তিন বলে তিন: মন ভালো করতে হ্যাটট্রিকের ভিডিওটা কাজে দেয়
শ্রীলঙ্কার ইনিংস ততক্ষণে বিশাল হয়ে গেছে। ৩০৬ রান স্কোরকার্ডে জমা করে ফেলেছে লঙ্কানরা। ইনিংসের শেষ ওভারটি করতে আসেন তাসকিন আহমেদ। প্রথম দুই বলে ৫ রান খরচা করা ডানহাতি এই পেসার পরের তিন বল দিয়ে ইতিহাসে নিজের নামটি খোদাই করেন নেন।
৫০তম ওভারের তৃতীয় বলে আসেলা গুনারত্নেকে ফেরান তাসকিন। পরের বলে তার শিকার লাকমল। দুই বলে দুই উইকেট পাওয়ার পর হ্যাটট্রিকটা খুব কাছে মনে হচ্ছিল তাসকিনের। বাংলাদেশ পেসারের কাছে মনে হচ্ছিল হয়ে যাবে হ্যাটট্রিক।
শ্রীলঙ্কার শেষ ব্যাটসম্যান নুয়ান প্রদীপকে ফেরাতে ইয়র্কারকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন তাসকিন। ইয়র্কারটা মনের মতো করেই ডেলিভারি দেন তিনি, তাতে উপড়ে যায় নুয়ান প্রদীপের স্টাম্প। বাংলাদেশের পঞ্চম বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিকের মালিক হয়ে যান তাসকিন।
একেবারে শেষে হ্যাটট্রিক হওয়ায় দলের তেমন উপকার না হলেও ২০১৭ সালের সেই অভিজ্ঞতাটা তাসকিনের জন্য স্পেশাল। একজন বোলারের জন্য হ্যাটট্রিক করাটা স্বপ্ন ছোঁয়ার মতো ব্যাপার বলে সেদিন তাসকিনও তুলেছিলেন তৃপ্তির ঢেকুর। তবে বৃষ্টিতে ম্যাচটি ভেসে যাওয়ায় কিছুটা আফসোসই হয়েছিল তার। শ্রীলঙ্কার ইনিংসের পর বৃষ্টির হানায় ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়।
টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে বাংলাদেশের সাতজন বোলার হ্যাটট্রিক করেছেন। হ্যাটট্রিকের নায়কদের নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজনের সপ্তম ও শেষ পর্বে আজ থাকছেন তাসকিন আহমেদ। হ্যাটট্রিকসহ সেই ম্যাচের অনেক কিছু নিয়েই কথা বলেছেন বাংলাদেশের এই গতি তারকা। তার মুখেই শোনা যাক সে গল্প।
তাসকিন আহমেদ: হ্যাটট্রিকের অনুভূতিটা পুরোপুরি অন্যরকম। কারণ হ্যাটট্রিক তো হ্যাটট্রিকই। সব বোলারেরই ইচ্ছা থাকে হ্যাটট্রিক, ৫ উইকেট নেওয়ার। বিশেষ করে হাটট্রিক নিয়ে বোলারদের মধ্যে আলাদা একটা ইচ্ছা কাজ করে যে, আমি হ্যাটট্রিক করব। এরআগেও অনেক হ্যাটট্রিক করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কিন্তু হয়নি।
ওইদিন দুই বলে দুই উইকেট পাওয়ার পর কেন জানি মন বলছিল, আজ হয়ে যাবে। তৃতীয় ডেলিভারিটা আমি ইয়র্কার দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তো ইয়ার্কার যেভাবে দিতে চেয়েছি, সেভাবেই হয়েছে। এ কারণেই হ্যাটট্রিক হয়ে যায়।
হ্যাটট্রিকের পর দলের সবাই বাহবা দিয়েছে। আরও বেশি স্পেশাল হতো, যদি শুরুর দিকে হ্যাটট্রিকটা হতো। তবু হ্যাটট্রিক তো হ্যাটট্রিকই। আমি যখন ওই ওভারটা করি, মিড অফে সৌম্য ছিল। ও বলছিল 'কর আল্লাহর নামে, হয়ে যেতে পারে।'
হ্যাটট্রিক বলটা করার জন্য যখন দৌড় শুরু করি, ওই দৃশ্যটা বেশি মনে পড়ে। ওই ডেলিভারিটা করার আগে কেউ তেমন বুদ্ধি দেয়নি আমাকে। ওটা ৫০তম ওভার ছিল। আমি আমার বুদ্ধিতেই বোলিং করছিলাম। আমার পরিকল্পনাই কাজে লেগে গিয়েছিল।
ম্যাচটা না হওয়ায় সেদিন একটু আফসোস হয়েছিল। পরে আর আফসোস হয়নি। মনে হয়েছে আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্য করেন। ওইদিন আফসোস লাগছিল এটা ভেবে যে, ম্যাচটা হলে হয়তো জিততে পারতাম আমরা। ব্যাটিং উইকেট ছিল, ৩০০ রানের (৩১২) মতো লক্ষ্য ছিল। কারণ ওই মাঠে ৩০০ রান তেমন কোনো রান নয়।
হ্যাটট্রিকের ভিডিওটা মাঝেমধ্যে দেখা হয়। পুরনো স্মৃতি মনে পড়লে ৫ উইকেট, হ্যাটট্রিক বা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ, এসব দেখা হয়। কিছু কিছু স্পেশাল মুহূর্ত নিজের মন ভালো করার ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখি। মন ভালো করতে এসব কাজে দেয়। পুরনো কিছু বিশেষ মুহূর্ত দেখি যে, এমন ভালো মুহূর্ত হওয়া সম্ভব।
হ্যাটট্রিকের কথা মনে পড়লে অবশ্যই গর্ব হয়। সেটা ম্যাচের কোন সময়ে বা কার বিপক্ষে হয়েছে, তা বড় ব্যাপার নয়। কারণ আন্তর্জাতিক একটা হ্যাটট্রিক আজীবন রেকর্ডে লেখা থাকবে। কখনই এটা মুছবে না। এদিক থেকে অবশ্যই গর্বের।
আমি আরও হ্যাটট্রিক করতে চাই আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া ক্রিকেটে। এই ব্যাপারগুলো প্রাপ্তি। হ্যাটট্রিক বা ৫ উইকেট নেওয়া বড় প্রাপ্তি। এসব যখন ক্যারিয়ারে যুক্ত হয়, শান্তি লাগে। যত বেশি যুক্ত হবে, তত বেশি শান্তি।
গুনারত্নে ও লাকমলকে আউট করার পর আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল হয়ে যাবে। কারণ যেটা করতে চাচ্ছিলাম, সেদিন সেটা ভালোভাবে প্রয়োগ করতে পারছিলাম। হ্যাটট্রিক বলটার প্রতিও বিশ্বাস ছিল যে, ইয়র্কার করি, হয়ে যেতে পারে।
একজন বোলারের কাছে একটা হ্যাটট্রিক অনেক বেশি তৃপ্তির। ৫ উইকেট, হ্যাটট্রিক দুটিই অনেক স্পেশাল। কিন্তু দুটির অনুভূতি দুই রকম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক ছোট ব্যাপার না। কারণ তিনজন ব্যাটসম্যানকে পরপর আউট করার ব্যাপার এটা। এদিক থেকে হ্যাটট্রিক একজন বোলারের কাছে বিশেষ কিছু।
আমি আগেও যেটা বললাম, আমি আরও হ্যাটট্রিক করতে চাই। যেন হ্যাটট্রিক করে শান্তিটা আরও বেশি উপভোগ করতে পারি নতুন করে। কারণ আমার হ্যাটট্রিকের কয়েক বছর হয়ে গেছে, ২০১৭ সালে করেছিলাম। এটা এখন একটা স্মৃতি। অনেকদিন ধরে এমন আনন্দ পাওয়া হয় না। আবারও এমন আনন্দ পেতে চাই।
৫ উইকেট বা হ্যাটট্রিক আপনি যেখানে, যার বিপক্ষেই পান না কেন; এটা আপনাকে স্বস্তি, শান্তি দেবে। এমন হলে সেদিন স্বস্তির একটা ঘুম হয়, ভালো লাগে। কারণ পরিশ্রম করা তো এমন ভালো খেলার জন্যই। যখন হ্যাটট্রিক হতে দেখতাম, মনে হতো আমিও যদি করতে পারতাম।
আল্লাহর রহমতে আমিও একটা করতে পেরেছি। ওটা শেষ ওভারে হয়েছে। চেষ্টা থাকবে যেন প্রথম স্পেলে হ্যাটট্রিক করতে পারি। এমন ইচ্ছা অবশ্যই আছে আমার। তাতে হ্যাটট্রিক করার আসল স্বাদটা পাওয়া যাবে। কারণ হ্যাটট্রিক সব সময় হয় না। সেটাই যদি আপনি ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে করেন, তাহলে আরও বেশি ভালো লাগা কাজ করে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক আমার সেরা তিন পারফরম্যান্সের মধ্যে থাকবে। প্রথমে রাখব আমার অভিষেক ম্যাচের ৫ উইকেট (২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ৫/২৮)। দুই নম্বরে রাখব ইংল্যান্ডের বিপক্ষের ৩ উইকেট (২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩/৪৭)। ওই ম্যাচে বেয়ারস্টো, বাটলার ও ওকসকে আউট করেছিলাম। আর তিন নম্বরে আমি হ্যাটট্রিকটা রাখব।