নগরের ক্যানভাসে জনতার বিপ্লব
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর বিজয়ের আনন্দে পথে নেমে আসা মানুষ উদ্যাপন করতে নেমে দেখল, শহরময় যেন দেয়াললিখনের উৎসব তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। স্প্রে ক্যান আর রংতুলি হাতে আগে যাদের সুযোগ হয়নি, তারাও নেমে পড়ল। পরবর্তী দিনগুলোতে আমাদের চোখের সামনে দেয়াললিখনের প্রকৃতি ও ভাষ্য পাল্টে গেল। স্বৈরাচারবিরোধী বার্তা স্তিমিত হয়ে গিয়ে ফুটে উঠল সংস্কার, শোক আর শান্তির বার্তা, নতুন বাংলাদেশের রঙিন স্বপ্ন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশে দেশে বিদ্রোহী তারুণ্যের সৃজনশীলতা আশা-আকাক্সক্ষা, ক্ষোভ আর স্বপ্ন ফুটে উঠেছে শহরের এই জীবন্ত ক্যানভাসে। দেশীয় দেয়াললিখন, পশ্চিমা ঘরানার গ্রাফিতি, দেয়ালচিত্র বা ম্যুরাল, কার্টুন, আলপনা...নান্দনিক বৈচিত্র্যে অনন্য এই পথ শিল্পের চর্চাকে কোনো সংজ্ঞা বা শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে নিয়ে আসার কাজের কথা মনে রেখেই শুনে আসা যাক বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এর স্পন্দন।
'আমার ব্যক্তিমালিকানা যেখানে শুরু, তোমাদের বাক্স্বাধীনতা সেখানেই শেষ'
দেয়ালে আঁকার ইতিহাস যদিও প্রাগৈতিহাসিক, আধুনিক শহরের দেয়ালে, স্থাপনার গায়ে, ট্রেনের বগিতে তরুণদের নিজস্ব পরিচয়, চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতার অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রাফিতির উদ্ভব ষাট এবং সত্তরের দশকে আমেরিকার বড় শহরগুলোতে, বিশেষত নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ায়। তখন অনেক ক্ষেত্রেই নানাভাবে নিজেদের নাম বা উপাধি দেয়ালে লিখে রাখা বা ট্যাগিং ছিল স্ট্রিট গ্যাংগুলোর এলাকা দখলের অংশ, তাদের কাছে এই চর্চার নাম ছিল কেবল 'রাইটিং'। ফিলাডেলফিয়ায় ড্যারিল ম্যাকক্রে, যিনি দেয়ালে নিজের পরিচয় দিতেন 'কর্নব্রেড' হিসেবে, তাকেই আজকের গ্রাফিতির প্রথম সুপরিচিত শিল্পী বলা যায়। নিউইয়র্কের গ্রাফিতিশিল্পীরা ডিএসএবয়ের ট্রেনের বগি জুড়ে আঁকতেন তাদের মাস্টারপিস। আমাদের দেশে আজকে যে কিশোর আর তরুণেরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠল, তারা কিন্তু অনেকেই শৈশবে সাবওয়ে সার্ফার খেলেছে, যার মধ্যে গ্রাফিতির ইতিহাসের ছাপ রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে প্রচলিত এই মোবাইল গেমটিতে এক তরুণ গ্রাফিতিশিল্পী পুলিশের কাছে ধরা পড়ে পালাতে থাকে, আর সেই পলায়নের মধ্যেই গেমটি এগিয়ে যায়।
শুরু থেকেই ব্যক্তিমালিকানার সাথে সৃষ্টিশীল স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব ছিল গ্রাফিতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন বা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় লেখা এবং আঁকা বিশ্বের বেশির ভাগ শহরেই এখনো বেআইনি। নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ায় গ্রাফিতি বিকশিত হয় হিপ-হপ সংস্কৃতির সাথে সাথে। শ্বেতাঙ্গশাসিত আমেরিকায় বর্ণিল গ্রাফিতি শহরের বুকে ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়িত এবং অধিকারবঞ্চিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সরব ও সদম্ভ উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত করে। একই সাথে এর নান্দনিক সম্ভাবনা শিল্পবোদ্ধাদের নজর কাড়ে এবং এর চর্চা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অধিকারবঞ্চিত মানুষের কাছ থেকে উঠে আসা এই মাধ্যম লাভজনক হয়ে ওঠে অনেকের জন্যই। ব্রিটেনের প্রথিতযশা রহস্যময় পথশিল্পী ব্যাঙ্কসির পরিচয় গোপন থাকলেও তিনি যে শ্বেতাঙ্গ, এটুকু নিশ্চিত। গ্রাফিতি এখন একাধারে একটি বৈপ্লবিক এবং প্রতিষ্ঠিত শিল্পমাধ্যম। তবে এই মুহূর্তে গ্রাফিতি যেখানে ছাত্র-জনতার কথা বলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তেমন কিছু উদাহরণ আমাদের দেশের এই অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাটিকে বুঝতে সাহায্য করবে।
'বাস্তববাদী হোন, অসম্ভবের দাবি করুন'
মে ১৯৬৮, পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র ও শ্রমিকদের আন্দোলন ফ্রান্সের অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে অচল করে দেয়। ফ্রান্সে তখন ছাত্রের সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি। মে মাসের ১১ তারিখে পুলিশ ছাত্রদের আক্রমণ করে ৫০০ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া একটি প্রতিবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। লাখ লাখ শ্রমিক ছাত্রদের সমর্থন করতে কর্মবিরতিতে যায়। মজার ব্যাপার, ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট দে গল পালিয়ে যান পশ্চিম জার্মানিতে। অবশ্য পরে ফিরে এসে সংসদ ভেঙে দিয়ে এবং নির্বাচনে আবার বিজয়ী হলেও দশ মাস পর তার শাসনের অবসান ঘটে। আন্দোলনের সময় ছাত্ররা পাথরে বাঁধানো রাস্তা খুঁড়ে ব্যারিকেড তৈরি করতে গিয়ে দেখল, নিচে ঝিলিক দিচ্ছে সৈকতের বালু। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই তৈরি হয় এই অমর স্লোগান, 'sous les paves, la plage'—পাথরের নিচেই রয়েছে বালুর সৈকত। এ সময়ের আরেকটি স্লোগান সম্প্রতি ঢাকার বুকেও স্থান পেয়েছে: Be realistic, demand the impossible.
আরব বসন্ত: কায়রোর পথে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নীড়
কায়রো ২০১১, তাহরির স্কয়ারে আরব বসন্তের ফুল হয়ে ফুটেছে পথশিল্প। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার জন্য নতুন আশার বাণী ফুটে উঠল সেখানে, জনপরিসর হয়ে উঠল জনতার। সমাজবিজ্ঞানী সাস্কিয়া সেসেন বললেন, শহরের রাস্তা হয়ে উঠেছে বিশ্বের নিপীড়িত জনতার নীড়। শুধু কায়রো নয়, এই সময়ে তিউনিশিয়া, বাহরাইন, সিরিয়া, লিবিয়া...সর্বত্র গ্রাফিতির জয়জয়কার। বাংলাদেশের মতোই বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ একসাথে পথে নেমে এসেছিল মুবারকের বিরুদ্ধে: নারীবাদী আর মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধ সরিয়ে রেখে একই পথে হাঁটছিল বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে। কোনো দলীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, তখনকার দেয়াললিখনে একই সাথে বৈচিত্র্য এবং একতার প্রকাশ ঘটেছিল।
মুবারকের পতনের সংগ্রামে একেকটি এলাকায় জনতার বিজয় চিহ্নিত হতো গ্রাফিতির মাধ্যমে। নীল নদের ওপর বিশ্বখ্যাত পাথরের সিংহবিশিষ্ট কসর আল নীল সেতুতে ইংরেজিতে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে লেখা হয় 'এধসব ড়াবৎ, গঁনধৎধশ.' লেখনীতে আরবির সাথে সাথে ইংরেজির ব্যবহার, যা আমরা বাংলাদেশেও দেখেছি, স্থানীয় দর্শক শ্রোতার বাইরে বৈশ্বিক পরিসরে মনোযোগ আকর্ষণ করে। বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে যায় পৃথিবীজুড়ে।
পুলিশ যখন নিজেই খুনি, আমরা কার কাছে যাব?
৯ আগস্ট, ২০১৪; আমেরিকার মিসৌরি স্টেটের ছোট শহর ফার্গুসন। ১৮ বছর বয়সী মাইকেল ব্রাউন ও তার বন্ধু ২২ বছর বয়সী ডোরিয়ান জনসন ফুটপাথের বদলে শহরের রাস্তার মাঝখানে হাঁটছিল। পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসন তাদের থামায় এবং একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ব্রাউনের। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করে এই নিরস্ত্র আঠারো বছর বয়সী তরুণ আত্মসমর্পণ করে হাত ওপর তুলে চিৎকার করে বলেছিল, 'Hands up, don't shoot!' তবু তাকে দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে ছয়বার গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। খবর ছড়িয়ে পড়লে ফার্গুসনে যে প্রতিবাদ শুরু হয়, সেখান থেকেই এখনকার ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সূত্রপাত। আমেরিকায় অশ্বেতাঙ্গদের যে প্রণালিবদ্ধ বর্ণবাদ ও পুলিশি বর্বরতার শিকার হতে হয়, ব্রাউনের মৃত্যু হয়ে ওঠে তার প্রতীক। তার আগের বছরই মায়ামিতে ১৮ বছর বয়সী পুরস্কারপ্রাপ্ত পথশিল্পী ইসরাইল হার্নান্দেজ একটা পরিত্যক্ত ভবনের গায়ে গ্রাফিতি আঁকার সময় রংয়ের স্প্রে ক্যান হাতে ধরা পড়লে পুলিশের উপর্যুপরি টেসারের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিল। ব্রাউনের হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী দিনগুলোতে দেয়ালে দেয়ালে ভেসে ওঠে তার নাম, কিংবা তার ছবির সাথে লেখা RIP (rest in peace) বা হ্যান্ডস আপ। প্রশ্ন ওঠে, 'পুলিশ যখন নিজেই আইন ভঙ্গ করে, জনগণকে রক্ষা করবে কে?'
প্রতিরোধ কোনো অপরাধ নয়, বর্ণবাদ বন্ধ কর!
মাইকেল ব্রাউনের মৃত্যু শুধু আমেরিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামের অংশ হয়ে উঠেছিল। উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত ফ্রি ডেরি কর্নারে কেউ আঁকে এক সৈনিক তিনজন মানুষের দিকে বন্দুক তাক করে আছে, যাদের হাত ওপরে ওঠানো। তাদের গায়ে লেখা, ডেরি, ফার্গুসন এবং প্যালেস্টাইন। তিনজনকে একতাবদ্ধ করেছে একটি কথা, হ্যান্ডস আপ, ডোন্ট শুট! ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বিভাজক দেয়ালেও স্প্রে করে লেখা হয়—'From Ferguson to Palestine—Resistance is not a crime. End racism now!' অথচ এই একই সময়ে আমেরিকার রক্ষণশীল মিডিয়া বারবার দেখাচ্ছিল ফার্গুসনের কৃষ্ণাঙ্গ জনতা দোকানপাট ভাঙচুর করছে, মদের দোকান থেকে বোতল নিয়ে বেরিয়ে আসছে। তাদের মূল বক্তব্য অগ্রাহ্য করে উশৃঙ্খল ও লোভী হিসেবে দেখানোর এই চেষ্টা ৫ আগস্ট পরবর্তী সোশ্যাল মিডিয়ায় কারও কারও হঠাৎ নীরবতা ভেঙে ছিছিক্কার করে ওঠাকে কি মনে করিয়ে দেয় না? ফার্গুসনের দেয়ালের বার্তাগুলোকে বারবার সাদা রং করে মুছে দেওয়া হয়, সেখানে আবার কেউ এসে লিখে দেয়; এমনটা আমরা ঢাকা শহরেও দেখেছি এবং দেখছি।
চাই সংস্কার
ফার্গুসনের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলে পুলিশবিরোধী গ্রাফিতিগুলো দেয়াল থেকে ক্রমেই মুছে যায়। একটি স্থানীয় পত্রিকা শহরের মানুষকে আহ্বান করে, ফার্গুসনের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানপাট ঢাকা বোর্ডের ওপর শান্তি ও আরোগ্যের বার্তা ফুটিয়ে তুলতে। অনেকেই আসে এবং আঁকে শান্তির পায়রা, ফুল, ভালোবাসা, একতা এবং আশাবাদের কথা। দেয়ালে গর্জে ওঠা ক্ষোভ দেয়ালেই প্রশমিত হয়, কিন্তু আমেরিকার সমাজে বর্ণবাদী বৈষম্য কিন্তু পাল্টায় না। ২০২০ সালে আবারও মিনিয়াপোলিসে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড তা প্রকটভাবে উন্মোচিত করে। ফ্লয়েড অন্তত ২০ বার নিশ্বাস নিতে না পারার কথা বললেও আট মিনিট পনেরো সেকেন্ড ধরে তাকে চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে ডেরেক শোভিন নামের এক পুলিশ অফিসার। এর চারদিন পর, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিবাদী জনতাকে অগ্রাহ্য করে যখন বাইবেল হাতে ছবি তুলছেন, ওয়াশিংটনের মেয়র মুরিয়েল বাউসার নগর কর্মীদের নির্দেশ দেন হোয়াইট হাউসের সামনের একটি সড়কে যত বড় করে সম্ভব উজ্জ্বল হলুদ রঙে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার লিখে দিতে। যদিও তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একটি সাহসী অবস্থান নেন, একটা প্রতীকী লেখার মধ্যে দিয়ে আন্দোলনকে প্রশমিত করার এই চেষ্টা কিন্তু আন্দোলনের সংগঠকেরা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বলেন, একদিকে পুলিশের বাজেট বাড়িয়ে অন্যদিকে এসব লোক দেখানো কাজ না করে বরং মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সত্যিকারের উদ্যোগ এবং বিনিয়োগ। মেয়রের উদ্যোগে সৃষ্ট ম্যুরালটিকে পাল্টে দিয়ে তারা লেখেন, 'Black Lives Matter=Defund the Police.' পাশেই আরেকজন লিখে দেন, 'Fuck the Mural, Change the System.' এভাবেই পথশিল্পের পরিবর্তনশীলতা ক্ষণস্থায়ী হলেও একটি শক্তিশালী মাধ্যম করে তোলে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া সমাধান নয়, কারণ, স্বাভাবিকতাই সমস্যা
আমেরিকা থেকে যাই হংকং। আকাশচুম্বী দালানে সাজানো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এই ঔপনিবেশিক এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কেন্দ্রে প্রাচুর্য থাকলেও কখনোই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৭ সালে হংকং যখন ব্রিটেনের কাছ থেকে চীনের কাছে ফিরে যায়, 'এক দেশ দুই ব্যবস্থা'য় হংকংয়ের নাগরিকদের বলা হয়েছিল, তাদের স্বাধীনতা এবং অধিকার স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় সরকার এই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে শুরু করে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনের একটি সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয় আসামিদের চীনে প্রত্যর্পণের কথা, যেখানে হরহামেশা মানবাধিকার হরণের নজির রয়েছে। হংকংয়ের নাগরিকদের ওপর বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের প্রতিবাদে পথে নেমে আসে মানুষ, শুরু হয় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি। জুনের মাঝামাঝি প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ প্রত্যর্পণ আইন বাতিল, হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি ল্যামের পদত্যাগ ও সর্বজনীন ভোটাধিকার দাবি নিয়ে পথে নেমে আসে এবং পুলিশি বর্বরতার শিকার হয়। জুলাইয়ের ১ তারিখ বিক্ষুব্ধ জনতা সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে।
সরকার তাদের প্রত্যর্পণের প্রস্তাব বাতিল করলেও জনতার দাবি অনুযায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং নতুন একটি জাতীয় নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে গণজমায়েত ও মতপ্রকাশের অধিকার আরও সীমিত করে দেয়। হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার ও কারাবন্দী হয়। কর্মব্যস্ত ও পরিচ্ছন্ন এই নগরীর সুশৃঙ্খল পরিবেশে দেয়াললিখন ও পথচিত্রের বিশৃঙ্খলা অকল্পনীয় হলেও এই সময়ে সেখানকার সাববওয়ে স্টেশনগুলো রাজনৈতিক লিখনে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে: 'There can be no return to normal, because normal was the problem in the first place.' পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে এখানে আমরা আবারও শুনি সেই প্রশ্ন, 'Who do you call when the police murders?' এর প্রতিধ্বনি আমরাও শুনেছি বাংলাদেশে রক্তাক্ত জুলাইয়ে যখন রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় পুলিশ সাধারণ মানুষ ও ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে আমরা ভিডিও দেখি তৎকালীন ওয়ারীর পুলিশ উপকমিশনার ইকবাল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কীভাবে বলছে, 'গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটাই সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।'
পথশিল্পের বিবর্তনে নন্দন আর রাজনীতির দ্বন্দ্ব
মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী সংস্কৃতিকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পণ্য বানানোর ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের জানা, আর এমন ঘটেছে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও। মিসরে আজ আর আরব বসন্তের লেখাগুলো খুঁজে পাওয়া যায় না, সরকারি উদ্যোগে সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে কোকা-কোলা, পেপসি, মোবিনিল ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক করপোরেশন বিপ্লব-পরবর্তী সময় মিসরে গ্রাফিতির আদলে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে। কায়রোর আর্ট গ্যালারিগুলো আয়োজন করে; যা ছিল জনতার মুক্ত চর্চা, তা চলে আসে কাঠামোর ভেতর, শুরু হয় আর্থিক লেনদেন। এই মুহূর্তে ঢাকা শহরে চলছে একটি রাজনৈতিক কার্টুনের প্রদর্শনী, যেখানে ২০২৪-এর বিপ্লবের পোস্টার বিক্রি হচ্ছে, যা অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের জন্য উপকারী এবং দর্শকদের জন্য একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে বিজ্ঞাপনেও বিপ্লবের ভাষা দেখলে বিস্মিত হব না আমরা।
কিন্তু পথশিল্পের নন্দন যেন এর রাজনীতিকে ম্লান করে না দেয়, সেটাও মনে রাখা প্রয়োজন।
সময়ের স্বাভাবিক বিবর্তনে পথশিল্পের ভাষা বিদ্রোহ থেকে শান্তির দিকে যাবেই, তার মধ্যে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বা সুনির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা প্রতিহত করা জরুরি। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের কিছুদিনের মধ্যেই 'অশালীন' এবং 'দৃষ্টিকটু' লেখা ও ছবি মুছে দিয়ে শহরকে 'সুন্দর' করে তোলার উদ্যোগ আমরা দেখেছি। তার পরপরই আমরা শুনতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রাফতি আঁকতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। তাদের পুলিশের অনুমতি নিতে বাধ্য করা হয়েছে, অথচ এই পুলিশ দেশের মানুষকে অরক্ষিত রেখে তার আগের সপ্তাহেই ছিল পলাতক। মনে রাখতে হবে, বিদ্রোহী জনতার শিল্পমাধ্যম যখন তাদের সমর্থিত সরকারও আত্তীকরণ করে, তার সৌন্দর্য এবং তাৎপর্য দুটোই হারায়। আশির দশকে কিউবায় নিউইয়র্ক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রাফিতির বিস্তার শুরু হলে সরকার দ্রুত সেগুলো মুছে ফেলার ব্যবস্থা নেয়, ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকলার সুরক্ষার জন্য আইন পাস করে নিরুৎসাহিত করা হয় এর চর্চা। জনপরিসরে সরকারিভাবে ঢেকে দেওয়া হয় বিপ্লবের ঐতিহাসিক বাণী, চে গুয়েভারা ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর প্রতিকৃতি দিয়ে। বৈপ্লবিক সরকারও জনতার কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে ইতিহাস ও পরিচ্ছন্নতার অজুহাতে। হয়তো এই কারণেই স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার আগে থেকেই ঢাকার এক্সপ্রেসওয়েগুলোর নিচে তৈরি হওয়া নাগরিক ক্যানভাসগুলোকে 'নিরাপদ' ম্যুরাল দিয়ে দখল করে রেখেছিল।
কিন্তু পথশিল্প কোনো 'পতিশিল্প' নয়, বরং প্রতিশিল্প। এর প্রকৃতি মৌলিকভাবেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী। বদ্রিয়ার্ডের ভাষায়, গ্রাফিতি একটি চিৎকার, একটি বিস্ময়, শহরের বুকে বিদ্রোহ এবং অগ্ন্যুৎপাত। এভাবেই যেন আমরা বারেবারে তা ফিরে পাই।
বাংলাদেশে যেন আরো স্বৈরচারী শাসন শিকড় গাড়তে না পারে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি, মুর্যাল জারি থাকুক।