গদারের ‘কনটেম্পট’ চলচ্চিত্রের ৬০ বছর পূর্তি, এক বড় বাজেটের চলচ্চিত্র!
কনটেম্পট চলচ্চিত্রটিকে বলা হয় জঁ-লুক গদারের একমাত্র ধ্রপদি ঘরানার সহজসরল ও বড় বাজেটের চলচ্চিত্র। অনেক অর্থকড়ি লেগেছে অভিনেত্রী ব্রিজিত বার্দোর জন্য সেটা ঠিকই আছে, কিন্তু আদতেই কি ছবিটি সহজসরল? যদিও গদার নিজেই বলছেন, এটি রহস্য অনাবৃত সরল চলচ্চিত্র। এবং এর পরপরই বলছেন এটি একটি এরিস্টটলীয় চলচ্চিত্র। ছবিটি ইতালির বিখ্যাত লেখক অ্যালবের্তো মোরাভিয়ার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। মোরাভিয়ার উপন্যাস নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বসিত ছিলেন না গদার।
এক নাতিদীর্ঘ লেখায় গদার বলছেন, মোরাভিয়ার উপন্যাসটি সুন্দর, তবে রেলভ্রমণের উপযোগী স্থূল উপন্যাস। আধুনিকতার পরিবর্তে প্রচুর সনাতনী ও সেকেলে অনুভূতি দিয়ে ঠাসা। কিন্তু গদার এ-ও মনে করেন, এই ধরনের উপন্যাস থেকে কেউ চাইলে তার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রও নির্মাণ করতে পারেন। মজার বিষয়, কনটেম্পট, যা ফরাসিতে 'ল মেপ্রি', তাকে অনেকেই গদারের ধ্রপদি চলচ্চিত্রের মর্যাদা দেন। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পাওয়া কনটেম্পট কেন এখনো এত জনপ্রিয়, সেটা নিয়ে ২০০০ সালে বিস্ময় প্রকাশ করেন গদার। ১৯৮১ সালে ফ্রান্সে এবং ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ছবিটি পুনঃমুক্তি পায় এবং মানুষ টিকিট কেটে ছবিটি আবার দেখে। যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তির পর চলচ্চিত্র সমালোচক কলিন ম্যাককাবে বলেছিলেন, যুদ্ধোত্তর ইউরোপে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। গদার অবশ্য এসব প্রশংসাবাক্যে বিগলিত হননি। তিনি মনে করতেন, প্রথা মেনে ছবিটি করার জন্যই মানুষের মনে তা টিকে গেছে। তা ছাড়া এটি দুই পয়সার উপন্যাস, আর স্বস্তা উপাদানে ভরপুর, তাই মানুষ ছবিটিকে এত মাথায় তুলে রাখছে। গদারের এই দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু ঠিক?
গদার এই ছবিটিকে বলছেন সহজসরল ছবি, কিন্তু নিজেই এর ভেতর তিন স্তরের গল্প বুনেছেন। আধুনিক জীবনের সংকট হাজির করেছেন। নিজেই বলছেন, এটি এরিস্টটলীয় চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত। আবার এ-ও বলছেন, ছবিটির আসলে নাম হওয়া উচিত ছিল 'হোমারের সন্ধানে'। তাহলে এই ছবি সামান্য হয় কেমন করে?
১.
ছবির গল্প সংক্ষেপে বলা যাক: পল জাভাল (মিশেল পিকোলি) একজন ফরাসি তরুণ চিত্রনাট্যকার, তিনি প্রথমবারের মতো প্রস্তাব পান একটি বড় ছবির চিত্রনাট্য পুনর্লিখনের। হোমারের লেখা ওডেসি নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন ফ্রিৎজ ল্যাং, তিনি মেট্রোপলিসখ্যাত বিশ্বনন্দিত জার্মান নির্মাতা, স্বনামেই অভিনয় করেছেন এই ছবিতে। কিন্তু তার পরিচালনায় খুশি নন মার্কিন প্রযোজক জেরেমি প্রকোশ (জ্যাক প্যালেন্স), তিনি ছবিতে আরও নগ্নতা চান। শুধু তা-ই নয়, প্রযোজক আরও দেখাতে চান ইউলিসিসের স্ত্রী পেনেলোপে বিশ্বস্ত ছিল না। কিন্তু ছবিতে এতসব পরিবর্তনে রাজি নন ফ্রিৎজ। তাই ডাক পড়ে পলের। প্রযোজক জেরেমি একরকম নিশ্চিত যে পল তার জন্য কাজটি করে দেবে, যেহেতু পলের উন্নতি করার বাসনা রয়েছে এবং তার একটি সুন্দরী স্ত্রীও রয়েছে। স্ত্রীর পার্থিব চাহিদা পূরণের জন্য পলের অর্থ দরকার। প্রযোজক ঠিকই ধরতে পেরেছে। পলের স্ত্রী ক্যামিল জাভালি (ব্রিজিত বার্দো) একটি নতুন আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চায়। এই কাজটি করলেই তবে পল ওই অ্যাপার্টমেন্ট খরিদের টাকা পাবে। প্রযোজকের পীড়াপীড়িতে স্ত্রী ক্যামিলকে নিয়ে ইতালির মশহুর স্টুডিও চিনেচিতাতে নিয়ে যায় পল।
ক্যামিলের উপর নজর পড়ে প্রযোজক জেরেমির। তাকে দুই আসনের স্পোর্টস কারে করে নিজের ভিলাতে নিয়ে যায় সে। আর পলকে বিকল্পযানে আসতে বলে। বিষয়টি ক্যামিল ভালোভাবে নেয়নি। ক্যামিল ভেবেছে ছবির কাজটি পাওয়ার জন্য, অর্থের জন্য নিজের স্ত্রীকে প্রযোজকের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে পল। এখান থেকেই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। যেখানে আমরা ছবির শুরুতেই দেখি ক্যামিল নগ্ন হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, আর পল স্ত্রীর প্রতি অঙ্গের প্রতি ভালো লাগা জানাচ্ছে, শেষে বলছে—আমি তোমাকে ভালোবাসি সম্পূর্ণরূপে, স্নেহভরে, নিদারুণভাবে...। ক্যামিল তখন প্রত্যুত্তরে বলে, আমিও।
তো সেই প্রেম ভেঙে পড়তে থাকে প্রযোজকের আগমনে। সম্পর্কের ফাটল আরও বড় হয়, যখন জেরেমির ভিলাতে এসে ক্যামিল অপেক্ষা করতে থাকে। অনেকক্ষণ পর পল ঢোকে, জেরেমির তরুণী সেক্রেটারি ও দ্বিভাষিক ফ্রাঞ্চিসকার (জর্জিয়া মোল) সাথে প্রায় একই সময়ে। ক্যামিলার মনের ভেতর তখন দুটো প্রশ্নের উদয় হয়: পল কি ইচ্ছা করেই দেরি করে এল, যেন প্রযোজক তার সাথে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পায়? নাকি ফ্রাঞ্চিসকার সাথে পলের কিছু চলছে, যে কারণে তারা দুজনে সময় কাটানোর জন্যই তাকে একা জেরেমির সাথে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে? এই দুই প্রশ্নের মিলিত ফল হলো পলের প্রতি একধরনের শিথিল আচরণ। এখান থেকে পলের প্রতি ক্যামিলের অবজ্ঞা শুরু।
যদিও ছবিতে পল ও ফ্রাঞ্চিসকার রসায়ন দর্শক দেখেছে, পশ্চাৎদেশে হালকা চাপড় মারা দৃশ্যে। পরে অবশ্য সেটা স্ত্রী ক্যামিলার সামনে স্বীকারও করেছে পল। যার বিয়োগফলে আমরা দেখি ক্যাপ্রি দ্বীপে শুটিংয়ে গিয়ে পলকে দেখিয়ে প্রযোজক জেরেমিকে চুমু খাচ্ছে ক্যামিল। এই দৃশ্য দেখার পর ভেঙে পড়ে পল। বেঁকে বসে, সে আর ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করতে চায় না। তার অর্থের প্রয়োজন ছিল ক্যামিলের জন্য, ক্যামিল একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চেয়েছিল সে জন্য। কিন্তু ক্যামিল তো আর তার নেই। কাজেই পয়সার জন্য এই ভালগার প্রজেক্টে কাজ করবে না পল। বরং আগের সম্মানজনক অবস্থানটাই ধরে রাখবে। নিজের মতো লেখালেখি করবে। এদিকে ক্যামিল চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে জেরেমির সাথে উড়াল দেয়, উদ্দেশ্য রোম। কিন্তু পথে দুর্ঘটনায় মারা যায় দুজনই। আরও মুষড়ে পড়ে পল। শেষে ফ্রিৎজ ল্যাংকে বিদায় জানিয়ে সে চলে যায়। ঠিক সেই সময়েই দেখা যায় ফ্রিৎজের সহকারী পরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করছেন গদার। ওডিসির দৃশ্যের নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। যে ছবি পল পরিত্যাগ করে চলে গেল, আত্মপোলব্ধির পর, সেই 'স্বস্তা'র ছবিতেই কাজ করতে লাগলেন খোদ গদার। পরিশেষে তার উচ্চারিত 'সাইলেন্স' ধ্বনি দিয়েই শেষ হয় চলচ্চিত্রটি।
২.
ছবির শুরুতেই ব্রিজিত বার্দোর নগ্ন শরীরের দৃশ্যে তিন রঙের প্রলেপ (কালার পেলেট) ব্যবহার করেন গদার: লাল, সাদা ও নীল। বোঝার অপেক্ষা রাখে না এটি তেরঙা ফরাসি পতাকার রং। গোটা জাতির কাছেই তখন ব্রিজিত আকাঙ্ক্ষিত ও আবেদনময়ী নায়িকা। জাতির বাসনাকে এভাবে পরোক্ষভাবে তুলে ধরে মূলত গদার বলতে চাইলেন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের কথা—জাতি আনন্দাবস্থায় বিরাজ করতে চায়, এরিস্টটল যাকে বলছেন 'ইউডেইমনিয়া' (eudaemonia), গ্রিক শব্দটির সরল অনুবাদ সুখ বা সুখানুভব। তো গদার কামজাত সুখানুভূতির সাথে জাতির সুখ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকে এভাবে মিলিয়ে দিলেন। তবে কেবল এ কারণেই তিনি ছবিটিকে এরিস্টটলীয় ছবি বলেননি।
এরিস্টটলের ইউডেইমনিয়ার সরলার্থ শুদ্ধ সুখানুভূতি করলে আসলে ঠিক হবে না। এটি এমন এক অনুভূতি, যেখানে মানুষের সুখানুভূতি থাকে, এর পাশাপাশি সে উন্নত জীবনধারণ ও জীবনযাপনে স্থিতাবস্থা আনতে চায়। এই বাঞ্ছা পূরণে মানুষ সুখের পেছনে তো ছোটেই, পাশাপাশি সে সম্পদ অর্জন করতে চায়, সামাজিক মর্যাদাও চায়। কিন্তু এরিস্টটল মনে করেন, এই ইচ্ছাপূরণ একটি মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য হতে পারে না। এরিস্টটলের মতে, একজন মানুষের পরম চাওয়া বা পরম সুখানুভূতি তখনই হয়, যখন সে যৌক্তিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিকতা চর্চার ভেতর দিয়ে একটি চিন্তাশীল জীবনে প্রবেশ করে। এবং যখন কেউ ও রকম জীবনে প্রবেশ করে-এরিস্টটলের মতে, তার আর অন্য কিছু প্রত্যাশা করা ঠিক নয় এবং সকল সন্তুষ্টি ওই জীবনেই তার খুঁজে নেওয়া উচিত। তবে এই যে পরম উৎকর্ষ সাধন, সেটি পারিপার্শ্বিক সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয় বলেও মনে করতেন এরিস্টটল।
৩.
গদারের এই ছবি আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের বস্তুগত চাহিদা ও কামনা-বাসনার এক চলচ্চিত্ররূপে উপস্থাপন, যাকে এরিস্টটলের চশমা দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন গদার। আমরাও সেটা প্রত্যক্ষ করি, যখন এই ছবিতে দেখি—পল পয়সার জন্য নিজেকে বিক্রি করে দিচ্ছে এমন এক মার্কিন প্রযোজকের কাছে, যিনি বিকৃত মানসিকতার প্রতিভূ। জেরেমি যেন স্বয়ং পুঁজিবাদ। সে যৌনতাকে বিক্রি করতে চায়। সে মুনাফার জন্য হোমারের লেখা মহাকাব্যকেও নিজের মতো উল্টো করে রচনা করতে চায়। তো এই পুঁজিবাদের খপ্পরে পল ধরা পড়ে। আর ফ্রিৎজ শুরু থেকেই ধরা। নয় তো তিনি এই প্রযোজকের সঙ্গে চুক্তিই করতেন না। এরপর দোভাষী ফ্রাঞ্চিসকার কথা যদি চিন্তা করা যায়, দেখব নানা ধরনের চাপ ও অপমান সহ্য করে সে আপস করে কাজ করছে জেরেমির সাথে। অপর দিকে পলের স্ত্রী ক্যামিলও একটা সময় নিজেকে সমর্পিত করে এই সর্বগ্রাসী জেরেমির কাছে। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি, জেরেমি প্রযোজিত ছবিটিতে গদার স্বয়ং নিজেকে সঁপে দেন। অর্থাৎ গদার এই বড় বাজেট, বড় তারকা, যৌনগন্ধী সিনেমা বানাতে চাননি, বহু জায়গায় তিনি সেটা উল্লেখও করেছেন, তারপরও তাকে ছবিটি বানাতে হয়েছে। চাপ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলচ্চিত্র কারখানার চাপ। প্রযোজকদ্বয় জর্জ দো ব্যুখোগাদ ও কার্লো পন্টি তাকে ছবির শুরু, মধ্যভাগ ও শেষে বার্দোর নগ্নতাকে দেখাতে চাপ দিচ্ছিলেন। গদার দেখিয়েছেন সেটা, কিন্তু নিজের চিন্তা জারি রেখে শিল্পিত উপায়ে। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ব্রিজিতকে তিনি লংস্কার্ট পরতে বললেও, ব্রিজিত তা শোনেননি, যৌন আবেদনকে অক্ষুণ্ণ রাখতে নায়িকা প্রযোজকদের সঙ্গে ভিড়ে যান। কাজেই গদার, বলা বাহুল্য, অসহায় বোধ নিয়েই ছবিটি বানান। আর ছবি নির্মাণকালে পাপারাজ্জিদের যন্ত্রণার কথা না হয় উহ্যই থাকল। নায়িকার নেকামিও বিস্তর সহ্য করতে হয়েছে গদারকে। ছবির সিনেমাটোগ্রাফার, গদারের দীর্ঘদিনের সঙ্গী রাউল কোতারের বয়ানে এসব কাহিনি পাওয়া যায়। যা-ই হোক, গদার এ রকম গৎবাঁধা চিত্রনাট্যের ছকে নায়ক-নায়িকাকে নিক্ষেপ করে ছবি বানাতে অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি নিজের মতো ব্যতিক্রমী ঢঙে কাজ করেন। কিন্তু বড় বাজেট হওয়ার কারণে প্রযোজকদের অনেক অনুরোধ ও উপরোধ তাকে গিলতে হয়েছে, যার কিছুটা ছায়া আমরা ছবির শরীরে দেখতে পাই। তারপরও ছবিটি যে অনন্য হয়ে উঠেছে, সেটা গদারের গুণের কারণেই।
আমরা শুরুতে বলেছিলাম, তিনটি স্তরের কথা। এখানে প্রথম স্তরটি হলো হোমারের মহাকাব্যে বর্ণিত ইউলিসিস ও পেনেলোপের সম্পর্ক, দ্বিতীয় স্তর হলো পল ও ক্যামিলের সম্পর্ক এবং তৃতীয় স্তর হলো গদার ও কারিনার অন্তর্নিহিত স্রোত।
গদারের এই মিজোঁনাবিম (mise-en-abyme) চলচ্চিত্রটিকে যদি আরেকটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, তবে ত্রিস্তরের চলচ্চিত্রে থাকা পৌরাণিক অংশটিকে বলা যায় অধি-আখ্যান। মূল আখ্যান হিসেবে আছে পল-ক্যামিল-জেরেমির ত্রিভুজ সমীকরণ। আর লুকায়িত আখ্যানে আছেন খোদ নির্মাতা। হোমারের মহাকাব্যে রয়েছে পেনেলোপে—খুবই সৎ ও পতিপরায়ণা স্ত্রী। কিন্তু প্রযোজক জেরেমি পেনেলোপের সততাকে নষ্ট করে দিতে চায়। সে চায় ফ্রিৎজ যে ওডেসি বানাচ্ছেন, তাতে পেনেলোপের পরকীয়া থাকুক। ফ্রিৎজ তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এমনকি নগ্নতা জুড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও। তখনই এই পলের ডাক পড়ে নতুন করে চিত্রনাট্য লেখার। জেরেমির মনোভূমি মূর্ত হতে থাকে ক্যামিলের ক্ষেত্রে। এখানে পল হয়ে ওঠে ইউলিসিস আর ক্যামিল যেন পেনেলোপে। পেনেলোপে কৌশলে শতাধিক পাণিপ্রার্থীকে ফিরিয়ে দিলেও, আধুনিক সময়ে সেটা আশা করা যায় না ক্যামিলের কাছ থেকে। আর এটা ট্রয়যুদ্ধের আমলের ইউরোপও নয়। ট্রয়ের যুদ্ধ ছিল হারানো সম্মান ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ, আর পলের ক্ষেত্রে জেরেমির ছবিতে যুক্ত হওয়া ছিল আর্থিক অবস্থাকে দৃঢ় করে গড়ে তোলার সংগ্রাম। কিন্তু পেনেলোপের মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা যেহেতু ক্যামিল দেখাতে পারেনি, তাই নিজের ধনী হওয়ার সংগ্রাম থেকে সরে আসে পল। সিদ্ধান্ত নেয় ছবিতে আর কাজ করবে না। ওদিকে স্ত্রী আনা কারিনার সঙ্গে গদারের সম্পর্কের মাত্রা ক্ষণে ক্ষণে ওঠানামা করছে। কনটেম্পট ছবির শুটিং চলাকালেই বহুবার ইতালি থেকে ফ্রান্সে গিয়ে কারিনার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন গদার। আবার উল্টোটাও হয়েছে, কারিনাও এসেছেন ইতালিতে গদারের সাথে দেখা করতে।
কারিনা সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলছেন: 'ওটা ছিল উন্মাদ ভালোবাসা। প্রেম, ঈর্ষা, প্রতিশোধ।' রোমে যখন কারিনা গেছেন গদারের সাথে দেখা করতে, তারা একটি নৈশক্লাবে যান। সেখানে অপরিচিত এক লোকের সাথে নেচেছিলেন কারিনা। নৃত্য শেষে টেবিলে ফিরে আসার সাথে সাথে গদার সকলের সামনে তাকে চড় মেরেছিলেন। কারিনা বলছেন, 'আমাকে ও চড় মেরেছিল; কারণ, আমি অন্য আরেকজনের সাথে নেচেছি। কিন্তু আমার রাগ হয়নি—চড় দিয়েই প্রমাণ হয়, ও আমাকে ভালোবাসে। এরপরই আমি ওকে চুমু খাই; কারণ, ওই ঘটনা প্রমাণ করে ও আমাকে ভালোবাসত।'
তিন আখ্যানেই কিন্তু ত্রিভুজের দেখা মেলে। হোমারের মহাকাব্য, যা চলচ্চিত্রের ভেতরের চলচ্চিত্র, সেখানে ইউলিসিস, পেনেলোপে এবং পেনেলোপের পাণিপ্রার্থীগণ। চলচ্চিত্রে পল-ক্যামিল-জেরেমির তিন বিন্দুকে আমরা দেখি ক্যাপ্রির সেই আধুনিক মাস্টারওয়ার্ক ভিলা মালাপার্টে ত্রিভুজ গঠনের সিঁড়ি দিয়ে পারদের মতো ওঠানামা করতে। আর চলচ্চিত্রের বাইরে গদার ও কারিনা দুজনের মনেই তৃতীয় আরেক বিন্দু, যার নাম ঈর্ষা। কারিনার ঈর্ষার নাম হয় তো ব্রিজিত। গদারের ঈর্ষার নাম অন্য পুরুষ।
পাঠিকা হয়তো ভাবতে পারেন, গদারের আখ্যানকে আমি জোর করে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি কি না! না, এর সপক্ষে দলিল রয়েছে, রিচার্ড ব্রুডির বই পড়ুন। ছবিতে পল চরিত্রে অভিনয় করা পিকোলি নিজেই বলেছেন, তারা যেন গদার আর কারিনার চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। পুরুষ চরিত্রটি গদারেরই ছিল। এমনকি পিকোলি গদারের জ্যাকেট ও মোজাও পরেছিলেন ছবিতে। আর সিনেমাটোগ্রাফার কুতার তো সরাসরি বলেছেন, 'আমি নিশ্চিত কনটেম্পট ছবিতে সে (গদার) তার স্ত্রীকে (কারিনা) কিছু বলতে চেয়েছেন।' কুতার বলছেন, ছবিটি আদতে প্রযোজক ব্যুখোগাদের মিলিয়ন ডলার খরচ করে স্ত্রীকে লেখা একটি 'চিঠি'। যে চিঠির বক্তব্য ছিল: গদার যদি সুন্দরী স্ত্রী কারিনা, তিনি নায়িকাও বটে, তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এমন সব প্রকল্প হাতে নিতে থাকে, যা সে অপছন্দ করে, যেমন কনটেম্পট, তবে এমন একদিন আসবে, যেদিন কারিনাই গদারকে অপছন্দ করতে শুরু করবে। তাই সিনেমা না বানানো হলেও সম্পর্কটা টিকে থাকবে অন্তত। এটাই চেয়েছিলেন গদার। তিনি কারিনার প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। তারপরও কারিনা যদি চলে যেতে চায়, ক্যামিলের মতো, চলে যেতে পারে। কারিনা থাকেননি গদারের সঙ্গে। তাদের প্রেম, বিয়ে ও বিচ্ছেদের ঘটনা প্রবাদপ্রতিম, সকলেই জানেন। তাই ওদিকে আর না যাই।
৪.
ইউলিসিস, পল ও গদার—এই তিনজনই চেয়েছে একটি বিষয় অর্জন করতে, আর চেয়েছে নারীর অনুরক্ত মন। ইউলিসিস চেয়েছিল, ট্রয়যুদ্ধে জয় শেষে স্ত্রী সততার পরীক্ষায় পাস করুক; পল চেয়েছিল, চিত্রনাট্য লিখে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট খরিদ করে স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে থাকতে এবং গদার চেয়েছিলেন, একটা বড় বাজেটের সিনেমা বানিয়ে কারিনার চোখে আরও বড় হতে—পরে অবশ্য ছবি করতে গিয়ে তার সেই ভুল ভাঙে। তিনজনের মনের ভেতরেই স্ত্রীর নিখাদ ভালোবাসা পাওয়ার বাসনা সদাজাগ্রত। তিনজনই তাদের স্ত্রীকে ভালোবাসছেন—'টোটালি, টেন্ডারলি, ট্র্যাজিক্যালি...'।
তাদের অবস্থা এরিস্টটল বর্ণিত মানুষের মনোবাঞ্ছার মতোই। মানবিক সম্পর্কের সুখ তারা পেতে চায়, কিন্তু তারপরও আরও কিছু চাওয়া থাকে তাদের। সে কারণেই কেউ যুদ্ধে যায়, কেউ চিত্রনাট্য লেখায় ব্রতী হয়, কেউ অন্য দেশে গিয়ে ছবি বানায়। তিন চরিত্রই ভিনদেশে গিয়ে এমন কাজ করে, যা তাদের সামাজিক পরিচয়কে দৃঢ় করতে সহায়ক। বাসনা পূরণ ও সামাজিক মর্যাদাই কি শেষ কথা? এরিস্টটল বলছেন, না। পরম উৎকর্ষ হলো যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে চিন্তাশীল জীবনযাপন করা। গদার নিজের উত্তরণ ঘটাতে পারেননি ঠিকই, মানে এই ছবি সে বহুবার ত্যাগ করার চেষ্টা করেছেন, পারেননি, কিন্তু নিজের বাসনা তিনি পূরণ করেছেন চলচ্চিত্রের চরিত্র পলকে দিয়ে। পল শেষ পর্যন্ত ছবির কাজটি ছেড়ে দিয়ে নিজের পূর্বের কাজে মনোনিবেশ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। সে সেট ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু গদারকে আমরা দেখি ইউলিসিসের অভিযাত্রায় শামিল হয়ে যেতে।
শেষতক তিনজনের পথ আর এক থাকে না। তাই তো হওয়ার কথা। আধুনিক ও উন্নত শিল্প তো এমনই হবে। সে পুরাণ থেকে আত্মা নেবে, গড়ে তুলবে নতুন মানুষ। গদারও তা-ই করেছেন। পুরাণের কাহিনিকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। দেখিয়েছেন, পুরাণের বিপরীতে হাঁটতে গিয়ে কেমন করে জেরেমি ছিটকে পড়ে। দেখিয়েছেন পেনেলোপের মতো হয়নি বলে দুর্ঘটনাকে বরণ করে নিতে হয়েছে ক্যামিলকে। নৈতিকতা কি নিয়তি নির্ধারণ করে দিচ্ছে? গদার আরও দেখিয়েছেন, ইউলিসিসের মতো সতীত্ব খোঁজার মতো মানুষ পল নয়, সে ছেড়ে দিতে জানে। তা ছাড়া, নিজের উৎকর্ষসাধনের পথ নিজেই খুঁজে নিতে পারে সে। সেখানে নারী বা অর্থ বাধা নয়। পয়সা বা সম্পর্কের জন্য নিজের স্বকীয়তাকে বিক্রি করা থেকে সে বিরত হয়। চিন্তাশীল হয়ে না উঠলে এটা সম্ভব হতো না। অপরপক্ষে এভাবেও বলা যায়, গদারও চিন্তাশীল বলেই নিজের বন্দিত্ব দশাকে ফ্রেমবন্দী করে দর্শকের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছেন, বলতে চেয়েছেন, তিনি অসহায়। ছবিটা তাকে শেষ পর্যন্ত বানাতেই হবে। বানিয়েছেন শেষ পর্যন্ত, নানা রকম নাটক শেষে।
যে প্রত্যাশা নিয়ে এই ছবিটি তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন গদার, সেটি পূরণ হয়নি। সে জন্য তিনি বলছেন, এই ছবিটি একজন নারী, যিনি তার স্বামীকে অবজ্ঞা করে, ছেড়ে চলে যায়, তার মানসিকতা পাঠের চেয়েও অনেক বেশি আধুনিকতার ঝড়ে আক্রান্ত বিধ্বস্ত জাহাজের বেঁচে যাওয়া পশ্চিমা দুনিয়ার যাত্রীটির গল্প বলে, যে একটি নির্জন রহস্যময় দ্বীপে আশ্রয় নেয়, অথচ যার নিজের কোনো রহস্যময়তা নেই। গদার বলছেন, তিনি হোমারের লেখা ওডিসির আত্মাকে ধরতে চেয়েছেন। ওডিসির চরিত্রদের অবলোকন করেছিলেন ঈশ্বর, আর গদার সেই ঈশ্বরকে প্রতিস্থাপিত করেছেন ক্যামেরা দিয়ে। ক্যামেরার চোখ দিয়ে তিনি এই ছবির চরিত্রদের উপর নজর রেখেছেন। একদিকে গদারের হতাশা, অপরদিকে নিজের প্রচেষ্টার কথা। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মুনাফামুখী প্রযোজকদের পাল্লায় পড়ে যে ছবি তিনি বানিয়েছেন, সেটি ঝড়েরই শামিল, শেষ পর্যন্ত চাপ সামাল দিয়ে ছবিটি যে মুক্তি দিতে পেরেছিলেন, সেটি ওই নিঃসঙ্গ, লড়াকু যাত্রীটির কথাই মনে করিয়ে দেয়। তার সঙ্গে মূল আখ্যানের চরিত্র পল জাভালিকে মিলিয়ে নেওয়া যায়। মিলিয়ে নেওয়া যায় গদারের যাপিত দিনের অভিজ্ঞতাকে। যুগের ও নিজের যন্ত্রণাকে এভাবে চলচ্চিত্রে চালান করে দেওয়ার ক্ষমতা, সেই সময়ে গদার ছাড়া আর কারও পক্ষে আসলে কল্পনা করা কঠিন।
সহায়
১. জঁ-লুক গদার, গদার অন গদার, টম মিলনে অনূদিত ও সম্পাদিত (নিউ ইয়র্ক: ডা ক্যাপো প্রেস, ১৯৭২)
২. রিচার্ড ব্রুডি, এভরিথিং ইজ সিনেমা: দ্য ওয়ার্কিং লাইফ অব জঁ-লুক গদার, (নিউ ইয়র্ক: হল্ট পেপারব্যাকস, ২০০৮)
৩. স্টিভেন উঙ্গার, টোটালি, টেন্ডারলি, ট্র্যাজিক্যালি... অ্যান্ড ইন কালার: অ্যানাদার লুক অ্যাট গদারস লো মেপ্রি, টম কনলে ও টি জেফারসন ক্লাইন সম্পাদিত 'আ কম্পানিয়ন টু জঁ-লুক গদার' পৃষ্ঠা: ৬০-৭০, (অক্সফোর্ড: উইলি ব্ল্যাকওয়েল, ২০১৪)
৪. টি জেড, ল্যাভিন, ফ্রম সক্রেটিস টু সার্ত্রে: দ্য ফিলোসফিক কোয়েস্ট, (নিউ ইয়র্ক: ব্যানটাম বুকস: ১৯৮৪)