দাঁতব্য
আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, 'দাতব্য' বানানে কোনো চন্দ্রবিন্দু নেই। আমরা ছোট্টবেলায় ভাবতাম দাতব্য চিকিৎসালয় দাঁতের চিকিৎসা দেয়, দাতা আর দানের সঙ্গে যে নামটার আসল সম্বন্ধ– ওটা যে দাঁতের সঙ্গে সম্বন্ধহীন, তা বুঝতাম না। আজ দাঁত নিয়ে কিছু গল্প করব, তাই ওই বানানের শিরোনামখানা।
দাঁত থাকতে...
দাঁতের ব্যথায় কাতর হয়ে ডেন্টিস্টের কাছে গেছেন, আপনার কপালের ওপর নেমে এসেছে চাঁদের মতো রুপালি আলোর কিওরিং লাইট, মুখের ভেতর কলস্বিনী ঝরনা বয়ে চলেছে, একজন নিদন্ত মানুষের কথা কইতে কত অসুবিধে, তা বুঝতে পারছেন, এ সময়ে আপনার কি মনে পড়বে অত বিশাল দাঁত থাকবার পরেও পশমী ম্যামথ কী করে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেল! বরফ যুগে বিলুপ্ত হয়ে গেল খড়্গদন্ত বাঘ? ডেন্টিস্ট আপনাকে দিনে দুবার দাঁত মাজতে উপদেশ দিচ্ছে, আপনার কি মনে পড়বে, কালোবাজারে যার দাঁতের দাম কেজিতে ২০০০ ডলার– সেই হাতি কবে দাঁত মেজেছে! জানিয়ে রাখি, ছুটির সকালে দেরিতে উঠে দাঁত না মেজে আইঢাই করছি দেখলে আমার বাপ বলতো, 'দাঁত মাইজ্যা আর কী করতি, আত্তিতে দাঁত মাজে না তাতে তো তার দাঁতের দর পড়ে নাই! দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝবি না!'
মুখের কথার রাজ্যে আমরা বাস করি, প্রেমের উক্তি শুনি, স্লোগান দিই গলা ফাটিয়ে, আবৃত্তি শুনে গায়ে কদম ফোটে আমাদের, গানের কলি শুনে নয়নজলে ভাসি, সবকিছুর পেছনে আছে এই দাঁতের পাটি। নইলে পষ্ট করে কে কথা বলতে পারত! দন্তহীন নবজাতকের মুখের দুধ-দুধ গন্ধটা যদিও স্বর্গীয়। কিছুদিন পর দুধদাঁত গজায় তার। সেই দাঁত পড়া শুরু হলে বাঙালি শিশু ইঁদুরের গর্তে দাঁত রেখে আসে, ও রকম চালু দাঁত হবে তার। পশ্চিমা শিশু টুথফেয়ারির আশায় দাঁত রেখে দেয় বালিশের নিচে, দাঁত-পরী দাঁতের বিনিময়ে উপহার রেখে যাবে– যেমন রেখে যায় সান্টাক্লজ বা ইস্টার-বানি। জাপানি শিশুরা ওপরের পাটির দাঁত ছোড়ে আকাশের দিকে, নিচের পাটির দাঁত ছোড়ে জমিনে। শিশুর প্রিমোলার বা পেষণদন্ত থাকে না, পরে গজায়, ১৭-২৫ বছরের ভেতর সাধারণত গজায় চারটে আক্কেল দাঁত। সবার অবশ্য আক্কেল হয় না।
প্রাণিজগতে দাঁত
দন্তময় জীবজগতের দিকে তাকাই। খরগোশ নাকি জন্মায় দাঁত নিয়ে। ইঁদুর সারা জীবন দাঁতে দাঁত কাটে; কারণ, দন্তক্ষয় না করলে একদিন তার ক্রমবর্ধনশীল দাঁত মাথার ঘিলুতে গিয়ে চাপ দেবে। ঘোড়া কিংবা জেব্রারও দাঁতের বেলায় ইঁদুরকপালি, তাদের দাঁত ক্রমাগত বাড়ে, এনামেল ক্ষয়ে যায়, পড়ে, আবার গজায়। একজীবনে হাঙরের প্রায় হাজার বিশেক দাঁত গজায়; কারণ, দন্তমূল বা রুট নেই বলে হাঙর প্রায়ই দাঁত হারায়। কুমিরের মুখটা কেমন ভয়ংকর দাঁতে সজ্জিত, কিন্তু ওই দাঁতগুলো ধারালো নয় বলে কুমিরকে প্রাণপণে চিবিয়ে খেতে হয়, এমন চিবোতে গিয়ে জীবদ্দশায় তার প্রায় ৩০০০ দাঁত পড়ে আর গজায়। শুনি ভাল্লুকেরও নাকি দাঁত বেশ ভোঁতা আর খাটো খাটো, তবে সে কিস্তিমাত করে তার ভয়ানক চোয়ালের পেশির জোর দিয়ে। ডলফিনের দাঁতের সংখ্যা গুনে আপনি বলে দিতে পারবেন ওটার বয়স কত। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, 'হাতির দাঁত দু'রকমের, এক পদেরটা দেখনদারি, আরেকটি চিবোনোর, গল্পে যেমন দুরকমের ব্যাপার থাকে– একটি কাহিনী, আরেকটি ভেতরের হিতোপদেশ।' গরুর রচনায় আমরা সব সময় লিখতাম, 'তাহার ওপরের পাটিতে দাঁত নাই।' তাতে কি, গরু ওই নিচের পাটির দাঁতে দিনের আট ঘণ্টা কেবল চিবায়, মন্দ কি, রাখালের লাইভ মিউজিক শুনতে শুনতে রোমন্থন করে। অবশ্য গোষ্ঠে কি আর বাঁশি বাজে?
আদি পাখিদের দাঁত ছিল, বিবর্তনের ফেরে ১০০ মিলিয়ন বছর আগে তারা দাঁত হারিয়েছে। চঞ্চুতে ঠুকরে তারা দাঁতের কাজ সারে। মিসরীয় প্লোভার পাখিকে দেখুন! নিজের দাঁত না থাকলে কী হবে, সে কুমিরের খোলা মুখে বসে দাঁত সাফ করে আসে।
প্রাণিজগতে সবচেয়ে বেশি দাঁত কার জানেন? না না, কোনো রক্তপিপাসু শাসকের নাম বলবেন না। রোজ রাত্রে আপনার বাগানে আনাজের গাছটা একেবারে খেয়ে নিঃশেষ করে যে আপদটি, সেই ছোট্ট শামুকটির দাঁতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৪,০০০ দাঁত, জিবের ওপর সারি বেঁধে দাঁত তার। প্রাণিজগতে সবচেয়ে কঠিন পদার্থ কার দাঁত? গ্রেট হোয়াইট শার্ক, অর্কা বা খুনে-তিমি, নোনাপানির কুমির কিংবা সুন্দরবনের কামঠ হাঙর (যারা নাকি হাত-পা কেটে নিয়ে গেলে প্রথমে টেরই পাওয়া যায় না এমন সাংঘাতিক ধারালো তাদের দাঁত)... এদের কামড়ের কথা ভাবছেন? না, সবচেয়ে শক্ত দাঁত লিম্পেট তথা সমুদ্র-শামুকের দাঁত, শ্যাওলা খেতেই তার অত দাঁতের ঝকমারি!
দাঁতের আমি দাঁতের তুমি
মানুষের দাঁত কোলাজেন আর ক্যালসিয়ামের যৌগ, হাড়ের মতো তার নিজেকে সারিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই। মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী পেশি তার কামড়াবার পেশি, ভাববেন না পরনিন্দা বা ব্যাকবাইটিংয়ের কথা বলছি। শুনেছি, আদিম মানুষ আগুনে পুড়িয়ে খেতে শুরু করার পর থেকে তার দাঁতের ব্যাধির শুরু হয়েছিল। যে জাত কড়মড়িয়ে চিবিয়ে সি-ফুড বেশি খায়, তার দাঁতের রোগ এক রকম; যে জাত পানের খিলি দিয়ে আপ্যায়ন করে আর 'সদরঘাটের পানের খিলি' নিয়ে গান লিখে অভ্যস্ত, তার দন্তরোগ আরেক রকম; যে জাত দাঁত দিয়ে বিয়ারের বোতলের ছিপি খোলে, তার দন্তরোগ আরেক রকম।
দাঁতে মিশি মাখবার কথা তো আমরা পড়েছি, পুরোনো নাটক আছেÑনাম 'বিধবার দাঁতে মিশি'। আদি জাপানে মেয়েরা ফেরিক অ্যাসিটেটের সঙ্গে ভিনেগার আর ট্যানিন গুলে একরকম দাঁতে দেবার কালি বানাত, কালো দাঁত নাকি সুন্দর, লোভনীয়, পূর্ণযৌবনার লক্ষণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ওশানিয়া তো বটেই, এই দাঁতে কালি করার চল রয়েছে পেরু আর ইকুয়েডরে। 'দ্য টেইল অব গেঞ্জি' উপন্যাসেও এই প্রথার কথা রয়েছে। কেউ বলে, এতে দন্তক্ষয় রোধ করা যেত; কেউ বলে, এভাবে নিজেকে কুশ্রী বানিয়ে জাপানি মেয়েদের পরকীয়া সম্পর্ক কমিয়ে আনা হতো। অর্থশালী ইংরেজদের দাঁত অতিরিক্ত চিনি সেবনের কারণে কালো হয়ে যেত। চিনি আসত ক্যারিবীয় উপনিবেশ থেকে, দর ছিল চড়া, রাজা-রানিরা এন্তার চিনি খেয়ে দাঁত কালো করছে, অতএব সমর্থ প্রজারাও তাই করত। দাঁত কালো করে নিজেকে বিত্তশালী প্রমাণ করার এ ফ্যাশন টিউডর পিরিয়ডের আগ অবধি চালু ছিল।
শিল্প-সাহিত্যে দাঁত
হাসিমুখের জন্য দাঁত বড় জরুরি। তা সে গোছানো পরিপাটি দাঁতের সারিই হোক, কিংবা গজদাঁত দেখানো দুষ্টু হাসিই হোক না কেন। উঁচ কপালি চিরলদাঁতী পিঙ্গল কেশ, ঘুরবে কন্যা নানান দেশ। বলে গেছেন খনা। দক্ষিণারঞ্জন বলেছেন 'দাঁতবিকটী রাক্ষসী'র কথা। তাতে কি, ব্রিজিত বার্দো– ম্যাডোনা-মিক জ্যাগার কন্যা জর্জিয়া-লরেন হাটন রীতিমতো দাঁতের ফাঁক নিয়েই সর্বজয়ী।
তবে হ্যাঁ, লিওনার্দোর অত নামডাকওয়ালা 'মোনালিসা' কিন্তু দাঁত দেখিয়ে হাসেনি, রুবেন্সের সুজানাও নয়। ও রকম হাসির বেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি 'ইন দ্য গার্ডেন', এঁকেছিলেন উইলিয়াম-এডলফ বুগোরো, ডোবার আইরিস-ঝোপের পাশে বসে একটি মেয়েশিশু মোজা খুলে ফেলছে, তার চুলে আড়াবেণী। মুখে আফোটা হাসি ভারমীরের ছবিতেও প্রচুর। যদিও ডাচ গোল্ডেন এজের শিল্পীরা মানুষের প্রাণখোলা হাসি এঁকেছেন। হাসছে শিশু, হাসছে বোকা চাষা– লক্কাগোছের ছোকরা-বেহালাবাদক-সরাইখানার মাতাল-গ্রাম্য চিকিৎসক-দালাল-অলস দাসী আর বাসনাময় জিপসী নারী। রেমব্রান্টের 'হাসন্ত মানুষকে কে ভুলতে পারে? ফ্রাঞ্জ হলসের তুলিতে শ্রোভটাইডের খুশিয়াল লোকদের?
প্রেয়সীর দাঁত কেমন হবে? কালিদাস বলছেন, সে তন্বী এবং শ্যামা– এই শ্যামাঙ্গী হলেন তিনি, যাঁকে জড়িয়ে ধরলে শীতকালে উষ্ণতা আর গ্রীষ্মে শীতলতা অনুভ'ত হয় (এসি আবিষ্কৃত হয়নি তাই)। সে শিখরিদশনা, সে পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী, অর্থাৎ ডালিমের বীজের মতো আভাময় সরু দাঁত তার, সেই দাঁত শোভিত তেলাকুচাফলের মতো রক্তিম ঠোঁটের ব্র্যাকেটে। আহা, এমন করে কে বা কাহারা সুন্দরের তুলনা দিতে পারে! সংস্কৃতে আছে– 'দন্তরুচি কৌমুদী', অর্থাৎ জোছনার মতো শুভ্র দাঁতের ছটা। এমনিতে তো আমরা বলি, মুক্তোর মতো দাঁত। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একটি গল্প লিখেছিলেন 'দন্তরুচি' নামে, সেখানে লিখেছিলেন—
'বিজ্ঞান ও ডাক্তারী শাস্ত্রের এত উন্নতি হইয়াছে, কিন্তু দাঁতের কোনও ব্যায়াম আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই– ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয়।...প্রেমের সহিত দাঁতের সম্বন্ধ নাই– কোনও কোনও লেখক এরূপ মনে করেন। প্রেম চিবাইয়া খাইবার বস্তু নয়, তাহা মানি। কিন্তু সাধারণত প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে দন্তরুচি-কৌমুদী যে অবহেলার বস্তু নয়, তাহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। শকুন্তলার যদি একটিও দাঁত না থাকিত, অথবা রোমিও যদি সদ্যোজাত শিশুর মতো ফোকলা হইতেন, তাহা হইলে তাঁহাদের প্রেম কত দূর অগ্রসর হইত, তা বিবেচনার বিষয়।'
দাঁত প্রসঙ্গে ব্রাম স্টোকারের 'ড্রাকুলা'কে মনে পড়বেই, মনে পড়বে কার্লোস ফুয়েন্তেসের 'ভ্লাদ'কে, চোখে ভাসবে ড্রাকুলার নামভ'মিকায় ক্রিস্টোফার লীর বড় বড় সবল দাঁত। 'অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড'-এর 'চেশায়ার ক্যাট'কেই বা ভুলি কী করে, যে হাসিটুকু শূন্যে ঝুলিয়ে দিয়ে বাকি শরীরটা নিয়ে মিলিয়ে যেত, সে 'যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে'—
রুপালি-পর্দায় দাঁত
'মুক্তি' সিনেমায় প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা গেছিল তার ভাইয়ের পোষা দাঁতাল হাতিটাকে, প্রায় দশ ফুট লম্বা তার দাঁত, সিনেমায় অমন দাঁতের জৌলুস আর কে কবে দেখাতে পেরেছে বলুন! পর্দায় আফোটা হাসির কথা যদি বলি, বলব 'দ্য ওয়াইল্ড ওয়ান'-এর শেষ দৃশ্যে মার্লন ব্রান্ডোর অম্লান হাসির কথা। আর বলব, 'তোমার দেহের ভঙ্গিমাটি যেন বাঁকা সাপ' গাইতে গাইতে স্কেচ শেষ করে উত্তমকুমারের সেই চোখ নাচিয়ে দাঁত মেলে হাসিটুকুর কথা। যেকোনো সিনেমায় প্রেম টের পেয়ে সুচিত্রা সেনের সেই দীর্ঘশ্বাসসমেত হাসি। 'সাড়ে চুয়াত্তর' সিনেমায় 'আমার এ যৌবন চম্পাচামেলি বনে অকারণ উচ্ছল দিন গো' গানে মেসের ভাড়াটেদের (যারা আদতে বাংলা গানের ইতিহাসের জায়েন্ট) সেই আকর্ণবিস্তৃত হাসি। মাতাল করা হাসি মেরিলিন মনরোর, তেমনি সুন্দর দাঁতের পাটি। পর্দায় স্বর্ণযুগের নায়ক-নায়িকা প্রত্যেকেরই হাসি অত্যন্ত শক্তিশালী। গ্রেটা গার্বোর মুভি পারসোনা ছিল বরফজাদী-মার্কা, শীতল, বিষণ্ন, রহস্যময়। 'নিনোচকা' মুভিতে তিনি হেসে ফেলেছিলেন, সিনেমার পোস্টারে লেখা হয়েছিল– 'গার্বোও হাসে'। 'সিটি লাইটস'-এর শেষ ক্লোজ আপে অন্ধ ফুলওয়ালির দিকে চেয়ে চার্লি চ্যাপলিন যে কান্নাভেজা হাসিটি হাসেন, কে ভুলতে পারে! 'গন উইথ দ্য উইন্ড'-এ রেট বাটলার-রূপী ক্লার্ক গেবলের সেই প্রেম-যাতনা-বিরক্তি-টান-বিদ্রুপ মেশা হাসি? 'নটিং হীল'-এ সর্বসমক্ষে প্রেমের প্রস্তাব স্বীকার করে জুলিয়া রবার্টসের হাসি-কান্নায় ভেসে যাওয়া নিঃশব্দ হাসি। হাসির পেছনে অবশ্য মেরামতি আছে। ঐশ্বর্য রাইয়ের হাসিটি ভুবনজয়ী করতে শুনেছি তার মাড়ির মাংসে সার্জারি করা হয়েছিল। দাঁত বন্ধ করে হাসলে তাঁর মাড়ির উঁচু ভাবটুকু চোখে পড়বে না বরং চোখে হাসির ঝলক দেখা যাবেÑশাবানা আজমীকে এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন কেউ, মেনে নিয়েছিলেন তিনি।
স্পিলবার্গের 'শিন্ডলার্স লিস্ট'-এর সেই দৃশ্য কখনো ভোলার নয়– কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ইহুদীরা অস্কার শিন্ডলার তাদের জীবন বাঁচিয়েছে বলে তাকে একটি উপহার দেবে বলে ঠিক করেছে, সাঁড়াশি দিয়ে মাড়ির সোনার দাঁত তুলে নিয়ে সেটা গলিয়ে একটা আংটি। একই ডিরেক্টর স্পিলবার্গ আবার 'টেম্পল অব ডুম'-এ 'আগলি ইন্ডিয়ান'-এর দেঁতো হাসি দেখাতে কসুর করেননি।
ধর্ম, রাজনীতি আর দাঁত
প্রহার আর নির্যাতনে কাতর মহানবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর দাঁত হারিয়েছিলেন তায়েফের ধূলিতে, চারটি দাঁত হারিয়েছিলেন ওহুদের ময়দানে কুঠারের আঘাতে– এ চারটির একটি দাঁত রক্ষিত ছিল তোপকাপি প্রাসাদে, আরেকটি ছিল সম্রাট মাহমুদের (দ্বিতীয়) কাছে। অষ্টাদশ শতক থেকে তাঁর নিদর্শন-রক্ষার প্রচলন কমে আসে।
ভাগবত পুরাণে কেশী নামের এক রাক্ষসের কথা আছে, কৃষ্ণকে মারতে ঘোড়ার বেশে সে গোকুলে এসেছিল– যে সে ঘোড়া নয়, সেই ঘোড়া চিন্তার গতিতে দৌড়ায়, সিংহের গর্জনের মতো তার হ্রেষা। কেশী কৃষ্ণকে কামড়াতে এলে কৃষ্ণ তাঁর বাঁ হাত ঘোড়ার মুখের ভেতর ঠেলে দিতেই কেশীর সব দাঁত পড়ে যায়, সেই হাত আরও প্রসারিত হতে থাকে, কেশীকে মেরে তিনি কেশব নাম ধারণ করেন।
ভগবান বুদ্ধের দাঁত রক্ষিত আছে গান্ধার এবং শ্রীলঙ্কার স্তূপাগুলোয়। ১৯৯৮ সালে শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে এমনি একটি দন্ত-মন্দির সহিংস আক্রমণের শিকার হয়। ভক্ত খ্রিষ্টান বিশ্বাস করে যিশু সশরীরে স্বর্গে গেছেন, তবে যিশুর ৯ বছর বয়সে পড়া দুধদাঁত কোথাও সংরক্ষিত আছে। সকল ধর্মেই এসব স্মৃতি-অবশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রেরিত পুরুষেরা নশ্বর মানুষ, কিন্তু তাদের নিদর্শন ভক্তের হৃদয়ে অবিনশ্বর।
ষোড়শ শতকের রানি প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন সাংঘাতিক চিনিখোর, প্রতি বেলার খাবারে প্রচুর মিষ্টিজাত খাবার খেতেন– দুধ-চিনিতে ফেটানো মদ দিয়ে তৈরি সিলাবাব, আমন্ড বাদামের মার্জিপান। তখনকার ইংরেজরা বিশ্বাস করত, চিনি দাঁত সাফ করে। লোকে বলে, ষাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রানির সব দাঁত পড়ে গেছিল, পচন ধরে গেছিল মাড়িতেও। এক জার্মান ভ'পর্যটক লিখেছিলেন, 'রানির মুখের আড়া শীর্ণ, চোখ কুতকুতে- কালো অথচ সুন্দর, নাক টিয়েপাখির মতো বাঁকা, দাঁত চিনি খেয়ে খেয়ে কালো, নকল দাঁতের পাটি পরা মুখ।'
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন সারা জীবন দাঁতের কষ্টে ভুগেছিলেন। ২৪ বছর বয়স থেকে দাঁত তুলতে শুরু করেন তিনি, ডেন্টিস্ট ডক্টর ওয়াটসনকে ৫ শিলিং দিয়ে তোলেন প্রথম দাঁতটি। ৫৭ বছর বয়সে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট হন, তখন নাকি তাঁর একখানা মাত্র দাঁত নিজের ছিল, দুষ্টলোকে বলে বাকিগুলো কাঠের দাঁত ছিল। আসলে কাঠ নয়, তার নকল দাঁত তৈরি হতো গজদন্ত অর্থাৎ হাতির দাঁত, গরু-ঘোড়া এমনকি ওয়ালরাসের দাঁত থেকে। শুধু কী তা-ই? তিনি নাকি তখনকার দিনে ১২২ শিলিং দিয়ে তার ক্রীতদাসদের কাছ থেকে দাঁত কিনে তার জন্য নকল দাঁতের পাটি বানিয়েছিলেন। নকল দাঁতের পাটি তৈরিতে সাহায্য হতে পারে ভেবে ডেস্কের লকারের ভেতর নিজের পড়ে যাওয়া দাঁতও জমিয়ে রাখতেন। তামা-কাঁসা-রুপার তৈরি নকল দাঁতও পরতেন তিনি। কেউ বলে, দাঁতে আখরোট ভেঙে খাবার অভ্যেসের জন্য এমন হয়েছিল। ইতিহাসবিদেরা বলছেন, গুটিবসন্তের চিকিৎসায় ব্যবহৃত মার্কারির ক্লোরাইড থেকে তার অত দাঁত পড়ে গিয়েছিল।
'বড়মামা সিরিজ'-এ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'দাঁত মানুষের চেয়েও অপরাধপ্রবণ। সারা জীবনে অনেক পাপ কাজ করে। পাঁঠা চিবোয়, মুরগির ঠ্যাং ভাঙে, মাছের জীবন নাশ করে। দাঁতের সব কাজই হল নাশকতামূলক। একটাও গঠনমূলক কাজের দৃষ্টান্ত নেই। সারা জীবন খিঁচিয়ে গেল, চিবিয়ে গেল, কামড়ে গেল। পাপের বেতন কী? মৃত্যু। তাই মানুষের আগেই তার দাঁত পড়ে।' কে জানে কোন পাপ-পুণ্যপরায়ণতায় রানি প্রথম এলিজাবেথ বা প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের দাঁত পড়েছিল! কেবল মনে হয়, খরিদ করা দাঁতে ক্রীতদাসের হাসি কেমন দেখাত দাসমালিকের চওড়া মুখে?
দাঁতসংক্রান্ত আমার রাগসমূহ
দাঁত নিয়ে লিখতে হবে শোনামাত্র আমার চোখে ভেসে উঠেছিল পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা একটি পোস্টার, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্তচক্ষু-রক্তলোলুপ জিব আর দাঁতালো মুখের ভয়াল ছবি। ক্যাপশন আরও ভয়ংকর– এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের খলনায়ক ফ্রাঙ্কোর এমন একটি রক্তপিপাসু ছবি পাবলো পিকাসো এঁকেছিলেন।
আর ভেসে উঠেছিল বীরাঙ্গনাদের নিদন্ত মুখ, 'তোবড়ানো গাল– ভেঙে যাওয়া বুক', শুধু পাকিস্তানি আর্মির নির্যাতনে ওসব দাঁত হারায়নি, বীরাঙ্গনারা একইভাবে দাঁত হারিয়েছিলেন ফিরে আসবার পরে– দেশগ্রামের আপন মানুষদের প্রহারে। ছোট্ট একটি দেশ আমাদের, বহু মানুষের অস্থি আর স্বস্তি আহুতি দিয়ে গড়া– যেন ভুলে না যাই।
আজন্মস্বাধীন মানুষের প্রশ্নে সিনাত্রার গানের লাইন মনে পড়ছে এখানে– 'ইয়েস, দেয়ার ওয়্যার টাইমস, আই আম শিওর ইউ নিউ/ হোয়েন আই বিট অফ মোর দ্যান আই কুড চিউ।/বাট থ্রু ইট অল, হোয়েন দেয়ার ওয়াজ ডাউট/ আই এইট ইট আপ, অ্যান্ড স্পিট ইট আউট...'
গাছ আর দাঁত
অনেক হলো রক্তপাতের কথা। এবার সবুজে ফিরি। মটকিলা কিংবা আশশ্যাওড়াগাছের (Glycomis pentaphylla) কথা বলি, মেসওয়াক বা পিলুগাছের (Salvadora persica) কথা বলি। বলি আকাশে অক্লান্ত জাফরি কেটে চলা নিমগাছের (Azadirachta indica) কথা, যেমন সবুজ, তেমন তাজা, তেমনি নিমফুলের গন্ধ। নিমের ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে গিয়ে কেউ মনেই করতে পারত না– কে পুঁতেছে সেই গাছটা। পতিত জমিন, পুরোনো দালানের খাঁজ, জমির আল...কোথায় না জন্মায় অযতেœর মটকিলা, দাঁতের সুরক্ষায় অসামান্য তার ভেষজ অবদান। মেসওয়াক গাছ তো এমনকি নোনা জমিনেও জন্মে। টুথব্রাশ কেবল মাজুনি, এরা দাঁতমাজুনি এবং পেস্ট উভয়ই।
পালংশাক-মিষ্টি আলু-গাজর-পার্সলিপাতা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতায় নানান প্রাকৃতিক গুণাগুণ থাকে, যা আমাদের দাঁত ভালো রাখতে সহায়তা করে। ছোট্টবেলায় আমাদের আখ কিনে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো, দাঁতে ছিলে আখ চিবিয়ে খেতেই টের পেতাম সমস্ত মুখের গহŸর ভরে গেছে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন মিষ্টতায়। বিলাতি শিশুদের যেমন দন্তক্ষয়ের ভয়ে লিকোরিশের মূল চিবিয়ে খেতে দিত মায়েরা। শুকিয়ে গুঁড়োনো হোলি ব্যাসিল/তুলসীপাতা দিয়ে দাঁত শাদা করা যেত, জয়তুনের ডাল চিবিয়ে চিবিয়ে মেসওয়াক তৈরি করে নিতে হতো।
প্রাচীন চীনে রাজসভায় যাবার আগে লোকে নাকি লবঙ্গ চিবিয়ে রাজসমক্ষে যেত, আর 'সানন্দা'র পাতায় 'রুপ লাগি' কলামে শর্মিলা ঠাকুর পরামর্শ দিতেন নিমন্ত্রণবাড়িতে যাবার আগে এক চাকলা আপেল চিবিয়ে যেতে, তাতে নাকি দাঁতের সারি মুক্তাফলের মতো দেখাবে। সাধে কি আর শক্তি ঔষধালয়ের মথুরবাবুকে বাবা লোকনাথ পরামর্শ দিয়েছিলেন, 'বনে-জঙ্গলে যাও, গাছগাছড়া দিয়ে লোকের সেবা করো!' আমাদের ছোটবেলায় শক্তি ঔষধালয়ের 'দন্তরোগারী' দাঁতের মাজন কেনাবেচা হতে দেখতাম, বিজ্ঞাপনও শুনতাম। পরে ফার্মেসির সামনে থরে-থরে দেখতাম থানভী দন্ত শেফা টুথ পাউডার, ভেতরে হরীতকী-দারুচিনি-লবঙ্গ-কর্পুর-শুঁঠ আর গোলমরিচ। দাঁতের পোকা সারাইয়ের ওষুধ বেচা বেদেনীরা আজও লোকালয়ে ঘোরেফেরে কি না, কে জানে। আল মাহমুদ যেমন বেদেনীকে আলো-আঁধারিতে রিভারবেডে পাওয়া দেবীমূর্তির মতো সুগঠিত দেখেছিলেন। শহরের দাঁতের মতো ঝলসায় কাচের হাইরাইজ, আকাশে এনামেল ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ।