‘পেগাসাস’ সৃষ্টিতে জড়িত ইসরায়েলি কোম্পানিকে রাষ্ট্রের টাকায় কিনেছে আবুধাবি
ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি গোয়েন্দা ভাইরাস 'পেগাসাস।' আর এনএসও গ্রুপকে সেই ২০১৯ সালে রাষ্ট্রের টাকায় কিনে নিয়েছে আবুধাবি। এ কাজে ব্যয় করা হয়েছে আবুধাবির মুবাদালা ক্যাপিটলের তহবিল। ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার বহু আগেই ঘটেছে এমন কাণ্ড। ফাইনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রাইভেট ক্যাপিটাল করেসপন্ডেন্ট কায়ে উইগিংস এবং সাইবার নিরাপত্তা সংবাদদাতা মেহুল শ্রীবাস্তবের লন্ডন থেকে করা প্রতিবেদনে এ তথ্য ফাঁস করে দেন। প্রতিবেদন তৈরিতে তাদের সঙ্গে দুবাই থেকে যোগ দেন সিমন কের এবং ইংল্যান্ড থেকে অ্যান্ড্রু।
'পেগাসাসের' চোরানজরদারি থেকে রক্ষা পায়নি মানবাধিকার কর্মী, ভিন্ন মতাবলম্বী থেকে শুরু করে দুবাইয়ের শাসকের পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী পর্যন্ত ব্যাপক শ্রেণির মানুষ। এদের অনেকেরই ঘটেছে মর্মান্তিক পরিণতি।
'পেগাসাস' নামটি গ্রিক উপকথার পঙ্খিরাজ ঘোড়ার। বীর পারসিয়ুস তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলেন রাক্ষসী মেডুসাকে। মেডুসার মাথায় চুল ছিল না, ছিল হাজার হাজার বিষাক্ত সাপ। মেডুসাকে হত্যা করার পর তার রক্ত থেকেই জন্ম নেয় পেগাসাস। 'পেগাসাস'কে উপজীব্য করে সুখপাঠ্য কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন সত্যজিৎ রায়। গল্পের নায়ক কিশোর তর্পণকে দুঃখ থেকে মুক্তি দেওয়ার ঘটনাকে নিয়ে এ গল্প গড়ে উঠেছে। তাতেই আবির্ভাব ঘটে পেগাসাসের। কিন্তু 'পেগাসাস' শুনলেই আজকাল গ্রিক উপকথার সবচেয়ে পরিচিত প্রাণী, উড়তে সক্ষম পাখাওয়ালা ঘোড়ার কথা আর মনে হয় না। মনে ভেসে ওঠে না সেই অনবদ্য কল্প বিজ্ঞান। বরং রক্তের গন্ধ এবং পেশাদার খুনে বাহিনীর করাল কার্যকলাপই জেঁকে বসে মনে। এর কারণটিও সহজ। স্বেচ্ছা নির্বাসিত সৌদির ভিন্ন মতাবলম্বী জামাল খাসোগির তৎপরতার ওপর নজরদারিতে ব্যবহার হয়েছে 'পেগাসাস।' পরিণামে দেশটির কার্যত বাদশাহর দায়িত্ব পরিচালনাকারী তরুণ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান(এমবিএস)-এর লেলিয়ে দেয়া পেশাদার জল্লাদ বাহিনীর হাতে খুন হন তিনি। পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ইস্তাম্বুলে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে। দূতাবাস চত্বরকে সরাসরি হত্যাকেন্দ্রে পরিণত করার ঘটনা এর আগেও বোধহয় ঘটেনি দুনিয়ায়। 'পেগা
সাস' নিয়ে এরপর থেকেই নানা খবর এসেছে।
মুবাদালা ক্যাপিটল তহবিলে রয়েছে ২৪৩ বিলিয়ন ডলার পুঁজি। বিপুল বিত্তের এ সংস্থার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আন-নাইয়ান। তিন বছর আগে এনএসও কিনতে তিনি বিনিয়োগ করেন এক বিলিয়ন ডলার। এর মধ্য দিয়ে এনএসওতে অন্যতম বৃহত্তম পুঁজি বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠেন তিনি। ঘটনা সম্পর্কে অবহিত, এমন তিন ব্যক্তির দেওয়া তথ্য থেকে উঠে এসেছে এটি। ২০২০ সালের আগস্টে ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আমিরাত শান্তি চুক্তি করে। তার আগেই আমিরাতের সরকারি অর্থ খরচ করে কিনে নেওয়া হয় সাইবার অস্ত্র নির্মাণে জড়িত ইসরায়েলের এই প্রতিষ্ঠানকে।
আবুধাবির অর্থ বিনিয়োগ নিয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেছে মুবাদালা ক্যাপিটেল এবং এনএসও।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সুহৃদ হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বাণিজ্য বিভাগ গত বছর এনএসওকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বলা হয়েছে, বিদেশি সরকারগুলোকে সফটওয়্যার জোগান দিচ্ছে এনএসও। আর এ সফটওয়্যারের বলে বলীয়ান হয়ে সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ এবং দূতাবাস কর্মীদের নির্বিচারে আড়ি পাতার লক্ষ্যে পরিণত করা হচ্ছে। এনএসওর বিরুদ্ধে মামলা করবে (ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মালিক) মেটা। অভিযোগ: হোয়াটসঅ্যাপের দুর্বলতা পুঁজি করে অ্যাপল থেকে তথ্য হাতিয়ে নিতে ব্যবহার হয়েছে এনএসওর গোয়েন্দা সফটওয়্যার।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত গবেষণা গোষ্ঠী সিটিজেন ল্যাবের অভিযোগে বলা হয়েছে, আমিরাতের মানবাধিকারকর্মী আহমেদ মনসুরের তৎপরতার ওপর নজরদারিতে ২০১৬ সালে ব্যবহার হয়েছে এনএসওর গোয়েন্দা সফটওয়্যার।
এদিকে, ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক কামধেনু হিসেবে প্রয়োগ করেছে পেগাসাস। এরই জোরে পারস্য উপসাগরীয় দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে তেলআবিব। বিশ্বের হাটে সেসব ঘটনার গোপন হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। আমেরিকাও একই লক্ষ্য নিয়ে কিনেছিল পেগাসাস। তবে হালে পেগাসাসকে নিষিদ্ধ করার কাজে কাছা দিয়েই নেমেছে। 'গাঙ পেরুলেই পাটনি শালা' তত্ত্বের প্রয়োগ হিসেবেই একে দেখছেন কেউ কেউ।
এছাড়া, আরব দেশগুলোর হাতে 'পেগাসাস' তুলে দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার এক প্রবীণ মন্ত্রী। তিনি বলেন, আরব দেশগুলো যেন ইসরায়েল ও আরবদের অভিন্ন শত্রু ইরানের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করতে পারে তাই ওই সফটওয়্যার তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের সফটওয়্যারের প্রয়োগ নিয়ে মোটেও দুঃখিত নন ইসরায়েলি ওই মন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা ওসব কাজে এটি ব্যবহার করেছেন, তা তারা নিজ দায়িত্বেই করেছেন। এ নিয়ে ইসরায়েলের কোনোই দুঃখবোধ নেই।
এদিকে ওয়াশিংটন থেকে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের স্টেফানি কির্চগেসনারের প্রতিবেদেন ইসরায়েলের আরেক গোয়েন্দা সফটওয়্যার নিয়েও তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হয়। অ্যামাজন অঞ্চলে ক্যান্ডিরু নামের পরজীবী ক্যাটফিশ শ্রেণির খুদে মাছকে নিয়ে গা শিউরে ওঠার মতো লোককাহিনি প্রচলিত আছে। এতে ভিত্তিহীন দাবি করা হয়, পুরুষাঙ্গের মধ্য দিয়ে পুরুষের মূত্রথলিতে ঢোকার সামর্থ্য আছে ক্যান্ডিরুর। সাইবার যুদ্ধে লিপ্ত ইসরায়েলের রহস্যময় আরেক কোম্পানি ঠিক এই 'ক্যান্ডিরু' নামটিই বেছে নিয়েছে। হয়তো লোককাহিনিতে কথিত অনুপ্রবেশ-সক্ষমতা তুলে ধরাই এ নাম পছন্দ করার আসল লক্ষ্য।
'ক্যান্ডিরু' নিয়ে আতঙ্কজনক বার্তা শোনান মন্ট্রিলভিত্তিক ইন্টারনেটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোম্পানি ইসেটের গবেষকরা। ইসেটের মতে, ব্রিটেন ও মধ্যপ্রাচ্যের নামকরা ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে শ্বাসরুদ্ধকর সাইবার হামলার সঙ্গে ইসরায়েলের ক্যান্ডিরুর যোগসাজশের প্রমাণ মিলেছে। 'পেগাসাস' দিয়ে হামলা করে মোবাইল ফোনে। কিন্তু 'ক্যান্ডিরু' করে কম্পিউটারে।
এছাড়া, সিটিজেন ল্যাবের ২০২১-এর জুলাই মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কম্পিউটার ও ফোনে হামলার উপযোগী গোয়েন্দা ভাইরাস বানিয়েছে তেল আবিবভিত্তিক ক্যান্ডিরু । প্রতিবেদনে বলা হয়, কোথা থেকে এ গোয়েন্দা ভাইরাস দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে তা নির্ণয় করা যায় না। মারাত্মক সব অভিযোগ উঠলেও এ পর্যন্ত জবাব দিতে মুখ খোলার প্রয়োজন মনে করেনি ইসরায়েলের রহস্যময় সাইবার কোম্পানি ক্যান্ডিরু।