বিশ্ব জয়ের নায়কদের মুখে বাবা-মায়ের গল্প
বিশ্ব জয়ের নায়ক তারা। তাদের হাত ধরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে ইতিহাস লিখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই বিশ্ব জয়ীরা এখনও বাবা-মায়ের কাছে ছোট্ট সন্তান। বয়সও যে তেমনই, কারও বয়স ২০ ছাড়ায়নি। এই বয়সের সন্তান বিশ্ব জয় করে এলে বাবা-মায়ের খুশির সীমা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। আকবর আলী, মাহমুদুল হাসান, শাহাদাত হোসাইনদের বাবা-মায়েরও একই অবস্থা হয়েছে।
সোনার ছেলেকে কোলে ফিরে পেয়ে কথা বলতে পারেননি যুব ক্রিকেটারদের বাবা-মায়েরা। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে আনন্দের কান্না কেঁদেছেন তারা। ফেরার পর বাড়িতে কেমন উদযাপন হয়েছে, বাবা-মায়েরা কী বলেছেন; এসব নিয়ে দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথমবারের মতো দেশকে বিশ্বকাপ এনে দেয়া বাংলাদেশের যুবারা।
আকবর আলী: ফাইনালি বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছানোর অনুভূতিটা আসলে অন্যরকম ছিল। তবে বাসায় বিশেষ কোনো আয়োজন পাইনি। দেড় মাস পরে ফিরেছি বলে সবাই আনন্দিত ছিল। যদিও বাইরে অন্যরকম অবস্থা ছিল। আমরা বিশ্বকাপ জিতেছি, মা অনেক বেশি খুশি হয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার পর মা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। বলছিলেন, ‘বিশ্বকাপ জিতে এসেছ বাবা, আমি অনেক খুশি হয়েছি।’ বাবাও অনেক বেশি খুশি।
অভিষেক দাস: আমি এয়ারপোর্টে নেমেই মাকে দেখতে পাই। মা এয়ারপোর্টে ছিল। সত্যি কথা বলতে ওই সময়ের অনুভূতিটা বলে বোঝানোর মতো না। খুবই ভালো লাগছিল যে প্রথমেই মায়ের সাথে দেখা হলো। দেখেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মা বলছিল, ‘দেশের জন্য কিছু করে আসতে পেরেছ, এটা খুব ভালো লাগছে।’ বিশ্বকাপ জয়ে আমারও কিছু অবদান ছিল বলে মা খুবই খুশি।
বাবা তো সব সময়ই আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। আমাকে দেখার পর বাবা কান্না করে দিয়েছেন। বাবারও একই কথা। অনেক বেশি খুশি হয়েছেন উনি। আমার পরিবারের সবাই অনেক খুশি। কারণ ক্রিকেটের জন্য আমার পরিবারের সবাই আমাকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন।
মাহমুদুল হাসান জয়: লম্বা সফরের পর বাড়ি পৌঁছানো দারুণ অনুভূতি। আব্বু-আম্মু অনেক বেশি খুশি। বাড়ির সবাই অনেক খুশি। বাড়িতে যাওয়ার অন্য রকম এক তৃপ্তি কাজ করছিল। আসলে বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে কথা বলা হয়নি তেমন। উনারাও কথা বলতে পারেননি। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন আব্বু-আম্মু। আমাকে জড়িয়ে ধরে উনারা কান্না করে দেন।
পারভেজ হোসেন ইমন: আমি ঢাকাতেই মাকে দেখি। মা ঢাকাতেই ছিলেন। শিরোপা জিতে দেশে ফিরে মাকে দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এত বড় জিনিস নিয়ে আসতে পেরেছি, এসেই মাকে দেখাতে পেরেছি; এটা অনেক ভালো তৃপ্তি দিয়েছে, শান্তি লেগেছে। মা বলছিলেন, উনি অনেক খুশি। টিভিতে আমাদের খেলা দেখেছেন।
এর আগেও মা আমার খেলা দেখেছেন, কিন্তু আমি তেমন পারফরম্যান্স করতে পারিনি। এবার মা অনেক বেশি খুশি। বাবা শুধু নামাজ পড়েছেন, জিকির করেছেন এবং খেলা দেখেছেন। বাবা মোনাজাত করে অনেক দোয়া করেছেন আমাদের সবার জন্য। বাবাও প্রচন্ড খুশি হয়েছেন।
প্রান্তিক নওরোজ নাবিল: মায়ের কাছে পৌঁছে অনেক বেশি ভালো লাগছিল। আব্বু-আম্মু আসলে কিছু বলেননি, আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছেন। আমি কাউকে জানিয়ে যাইনি বাড়িতে। আমাকে এয়ারপোর্ট অভ্যর্থনা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু আব্বু-আম্মুকে সারপ্রাইজ দিব বলে মিডিয়ার কাউকে জানাইনি। তো বাসার দরজা খোলার পরে আমাকে দেখে আব্বু-আম্মু হা করে ছিলেন। এরপর জড়িয়ে ধরে আমাকে চুমা দেন, আদর করেন।
রকিবুল হাসান: বাড়ি ফেরার মজাটা অন্যরকম। আমি বাড়ির নিচে গিয়ে দেখি আমার কাজিন, ভাই-বোন, আব্বু-আম্মু ফুলের মালা, মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়ি থেকে নামার পরে ফুল দিল, মিষ্টি খাওয়ালো। এরপর আম্মু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। আব্বুও কান্না করে দেন। আব্বু-আম্মুর কান্না দেখে আবেগে আমিও কেঁদে দিয়েছি। এটার অনুভূতি সত্যিই বলে বোঝানো কঠিন।
আম্মু বলছিলেন, ‘বাবা খুবই ভালো খেলেছ। তোমার খেলা যখন হয়েছে, আমি জায়নামাজ থেকে উঠিনি। আর যখন উইকেট পড়ছিল, আমি কাঁদছিলাম।’ পরে আমি আম্মুকে বলি দেখ, যা হয় ভালোর জন্য হয়। আমাদের জন্য আল্লাহ শেষে ভালো রেখেছিলেন। বাবা কপালে চুমু দিয়ে বলছিলেন, ‘বাবা খুব ভালো খেলেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি। ভবিষ্যতে বড় বিশ্বকাপ তুমি নিয়ে আসবে, এটাই দোয়া করি।’
শাহিন আলম: আমার থেকে বাবা-মায়ের অনুভূতিটা বেশি অন্যরকম ছিল। আমার বাবা-মা কখনও ভাবেননি ছেলে এমন একটা কিছু করবে। গ্রামের মানুষ এতটা ভালোবাসবে বা সংবর্ধনা দেবে, এটা তারা ভাবতে পারেননি। যে কারণে তারা প্রচন্ড খুশি। আমার বাবা-মা এতটাই খুশি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। বাড়ি যাওয়ার পরে বাবা-মা বেশি কিছু বলতে পারেননি। খুশিতে তারা কান্না করে দেন।
আমি অনেক নিম্ন পরিবারের সন্তান, বাবা-মা কখনও এতটা ভাবেননি। তারা আমাকে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন যে, বড় হয়ে আমি কী করব। আমি একটা পর্যায়ে আসতে পেরেছি বলে তারা অনেক বেশি খুশি।
শাহাদাত হোসাইন: আমার তো বাবা নেই, আম্মুর কাছে এসেছি। অনেক ভালো অনুভূতি এটা। ৪০ দিন দেশের বাইরে ছিলাম। মা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। আমিও আবেগী হয়ে পড়ি। তবে নিজেকে শক্ত করে রাখছিলাম। কারণ আম্মু কাঁদছিল। আম্মু আসলে কোনো কথাই বলতে পারেননি। আমাকে ধরেই কাঁদতে শুরু করেন। কথা কম বলেছেন আম্মু, কান্না করেছেন বেশি।
তানজিদ হাসান তামিম: সব শেষে বাড়ি ফেরার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ। কারণ আমার আব্বু-আম্মু এত আনন্দিত যে আমি বাসায় পৌঁছানোর সাথে সাথে তারা কেঁদে ফেলেছেন। বিশ্বকাপ জিতে এসেছি বলে তারা অনেক বেশি গর্বিত। বাবা-মাকে দেখে এতটা আনন্দ লাগছিল যে, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আম্মু সব সময়ই আমাকে সমর্থন দিতেন, ছোট বেলায় আব্বু সমর্থন দিতেন না সেভাবে। আম্মু চুরি করে টাকা দিতেন, চুরি করে একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিতেন।
আম্মুকে বলতাম ব্যাট লাগবে, বল লাগবে। আম্মু সব ম্যানেজ করে দিতেন। এসব মনে করে আম্ম বলছিলেন, ‘ছেলে আমার এত কষ্ট করেছে। এত কষ্ট করে আজ এখানে এসেছে।’ আম্মুর কষ্টটা সার্থক হয়েছে বলে আম্মু অনেক বেশি খুশি। আব্বু এখন আমাকে অনেক সমর্থন দেন। আব্বু অনেক খুশি, গর্বিত। আব্বু আমাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছিলেন, আমি ক্রিকেটার হয়ে গেছি। আব্বু আমাকে একটা কথাই বলেছেন, ‘যেকোনো একটা দিকে সফল হয়েছ। কেবল তোমার শুরু, আরও অনেক পথ বাকি। সেই স্বপ্নের পথে ভালোভাবে এগোতে হবে।’
শরিফুল ইসলাম: বাড়ি ফেরার ওই সময়ে অনেক বেশি ভালো লাগছিল। বলে বোঝানোর উপায় নেই যে কেমন লাগছিল। আমাকে দেখেই আব্বু-আম্মু কান্না করে দিয়েছেন। খুশিতে উনারা কিছু বলতে পারছিলেন না। এয়ারপোর্টে গিয়ে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘বাবা তুমি সুস্থ আছো তো। কতটা খুশি হয়েছি, সেটা বলতে পারছি না।’
শামীম হোসেন: বিশ্বকাপ জেতার পর থেকেই মনে হচ্ছিল কখন বাসায় যাব। এত বেশি এক্সাইটেড ছিলাম। বাড়ির জন্য মন ছুটে গিয়েছিল। বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে অনেক বেশি ভালো লাগছিল, শান্তি লাগছিল। বাড়ি যাওয়ার পর বাবা-মা দুজনই আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। বাবা-মা অনেক বেশি খুশি। কথা বলতে গিয়ে আম্মু কান্না করে দিয়েছেন। অনেকদিন আমাকে দেখেন না তো!
তানজিম হাসান সাকিব: বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার অনুভূতি এক কথায় অসাধারণ। দক্ষিণ আফ্রিকা থাকতে ফোনে কথা হতো। মিস করছিলাম, কারণ ৪০ দিন ছিলাম। বাড়ি যাওয়ার পর আম্মু-আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাকে চুমু দিতে দেন। অনেক শান্তি লাগছিল তখন। ভাবছিলাম অনেক দিন পর মায়ের হাতের রান্না খাব। আসলে আব্বু-আম্মু সেভাবে কথা বলতে পারেননি। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। আমি আসার আগে একজন রিপোর্টারকে আব্বু ইন্টারভিউ দেন, সেখানে আব্বু কান্না করে দেন। আব্বুকে আমি কখনও কান্না করতে দেখিনি।