দেশ ও দেশের ক্রিকেটের সংস্কৃতির কারণে টেস্টে এই দশা; মত বিশেষজ্ঞদের
ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। এই মানের ক্রিকেট খেলে উন্নতি করা যাবে না; এমন ভাবনা থেকে অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন না, এই আলোচনাও নতুন নয়। হতশ্রী ব্যাটিং, চরম বাজে ফিল্ডিংয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর অবশ্য ঘরোয়া ক্রিকেটকেই কেবল কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে না। ভুল থেকে শিখতে না পারা, আত্মসম্মানবোধ নিয়ে সচেতন না থাকা, চোরাগলিতে সাফল্যের সন্ধান, দেশ ও দেশের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির কারণে টেস্টে বাংলাদেশের এই হাল; এমনই অভিমত বিষেজ্ঞদের।
সিলেট টেস্টের উইকেটে দুই দলই ভুগেছে, এরপরও দুজন ব্যাটসম্যানের কল্যাণে পার্থক্য গড়ে বড় ব্যবধানে জেতে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু চট্টগ্রামের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টেস্টের মেজাজে খেলতে পারেননি। উইকেটে সেট হয়েও অনেকে ধৈর্য হারিয়েছেন, দৃষ্টিকটুভাবে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের উইকেট। সমস্যার মূলে কী? তবে কি টেস্ট খেলার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশ দলে? এমন সব বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন প্রবীণ কোচ ও বিকেএসপির সাবেক প্রধান ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম, বিসিবির প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু ও সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল।
নাজমুল আবেদীন ফাহিম
টেস্ট মানসিকতা গড়ে তোলার অভাব
টেস্ট মানসিকতা গড়ে ওঠার ব্যাপার তো আছেই। বাংলাদেশের টেস্টের অবস্থা এতো খারাপ ছিল না। কয়েক বছর আগেও যদি আমরা দেখি, এর চেয়ে ভালো ছিল। প্রয়োগ এর চেয়ে ভালো ছিল। আমাদের ঘরোয়া পরিবেশের কারণে মানসিকভাবে আমরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে টেস্টে। সেটারই প্রতিফলন এটা। এর চেয়ে ভালো আমরা অবশ্যই খেলতে পারি। কিন্তু মানসিকতা বা নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রেখে কিছু একটা অর্জন করার যে ব্যাপারটা, সেটার অভাব। আমরা প্রতিটা ব্যাটসম্যানকে দেখছি কিছুক্ষণ খেলছে, তারপর একটা সময়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছে, আর যুদ্ধ করছে না। পরিশ্রম, কষ্ট করে অর্জন করার যে ব্যাপারটা, টেস্ট ক্রিকেট তো এমনই। সেখানে আমরা নিজেদের ধরে রাখতে পারিনি। ঘুরেফিরে ওই ঘরোয়া ক্রিকেটের কথাই আসে। যে অভ্যস্ততা ঘরোয়া ক্রিকেটে তৈরি হয়, সেটা আমরা তৈরি করতে পারিনি।
দেশ ও দেশের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির প্রভাব
ধৈর্য না ধরতে পারার কারণ আমাদের দেশ এবং ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি। আমরা কিন্তু এখন যেকোনো ক্ষেত্রেই তুলনামূলকভাবে প্রথমে খুঁজি শর্টকাটভাবে কীভাবে পথটা আমি অতিক্রম করতে পারব। পরিশ্রম না করে একটা কিছু পাওয়ার উপায় কী, এটা আমরা খোঁজার চেষ্টা করি। শুধু ক্রিকেট না, সবখানে; এটা দেশের চিত্র, দেশের সংস্কৃতি। এটার একটা প্রভাব তো ক্রিকেটে আসবেই। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমরা প্রত্যেকে শর্টকাট রাস্তা খুঁজি।
প্রস্তুতির অভাব
একটা সময়ে এসে হীনমন্যতা চলে আসে মানুষের মধ্যে। সেটাই হয়তো নিজেকে আর ওই জায়গাটায় রাখে না, যে জায়গাটায় থাকলে একজন মানুষ যুদ্ধ করতে পারে। এটা হয় প্রস্তুতির অভাবে। যখন আমি প্রস্তুতি নিয়ে আসব না, আমি প্রস্তুত না কিন্তু আমি একটা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি, আমাকে সবাই দেখছে, বিপক্ষ দল তো দেখছেই। আশেপাশে মানুষজন দেখছে যে, আমি অপ্রস্তুত, অযোগ্য, যথেষ্ট না; এটা যেকোনো মানুষকেই হীনমন্যতাবোধের মধ্যে ফেলে দেবে। যেকোনো মানুষ নিজেকে ছোট ভাবতে বাধ্য হবে তখন, নিজেকে লকুানোর চেষ্টা করবে, গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করবে।
বোলিং
ব্যাটিংয়ে যেটা হয়, কঠিন সময়, রানের দরকার নেই, টেস্ট ক্রিকেট, ধরে খেলো। বোলিংয়েও সেই জিনিসটা আছে কিন্তু। যখন একটা জুটি হয়ে যাচ্ছে, ধরে খেলো, রান দিও না, টাইট বোলিং করো। আমরা কিন্তু সেটা করিনি। সেট ব্যাটসম্যানকে আমরা আউট করার চেষ্টা করেছি, বলে বলে আউট করার চেষ্টা করেছি। তাতে আমরা তাদেরকে শট খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ওরা শট খেলেছে, রান করেছে। অনেকগুলো মুহূর্ত ছিল, যখন খুব টাইট চিন্তা-ভাবনা করতে হতো যে পরবর্তী ১০ ওভারে ২০ রানের বেশি দিবোই না। এভাবে একটা চাপ তৈরি করার চেষ্টা করবো ব্যাটসম্যানের ওপর। কারণ ব্যাটসম্যান রান করতে চায়, রান করতে না পারলে ব্যাটসম্যানের ইগোতে লাগে। আমরা সেভাবে করতে পারিনি। আমরা সব সময় রান দিয়েই এসেছি। যেটা হয়, একজন ভালো বোলিং করছে, তার পার্টনার খুব টাইট বোলিং করছে; এ ধরনের জিনিস দেখিনি। সব মিলিয়ে এই খেলার যে চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা সব কিছুতেই আমাদের ঘাটতি আছে।
নিবেদনের ঘাটতি (ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার ভিড়ে ব্যতিক্রম তাইজুল)
হ্যাঁ, চাইলেই টেকা যায়। ব্যাপারটা তো এ রকমই। শেষের দিকে এসেও মিরাজ খেললো না? তাইজুল নিজের উইকেটটা বিলিয়েছে। না হলে সে আরও অনেকক্ষণ খেলতে পারতো। খেলতে অসুবিধা নাই তো এই উইকেটে। মাঝে মাঝে কিছু বল দেখেছি দুই একটা জায়গায় পড়লে টার্ন করেছে, বাউন্স নিয়েছে। এ ছাড়া কোনো সমস্যাই ছিল না। চাইলেই থাকা যায়। চাওয়ার জন্য নিজের মধ্যে ভেতরের যে তাগিদ, যেটা আসবে আত্মসম্মানবোধ থেকে। আমরা তো দেখলাম হীনমন্যতা। ওটা আসে আত্মসম্মানবোধ থেকে যে আমি মাথা নিচু করব না। প্রস্তুত না থাকলে এটা হবে না, হঠাৎ করে হওয়ার জিনিস নয় এটা।
গাজী আশরাফ হোসেন লিপু
ভুল থেকে শিখতে না পারা
একটা হচ্ছে আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি। আর হ্যাঁ, প্রস্তুতির জন্য আলাদা করে লঙ্গার ভার্সন খেলতে পারিনি। তবে সিলেট টেস্ট খেলে আমরা আমাদের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের জন্য কী ট্র্যাপ করা হচ্ছে, কোথায় আমরা আউট হচ্ছি, ক্যাচ পড়ার মাশুল আমরা কীভাবে দিলাম সিলেটে। কামিন্দু মেন্ডিসের ক্যাচ পড়ায় কী হয়েছে, আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি। সেই হিসেবে উইকেট বিবেচনায় চট্টগ্রাম টেস্ট স্বস্তির হতে পারতো, উইকেট তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। কিন্তু আমরা ভুলগুলো মেরামত করতে পারলাম না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানরা বল ছেড়ে দিলেই নিজের উইকেট বাঁচাতে পারতো, কিন্তু ধৈর্য হারিয়েছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে অনেকগুলো ইনিংস ছিল বড় হতে পারতো। আবারও ধারাবাহিকভাবে ক্যাচ ফেললাম।
ফরম্যাটের ভিন্নতা
ব্যাটসম্যানদের যে জিনিসটা আমার মনে হয়েছে যে প্রস্তুতির একটা ব্যাপার থাকে একটা ফরম্যাট থেকে আরেকটা ফরম্যাটে যেতে। তবে আমরা কিন্তু আগে থেকেই জানতাম এই সিরিজের ব্যাপারে। এখানে পাঁচ-ছয় জনের বাইরে অন্যদের হয়তো বাকি ফরম্যাটে খেলতে হচ্ছে। ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি থেকে বেরিয়ে আমরা টেস্ট মেজাজে খেলতে পারিনি। এটা ব্যর্থতার বড় কারণ। ব্যাটিংটা উন্নতি করতে পারলে অন্যরকম হতে পারতো। আমাদের দুর্বলতম দিক ছিল ক্যাচিং এরপর দুর্বল ব্যাটিং।
বোলারদের পিঠে লিপুর হাত
আমি মনে করি এই টেস্টে কেউ যদি লড়াই করে থাকে, বোলাররাই করেছে। ফিল্ডিংয়ে তাদের সাপোর্ট দিয়ে আরও ধারালো করতে পারিনি। আমি কেবল বোলারদের পিঠে হাত রাখতে চাই। কারণ, দুর্বল ব্যাটিং, ফিল্ডিংয়ের কারণে আমাদের বিপক্ষে ৫০০ রানের বেশি হয়েছে। ৫০০'র বেশি রান হওয়ার পেছনে অবশ্যই বোলারদের ব্যর্থতা ছিল না। ব্যর্থতার কারণ ঠিক সময়ে আমরা বোলারদের সমর্থন দিতে পারিনি। আমি নির্বাচক হিসেবে বোলারদের পারফরম্যান্সে, বিশেষ করে পেস বোলিংয়ের পারফরম্যান্সকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে চাই। তারা লড়াকু ছিল। সিলেটে দুই ইনিংসেই শুরুতে চাপ সৃষ্টি করেছিল। স্পিন বিভাগ সেভাবে করতে পারেননি। তবে উইকেট নেওয়া এবং সম্ভাবনা তৈরি করা, দুটোই পেসাররা করেছে। তাই সিলেট ও চট্টগ্রামে এতো বাজেভাবে হারার পরও পেস বিভাগ আমাদের অনুপ্রেরণার জায়গা। ফিল্ডিংয়ে উন্নতি করতে হবে, ব্যাটসম্যানরা এগিয়ে এলে ব্যবধান কমে যাবে।
টেস্ট ক্রিকেট খেলার মানসিকতা
আমাদের শুরুর পর থেকে অনেকে খেলেছে। কেউ চলে গেছে, কেউ আবার দলে ঢুকে শিখছে। আবার মুমিনুল, সাকিবদের মতো অভিজ্ঞ আছে। দ্বিতীয় ইনিংসে সবাই বেশ কিছু বল খেলে আউট হয়। সেট হয়ে আউট হলেও বলবো সবাই রান করবে না, এর মধ্য থেকে দুই-তিনজন ভালো মাপের রান করবে। বাকিরা সমর্থন যোগানোর ভূমিকায় থাকে। তবে হ্যাঁ, আউটের ধরনের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আম্পায়ার থেকে দূরে গিয়ে কোনাকুনিভাবে আমাদের যে বারবার আউট করছে, এতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, এটা দ্রুত সারিয়ে তুলতে হবে। যেন বারবার একই জায়গায় ভুল না করি। অ্যানালিস্টরা ক্রিকেটারদের দুর্বল জায়গাগুলো বের করে দিচ্ছে, কিন্তু সেই জায়গাতেই তারা আউট হচ্ছে। হয়তো আলগা শট খেলার ব্যাপারটি ভুল করছে। আমি যদি ছেড়ে দিতে পারি বোলার কিন্তু স্টাম্পের কাছাকাছি বল করবে। তো এসব একবারেই বেসিক জিনিস। এসব খেলোয়াড়দের উপলব্ধি করতে হবে। দ্বিতীয় ইনিংসে আমাদের তিনজন ব্যাটসম্যান, যারা খুবই অভিজ্ঞ, মুমিনুল, সাকিব ও লিটন; এই তিনজনের অভিজ্ঞতার কোনো ঘাটটি নেই। এদের মধ্যে থেকে দুইজনের সেঞ্চুরি করা না পারার মতো হুমকির বোলিং আমার চোখে পড়েনি চট্টগ্রামের উইকেটে।
মোহাম্মদ আশরাফুল
টেস্ট খেলার মানসিকতা ও ঘরোয়া ক্রিকেটের মান
টেস্ট খেলার মানসিকতা তো অবশ্যই হয়নি। আপনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট যদি দেখেন, যারা প্রধান কোচ হিসেবে কাজ করতেন, এক বছর আগেও ৪৫ দিনে তাদের বেতন দিতো ৪০-৪৫ হাজার টাকা। প্রধান কোচকে আপনি এমন একটা দেবেন, তার মানে তো সেই মানসিকতা তৈরি হয়নি। এটা অনেক আগেরই ব্যাপার, যা পরিবর্তন হচ্ছে না। ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই অভ্যাস, সংস্কৃতি আসবে। টেস্ট দলের ম্যাচ ফি বাড়াবেন, প্রধান কোচকে টাকা দেবেন কিন্তু টেস্ট খেলার আগে যে খেলাগুলো খেলে প্রস্তুত হতে হয়, যেটা ভীত; সেখানে যদি গলদ থাকে এমনই হবে। এতো খারাপ খেলবে, তা আশা করিনি। শেষ বছরেই তো ভালো ক্রিকেট খেলেছে, এবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও জিতেছে।
প্রস্তুতির ঘাটতি
তাইজুল অভিজ্ঞ, অনেক দিন ধরে খেলে। এবং তার মধ্যে ওই জিদ এবং মানসিকতা ছিল; তাই টিকতে পেরেছে। বাকিদের মধ্যে যা ছিল না। নিজে থেকে জিদ না করলে, নিজেকে প্রস্তুত না করলে, মানসিকতা তৈরির চেষ্টা না করলে এই পর্যায়ের ক্রিকেটে আপনি টিকতে পারবেন না। আগেই ভয় পেয়ে গেলে সম্ভব হবে না। আমাদের কথাই ধরুন, আমরা যখন টেস্ট ক্রিকেট খেলেছি, আমাদের সময়ে কী সুযোগ ছিল? এখন তো কতো সুযোগ। আমাদের সময়ে কিছুই ছিল না। হয়তো ওদের মতো পারিনি, কিন্তু আমরা তো খারাপ করিনি। এখন যা করে দল, আমরাও তাই করতাম। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স করে সবার নজর কেড়েছি। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে, এটা নিজের আত্মবিশ্বাস, চেষ্টায় হয়েছে।