চার মৌসুমে পাঁচ ম্যানেজারকে বিদায় জানালেন রোনালদো, পরবর্তী কে?
জিনেদিন জিদান, মাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি, মারিজ্জিয়ো সারি, আন্দ্রেয়া পিরলো ও ওলে গুনার সুলশার; গত সাড়ে তিন বছরে তিন ক্লাবে মোট পাঁচজন ম্যানেজারকে বরখাস্ত হতে বা পদত্যাগ করতে দেখেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
এই ঘটনা একবার-দুবার হলে আপনি তাকে কাকতাল বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু টানা চার মৌসুম ধরে ম্যানেজারদের আনাগোনার পুনরাবৃত্তি দেখলে আপনাকে প্রশ্নটি করতেই হবে, তবে কি রোনালদোই সমস্যা?
এই পর্তুগিজ তারকার ম্যাচ জেতার ক্ষমতা কারোরই অজানা নয়। ৩৬ বছর বয়সেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ম্যাচ জেতাচ্ছেন শেষ সময়ে গোল করে। কিন্তু দলের প্রেসিংয়ে সাহায্য না করা, প্রয়োজনের সময় রক্ষণে না ফেরা, বা আক্রমণে সক্রিয় না থাকা রোনালদো কি ম্যানেজারের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিচ্ছেন? না কি রোনালদোর সুবিশাল উপস্থিতি ম্যানেজারদের চাপে ফেলে দিচ্ছে এবং ক্লাবের সংকট সমাধান করাটা কঠিন করে দিচ্ছে?
ক্লাবের হাতে বরখাস্ত হওয়া রোনালদোর সর্বশেষ চার ম্যানেজারের সঙ্গে কী হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে আমরা এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।
মাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি (জুভেন্টাস)
জুভেন্টাস কোচ হিসেবে প্রথম দফায় পাঁচ বছরে পাঁচ বারই লিগ শিরোপা জিতেছেন অ্যালেগ্রি। শিরোপায় ভরা পাঁচ মৌসুমের শুধু শেষ মৌসুমটাতেই রোনালদোকে পেয়েছেন এই ইতালিয়ান।
এদিকে রিয়াল মাদ্রিদকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে এসে সিরি আ'তে ২৮ গোল করে দলকে লিগ জেতানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন রোনালদো। বাইরে থেকে কোচ-খেলোয়াড়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরকার পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে পড়েছিল যে মৌসুম শেষে ক্লাবকে অ্যালেগ্রি আল্টিমেটামই দিয়ে বসেছিলেন, 'হয় সে ক্লাবে থাকবে, অথবা আমি'।
এ বছরের শুরুর দিকে ইতালীয় সংবাদপত্র লা রিপাবলিকা জানিয়েছে, ২০১৮-১৯ মৌসুমের শেষে ক্লাব সভাপতি আন্দ্রেয়া আগনেল্লির সঙ্গে বসেছিলেন অ্যালেগ্রি, এবং রোনালদোকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন।
অ্যালেগ্রি দাবি করেছিলেন, রোনালদোর উপস্থিতি দলের সার্বিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এবং মাঠে রোনালদোকে সব ম্যাচে নামানোর চাপ থাকায় দলের তরুণরা পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না।
অ্যালেগ্রি দাবি করেন, রোনালদোর উপস্থিতি ক্লাবের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার জন্য হানিকর। তবে আগনেল্লি তার কথায় কান দেননি। মৌসুম শেষে সদর দরজা দেখতে হয়েছিল অ্যালেগ্রিকেই।
জুভেন্টাসের ইতিহাসের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়কে (১০০ মিলিয়ন ইউরো) যেমন দর্শকরা প্রতি ম্যাচে দেখতে চাইত, তেমনি ক্লাবও চাইত মাঠে ও মাঠের বাইরে (অর্থনৈতিক খাতে) রোনালদোর কাছ থেকে সর্বোচ্চটা আদায় করে নিতে।
রোনালদোও অ্যালেগ্রির প্রতি তার অসন্তুষ্টি লুকানোর চেষ্টা করেননি। এই ইতালিয়ানের রক্ষণাত্মক কৌশল ও দল নির্বাচন নিয়ে পরবর্তীতে প্রকাশ্যেও সমালোচনা করেছেন তিনি।
মারিজ্জিয়ো সারি (জুভেন্টাস)
অ্যালেগ্রির পর হয়তো একজন পছন্দসই ম্যানেজার জন্য অপেক্ষা করছিলেন রোনালদো। কিন্তু ২০১৯-২০ মৌসুমে তুরিনের বুড়িরা যাকে কোচ হিসেবে আনে, তার সঙ্গে রোনালদোর সম্পর্ক বলতে গেলে কখনোই ভালো ছিল না।
চেলসি থেকে আসা সারিকে কেন চাকরি দেওয়া হয়েছে, প্রথমে তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন রোনালদো।
নভেম্বরে টানা দুই ম্যাচে রোনালদোকে পূর্ণ সময় খেলতে দেননি সারি। সপ্তাহে দ্বিতীয়বার মাঠ থেকে উঠে আসার সময় রোনালদোর মুখে বিরক্তি বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে। বিরক্তি একসময় মুখ ফুটেও বেরিয়ে আসে। মাঠ ছাড়ার সময় সারিকে সামনাসামনি 'হোয়াট দ্য ফা*' বলে চলে যান রোনালদো।
পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলনে সারি জানান, রোনালদো হাঁটুতে হালকা চোট পেয়েছেন বলে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এর কয়েকদিন পরই পর্তুগালের হয়ে পুরোদমে অনুশীলন করতে দেখা যায় তাকে।
মাঠের কৌশল নিয়েও এই দুই জনের মধ্যে দ্বিমত ছিল। রোনালদোকে 'পিচে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে' ঘোষণা দিলেও সারির খেলার ধরনই ঠিক পছন্দ করতেন না এই পর্তুগিজ। এছাড়া, সামনে একমাত্র ফরওয়ার্ড হিসেবে খেলতেও দ্বিধা বোধ করেছিলেন রোনালদো।
সে মৌসুমে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে বিয়াঙ্কোনেরি। রোনালদোর জোড়া গোলের পরও লিওঁর বিপক্ষে হারায় ম্যাচের পরদিনই বরখাস্ত হন সারি।
আন্দ্রেয়া পিরলো (জুভেন্টাস)
জুভের পরবর্তী ম্যানেজারের সঙ্গে রোনালদোর সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন না করেই ক্লাবের দায়িত্ব নেওয়া পিরলোর অধীনে আরও একধাপ নিচে নামে জুভেন্টাসের পারফরম্যান্স।
২০২০-২১ মৌসুমে চতুর্থ স্থানে থেকে লিগ শেষ করে রোনালদোরা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকেও বাদ পড়ে দ্রুতই।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বাদ পড়ার জন্য এবার ম্যানেজারের বদলে দোষারোপ করা হয় রোনালদোকেই। পোর্তোর বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে রোনালদোর পায়ের নিচ দিয়েই চলে গিয়েছিল সার্জিও অলিভিয়েরার জয়সূচক ফ্রিকিকটি।
রোনালদো ও পিরলো দুজনই জুভেন্টাস ছাড়েন মৌসুম শেষে। তাদের প্রস্থানের পর মুখ খুলেন ক্লাবের দীর্ঘদিনের সেবক লিওনার্দো বনুচ্চি।
তিনি বলেন, তাদের জন্য রোনালদোর উপস্থিতি উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি বয়ে এনেছে। কেননা, এ সময়ে ক্লাব ও খেলোয়াড়েরা রোনালদোর উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পরেছিল।
জর্জিয়ো কিয়েলিনি আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, রোনালদো এক বছর আগে চলে গেলে তা ক্লাবের জন্য আরও ভালো হতো।
ওল গুনার সুলশার (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)
সর্বশেষ বরখাস্ত হওয়া ম্যানেজার সুলশারের সঙ্গেও রোনালদোর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল এবং আছে।
মৌসুমের শুরুতে এই পর্তুগিজকে ক্লাবে ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সুলশার। এবং সুলশারকে লেখা রোনালদোর বিদায়ী বার্তাতেও এই নরওয়েজিয়ানের প্রতি তার ভালোবাসা ফুটে উঠেছে।
২২ জানুয়ারি টুইটারে পোস্ট করা এই বিদায়ী বার্তায় রোনালদো লিখেন, "আমি যখন প্রথম ওল্ড ট্রাফোর্ডে আসি তখন সে আমার স্ট্রাইকার ছিল। এবং ম্যান ইউনাইটেডে আবার ফিরে আসার পর তাকে পেয়েছি কোচ হিসেবে।
"সবকিছুর ঊর্ধ্বে, ওলে একজন অসামান্য মানুষ। আমি তার পরবর্তী জীবনের জন্য মঙ্গল কামনা করি।"
কৌশল সাজানোয় কখনোই এতোটা পটু ছিলেন না সুলশার। ক্লাবের সংস্কৃতি ধরে রেখে খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে সর্বোচ্চটা বের করে আনাই ছিল তার মন্ত্র। ক্লাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকায় এবং নিজেকে 'ইউনাইটেডীয়' মূল্যবোধের ধারক-বাহক হিসেবে ফুটিতে তুলতে পারায় তিন বছরে কোনো শিরোপা না জিতেও চাকরিতে বহাল ছিলেন সুলশার।
কিন্তু, এই মৌসুমে রোনালদোর অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছিল সবার। অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ নিতে গিয়ে এবার নুয়েই পরে ওলের তরী।
রোনালদোর অন্তর্ভুক্তি নিয়েও এখন উঠছে প্রশ্ন। একাদশের দুর্বল জায়গাগুলো বাদ দিয়ে যে এক জায়গায় ক্লাব যথেষ্ট শক্তিশালী, আক্রমণভাগ, সেখানে একজন ৩৬ বছর বয়সীকে স্থান দেওয়াটা বেমানানই। রোনালদোকে জায়গা করে দিতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ম্যাসন গ্রিনউড, মার্কাস রাশফোর্ডদের অগ্রগতি। খেলার সময় না পেয়ে জেসে লিংগার্ড ক্লাবই ছেড়ে দিতে চাইছেন।
সুলশারের ব্যর্থতার জন্য ঢালাওভাবে রোনালদো দায়ী করা সম্ভব না। ক্লাবের অব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় অপরিপক্বতার দায়ই এখানে বেশি। কোচ হিসেবে সুলশারের অপরিপক্বতাও ঢাকা সম্ভব না।
তবে বিগত চার ম্যানেজার ও তাদের ক্লাবকে অধ্যয়ন করলে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে, আধুনিক ফুটবলে রোনালদোর মতো একজনকে দলে স্থান দেওয়া ও তার এবং তাকে ঘিরে সবার সব প্রত্যাশাকে পূরণ করা যেকোনো ক্লাবের জন্যই কঠিন হয়ে যায়।
জুভেন্টাস ব্যর্থ হয়েছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানোর জন্য রোনালদোকে দলে ভেড়ানো বিয়াঙ্কোনেরিদের গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের টিকিট কাটতেই বেগ পেতে হয়েছে। রোনালদোর প্রত্যাবর্তনে ক্লাব আবারও ফার্গি যুগে ফিরে যাবে, ইউনাইটেড ভক্তদের এই স্বপ্নও দ্রুত দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে।
ইউনাইটেডের পরবর্তী ম্যানেজার কি পারবেন সব প্রত্যাশা মাথায় নিয়ে ক্লাবকে আবার গুছিয়ে আনতে?