা অন্য কোনো ভারতীয় ভাষার গান থাক, অন্তত আমাদের কণ্ঠে অনুরণিত কয়েকটি বাংলা গানের উদাহরণ দেওয়া যাক!
প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে
আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে
না যেয়ো না রজনী এখনো বাকী
ওগো আর কিছু তো নাই
ও পলাশ ও শিমুল
ও ঝরঝর ঝরনা ও রূপালী বর্ণা
ও মোর ময়না গো
অন্তবিহীন কাটে না আর যেন এই দিন
প্রিয়তম কি লিখি তোমায়
কে প্রথম ভালোবেসেছি, কে প্রথম কাছে এসেছি
ওরে মন পাখি
নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা
আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন
যদিও রজনী পোহালো তবু দিবস কেন এলো না।
শতশত গানের কটা উল্লেখ করব!