এস্কোবারকে মারতে ভাড়া করা হয়েছিল ব্রিটিশ মার্সেনারি
কলম্বিয়ার মেডেলিন ড্রাগস কার্টেলের নেতা এবং ইতিহাসের সবচেয়ে বিত্তশালী এক ভিলেনের নাম পাবলো এস্কোবার। ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৩ সালে এস্কোবারকে হত্যার আগ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোকেইন সাম্রাজ্য ছিল এই মেডেলিন ড্রাগস কার্টেল।
এস্কোবারকে বলা হয় সেই সময়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোকেইন উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারক। সেইসঙ্গে তখনকার মাদক জগতের ৮০ শতাংশের যোগান দিতেন এস্কোবার।
আর এই এস্কোবারকে হটিয়ে দিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী কলম্বিয়ান কার্টেল ও সাবেক এসএএস অপারেটিভ পিটার ম্যাকঅ্যালিজকে।
'কিলিং এস্কোবার' নামে এক নতুন ডকুমেন্টারি থেকে জানা যায় মিশনটির পুরো গল্প এবং এর পেছনের ব্যক্তিদের কথা।
ফিল্মমেকার ডেভিড হুইটনি গ্লাসগোতে ১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া ম্যাকঅ্যালিজকে বলেছেন 'একজন জটিল মানুষ, যার ভেতরে অনেক অশান্তি রয়েছে।' ম্যাকঅ্যালিজ বেড়ে উঠেছিলেন স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহরের প্রান্তে অবস্থিত রিড্রি নামক স্থানে। আর ওই শহরের কুখ্যাত কারাগার বার্লিনিতে কেটেছে ম্যাকঅ্যালিজের বাবার জীবন, যিনি একজন কঠোর ও হিংস্র ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত।
সিনেমার ম্যাকঅ্যালিজের বয়স এখন ৭৮ বছর। তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনী আমাকে মানুষ হত্যা করার প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, কিন্তু আমার মারামারি-সংঘাতের সহজাত প্রবৃত্তি গ্লাসগো থেকেই এসেছে।'
ম্যাকঅ্যালিজ আরও জানান, ১৭ বছর বয়সেই তিনি ঘর ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন নিজের আগ্রাসী মনোভাব মেটানোর একটি সুনির্দিষ্ট চ্যানেল খুঁজে নিতে। তিনি প্যারাস্যুট রেজিমেন্টে নাম লেখান এবং এসএএস-এর ২২ নম্বর এলিট রেজিমেন্টের সদস্য হয়ে ওঠেন।
এরপর তিনি যুদ্ধ করেছেন বোর্নিওর ঘন জঙ্গলের হিংস্রতাপূর্ণ পরিবেশে। কিন্তু ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ আর্মি ছেড়ে দেওয়ার আগে একটি সিদ্ধান্ত নেন ম্যাকঅ্যালিজ, যাকে তিনি বলেছেন নিজের জীবনের সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্ত।
জীবনে বহুবার চাকরি বদলেছেন ম্যাকঅ্যালিজ, কারণ তিনি কোথাও 'থিতু' হতে পারতেন না। ফলে হারিয়ে ফেলেন আপন সত্তা। তার ভেতরের আগ্রাসী ভাব যেন আরও বেড়ে যায়, যখন নিজের প্রেমিকাকে যৌন হয়রানির দায়ে জেলে যান।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ম্যাক নিজের মিলিটারি ক্যারিয়ার পুনরুজ্জীবিত করতে চাইলেন। অ্যাঙ্গোলান গৃহযুদ্ধে এবং পরে রডেশিয়াতে (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) ও দক্ষিণ আফ্রিকায় একজন 'মার্সেনারি' বা ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করলেন।
১৯৭৬ সালে অ্যাঙ্গোলাতে ম্যাকের দেখা হয় ডেভ টমকিন্সের সঙ্গে। টমকিন্স যদিও ধরা-বাঁধা কোনো সৈনিক ছিলেন না, কিন্তু তিনি অস্ত্র সরবরাহ এবং এ বিষয়ে নানা চুক্তি করার ব্যাপারে জ্ঞান রাখতেন। তারপর এই জুটির মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব এবং টমকিন্সই ম্যাককে জানান, এস্কোবারকে হত্যার মিশনের কথা।
কলম্বিয়ায় এস্কোবারের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক মাদক ব্যবসায়ী দল ক্যালি কার্টেলে কাজ করতেন হোর্হে সালসিডো। তিনিই এই হত্যা মিশনের সহ-পরিকল্পনাকারী ছিলেন এবং তিনি টমকিন্সকে মিশনের জন্য লোক খুঁজে একটি টিম গঠন করতে বলেন। আর টমকিন্স প্রথম যাকে আহ্বান জানান, তিনি ম্যাকঅ্যালিজ।
ম্যাকের ভাষায়, 'আপনি পাবলো এস্কোবারের মতো লোককে হত্যার দায়িত্ব এমনিই পেয়ে যাবেন না, যদি না আপনার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকে। আমার এস্কোবারকে হত্যার পেছনে কোনো নৈতিক কারণ ছিল না। আমি আসলে একে কখনো হত্যা হিসেবে বিবেচনাই করিনি। বরং এটিকে একটি টার্গেট হিসেবে নিয়েছিলাম।'
ক্যালি কার্টেল এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল, এস্কোবার যখন তার বিলাসবহুল হ্যাসিয়েন্দা নেপলস র্যাঞ্চে যাবেন, তখন তাকে খুন করা সম্ভব।
বন্দুক আর বোমা
বিশাল বড় এস্টেটের মধ্যে ছিল বিচিত্র সব প্রাণী দিয়ে তৈরি চিড়িয়াখানা, পুরনো বিলাসবহুল গাড়ির সংগ্রহ আর একটি ব্যক্তিগত বিমানবন্দর এবং ষাঁড়ের লড়াইয়ের মাঠ।
ম্যাক প্রাথমিকভাবে নিরীক্ষণের জন্য একবার র্যাঞ্চের ওপর দিয়ে বিমানে উড়ে গেলেন; ফিরে গিয়ে বললেন, সম্ভব!
মিশনের প্রস্তুতি চলছিল। টমকিন্স ১২ জন মার্সেনারির সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করলেন, যেখানে ছিলেন তার আগের পরিচিত সহকর্মী এবং অন্য জায়গা থেকে আসা কজন মার্সেনারি।
কাস্টম পার হতে তাদের সাহায্য করেছিলেন হোর্হে সালসিড এবং ক্যালি কার্টেল তাদের থাকা-খাওয়ার খরচ যোগান দিয়েছিল। প্রতি ব্যক্তিকে মাসিক ৫ হাজার ডলার খরচ দেওয়া হতো, তবে টমকিন্স নিজে প্রতিদিন পেতেন ১ হাজার ডলার করে।
সিনেমায় এমন ফুটেজ রয়েছে- যেখানে টিমের সদস্যরা হাজার হাজার ডলার নিয়ে মত্ত হয়ে আছেন। এই ভিডিওগুলো ছিল টমকিন্সের ধারণ করা।
প্রথমে এই টিম ক্যালি শহরে থাকলেও লোকজনের চোখে পড়ার ভয়ে পরে শহরের বাইরের দিকে একটি র্যাঞ্চে চলে যায়, যেখানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র তাদের হাতে আসে।
ম্যাক বলেন, 'এটা ছিল যেন বড়দিনের উৎসবের মতো। সব রকমের অস্ত্র ছিল আমাদের কাছে।'
মার্সেনারিদের এই মিশনের জন্য কঠোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও শুধুমাত্র টমকিন্স ও ম্যাকই জানতেন টার্গেটের পরিচয়। অন্যদের বলে দেওয়ার আগেই দলের এক সদস্যকে বাদ দেওয়া হয় এবং বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়। তিনি তার গল্প এক সংবাদপত্রের কাছে জানালেও অপারেশনের বিস্তারিত তথ্য বা কারও নাম দেননি।
আক্রমণের দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, সদস্যরা ততই জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন, যেন সেখানে অস্ত্র ও বোমাবারুদ নিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারেন।
পরিকল্পনা ছিল- দুটি হেলিকপ্টার নিয়ে তারা হ্যাসিয়েন্দা নেপলস প্রাঙ্গনে উড়ে যাবেন এবং মার্সেনারিরা গুলি করে এস্কোবারের কড়া নিরাপত্তা প্রহরীদের হত্যা করবেন। তারপর তারা মাদক সম্রাট এস্কোবারকে হত্যা করে তার মাথা নিয়ে আসবেন বিজয়ী উপহার হিসেবে।
যখন একজন গুপ্তচরের কাছ থেকে জানলেন, এস্কোবার তার সেই র্যাঞ্চেই রয়েছেন, তারা টার্গেট ঠিক করলেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আক্রমণ করা সম্ভবই হয়নি। কারণ, যে হেলিকপ্টার টমকিন্স ও ম্যাকঅ্যালিজকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, সেটি মেঘ ভেদ করে আন্দেসের ওপর দিয়ে বেশি নিচুতে উড়ে যাওয়ার সময় বিধ্বস্ত হয় এবং পাইলট মারা যান।
ঈশ্বরের নামে শপথ
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় বাকিরা বেঁচে গেলেও ম্যাক পাহাড়ের ভেতর থেকে বের হতে গিয়ে গুরুতর আহত হন। উদ্ধার করার আগ পর্যন্ত তিনদিন অসহনীয় যন্ত্রণায় তিনি সেখানেই পড়ে ছিলেন।
এরপরই এস্কোবারের কানে যায় তাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা এবং তিনি পাহাড়ে লোক পাঠান তাদের খুঁজে বের করতে।
ম্যাক বলেন, 'পাবলোর হাতে পড়লে অবশ্যই আমাকে দীর্ঘ এক যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হতো।'
এর বদলে তিনি পালিয়ে যান এবং পাহাড়ে যন্ত্রনাকাতর অবস্থায় শুয়ে থাকার সময় ঈশ্বরের কাছে যেসব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেগুলো পূরণ করার কথা ভাবেন।
ম্যাক স্বীকার করেন, তিনি ছিলেন একজন নোংরা, নিম্নমানের, দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ এবং উপলব্ধি করেন, নিজেকে বদলাতে হবে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে মোটেও অনুতপ্ত নন তিনি। বরং একজন ভালো বাবা বা স্বামী না হতে পারাকে নিজের ব্যর্থতা ভাবেন।
অবশেষে ৭৮ বছর বয়সে এসে ম্যাকঅ্যালিজ জানান, তিনি শান্তি পেয়েছেন। আর এরই মধ্যে, ১৯৯৩ সালে পাবলো এস্কোবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে গুলিতে নিহত হন।
১২ মার্চ থেকে 'কিলিং এস্কোবার' যুক্তরাজ্যজুড়ে বিভিন্ন সিনেমা হলে দেখানো হচ্ছে।
- সূত্র: বিবিসি