করোনার বিরুদ্ধে লড়াই: অবসর ভেঙে, দিনে ২০ ঘণ্টা খাটছেন এন৯৫ মাস্কের উদ্ভাবক
পিটার সাই অবসর নিয়েছিলেন দুই বছর আগে। কিন্তু এই ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্টকে জীবনে এ সময়ের মতো এত ব্যস্ত দিন কখনোই কাটাতে হয়নি।
মার্চ মাসে করোনাভাইরাস যখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়, খোঁজ পড়ে সাইয়ের। কেননা, ১৯৯৫ সালে তিনিই উদ্ভাবন করেছিলেন অতি প্রয়োজনীয় এন৯৫ মাস্ক। ফিল্টারেশন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারে তৈরি, ব্যবহার শেষে সহজে বিনাশযোগ্য এই মাস্কের পেটেন্টও তারই।
করোনার দাপটে সহসাই এই মাস্কের সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য অতি জরুরি প্রয়োজন হয়ে ওঠে এটি। এ সময় সাইয়ের কাছে একের পর এক ফোনকল আসতে থাকে বিভিন্ন দেশের ল্যাব, কোম্পানি ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে।
জন্মগতভাবে তাইওয়ানের মানুষ ৬৮ বছর বয়সী সাই বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসিতে। তিনি বলেন, 'সবাই এই মাস্কের ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চাচ্ছিল।'
মূলত এই সংকটকালে কী করে আরও বেশি মাস্ক উৎপাদন করা যায় এবং ব্যবহৃত মাস্ক জীবাণুমুক্ত করার কী উপায়- এসব প্রশ্নই বেশি শুনতে হয়েছে তাকে।
এন৯৫ আসলে ঘরে বানানো মাস্ক কিংবা ক্লথ কাভারসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) অন্য বস্তুগুলোর মতো নয়; ভাইরাস শোধনের ক্ষমতা এটিকে বাজারে সবচেয়ে সুরক্ষাদায়ী মাস্কগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিণত করেছে।
এ পরিস্থিতিতে সাই চুপ থাকেননি। নিজ বাড়িতে, যেখানে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে তার বসবাস, সেখানেই একটা অস্থায়ী ল্যাবরেটরি বানিয়ে, সহজে বিশুদ্ধ মাস্ক বানানোর বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেন।
'দিনে প্রায় ২০ ঘণ্টা কাজ করতে শুরু করলাম আমি,' তিনি বলেন, এর বেশিরভাগই স্বেচ্ছাশ্রমের, 'আর তাতে আমি কিছু মনে করিনি।'
বিশুদ্ধতার প্রশ্নে, মানের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে কত সস্তায় ও সহজে ব্যবহৃত মাস্ককে জীবাণুমুক্ত করা যায়, সেই প্রচেষ্টায় দিন-রাত খাটতে থাকেন তিনি। মাস্কগুলোকে নিজে সিদ্ধ করেন, ভাঁপ দেন, ওভেনে শুকান, তারপর মেলে দেন রোদে। তারপর পরীক্ষা করে দেখেন।
বাড়িতে বেশ কয়েকবার এই পরীক্ষা চালানোর পর তিনি একটি ইমার্জেন্সি মেডিকেল রিপোর্ট প্রকাশ করেন; তাতে মানের কোনো তারতম্য না ঘটিয়ে এন৯৫ মাস্ক পরিষ্কার ও পুনঃব্যবহার করার কয়েকটি উপায় বাতলে দেন সাই।
গবেষণা করে তিনি দেখেছেন, ফিল্টারেশন টেকনোলজির কোনো রকম মানহ্রাস না করে, ড্রাই হিট মেথডে, ১৫৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ৬০ মিনিট ধরে এন৯৫ মাস্ককে হিট দিতে হবে। তার এই গবেষণাকে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ।
এপ্রিলে তার প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরও তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন। তার কাছে আসা এ সংক্রান্ত যেকোনো বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের খুঁজতে থাকেন উত্তর।
হোমমেড মাস্কের জন্য অপটিমাল ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের পরামর্শ তিনি ছড়িয়ে দেন। এক্ষেত্রে কার শপ টাওয়েলের মতো ননওভেন ফ্যাব্রিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি।
সাইয়ের সাহায্য পেতে মরিয়া অসংখ্য কোম্পানি ও গবেষক দলের মধ্যে ছিল এন৯৫ মাস্কের বিশুদ্ধকরণ ও পুনঃব্যবহারের ওপর দেশজুড়ে একদল স্বেচ্ছাসেবী বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও ক্লিনিসিয়ান একজোট হয়ে কাজ করে যাওয়া এন৯৫ডিকন গ্রুপ। এ ক্ষেত্রে তারা সবাই সাইকে অদ্বিতীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে গণ্য করেন।
ইউএস এনার্জি ডিপার্টমেন্টের অর্থায়নে পরিচালিত, টেনিসিভিত্তিক ল্যাবরেটরি- ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবও সাইয়ের সাহায্য চেয়েছে। বৃহৎ পরিসরে এন৯৫ মাস্ক উৎপাদনে যাওয়ার উপায় খুঁজছিল ল্যাবটি।
ওই ল্যাবের কার্বন ফাইবার টেকনোলজি ফ্যাসিলিটি'র পরিচালক মার্লিন থিওডর বলেন, 'কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য চাইতেই ড. সাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। আমাদের টিম তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই, তিনি সহসা ল্যাবে এসে হাজির হন, প্রস্তুত করার জন্য।'
সাইয়ের দেখানো পথে, সমস্যা কাটিয়ে ল্যাবটি এখন ঘণ্টায় ৯ হাজার মাস্কের ম্যাটেরিয়াল উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। সাইয়ের ফিল্টারেশন ম্যাটেরিয়াল ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে অন্যদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে ওই ল্যাব।
অন্যদিকে কামিংস ফিল্টারেশন কোম্পানির ফিল্টার মিডিয়া টেকনোলজি অ্যান্ড আইপি'র পরিচালক ক্রিস হোম বলেন, 'ননওভেন ফিল্ডে ড. পিটার সাই একজন অতুলনীয় গবেষক।'
সাই বলেন, 'মানুষের কাজে লাগার এই সুযোগ যদি নিতে পারি, তাহলে সেটি আমার জন্য জীবনের বাকি দিনগুলোতে সুখের স্মৃতি হয়ে থাকবে। আর এ কারণে আমি খুব আনন্দিত।'
সাই যুক্তরাষ্ট্রে আসেন ১৯৮১ সালে, কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ডক্টোরিয়াল ডিগ্রি করতে। তার প্রয়োজন ছিল মাত্র ৯০ ক্রেডিট, কিন্তু জানার আগ্রহ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে ৫০০ ক্রেডিটেরও বেশি সম্পন্ন করেন তিনি। পড়েছেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে ফিজিকস, ম্যাথ... আরও কত কি!
১৯৯২ সালে ইউনিভার্সিটি অব টেনিসির একটি রিসার্চ টিমের প্রধান হিসেবে কাজ করার সময় এন৯৫ মাস্কটি সম্পর্কে ব্রেকথ্রু পান সাই।
ইউনিভার্সিটি অব টেনিসি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মহা কৃষ্ণমূর্তি বলেন, যদিও ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে গেছেন সাই, 'কিন্তু নিজের টেকনোলজির আরও উন্নয়নের উপায় খোঁজার ভাবনা এবং তা নিয়ে কাজ করা তিনি থামাননি। তার পক্ষে থামানো সম্ভবও না। কেননা, এটি যেকোনো অসাধারণ গবেষকেরই গুণ- আপনি কখনোই মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে পারবেন না!'
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট