জীবনের শুরুতে বদমেজাজি ও অনমনীয় বস ছিলেন বিল গেটস, তবু কেন সবার প্রিয় ছিলেন?
ব্যবসায় সাফল্যের জন্য প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব সুযোগ্য হাতেই থাকা উচিৎ, এনিয়ে অমত কেউই হয়তো করবেন না। কিন্তু, আমাদের অধিকাংশেই একজন আদর্শ নেতা বলতে মার্জিত, শান্তিপ্রিয়, নম্র এবং ঝগড়া এড়িয়ে আপোষকামী কোনো ব্যক্তিকে বুঝি।
নিজ অভিজ্ঞতা থেকে এধারণা খণ্ডনে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা দিয়েছেন সিএনবিসির কন্ট্রিবিউটর রেইনার জিটেলম্যান। তিনি বলছেন, আমাদের স্বপ্নে দেখা তেমন আদর্শ বসেরা হয়তো অবশ্যই আছেন, কিন্তু সফলতার শীর্ষে থাকাদের মধ্যে তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। এই দাবি উড়িয়ে দেওয়াও কঠিন, কারণ গত ১০ বছর ধরে বিশ্বের সেরা সব ব্যক্তিত্ব তথা: নানা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, শীর্ষ নির্বাহী, ক্রীড়াবিদ এবং রুপালি পর্দার তারকাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি একথা বলেছেন।
জিটেলম্যানের ভাষ্যে, প্রায় সকলের মধ্যেই একটা ব্যাপারে আমি মিল লক্ষ্য করি। তারা ব্যবসায় অগ্রগতি এবং পরিবর্তনের স্বার্থে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই স্বার্থের সংঘাত তৈরি করে, প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছেন।
উজ্জ্বল উদাহরণ মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী বিল গেটস। সারা পৃথিবীতে আজ তিনি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যুগান্তকারী অবদানের জন্য স্বীকৃত-নন্দিত। তাকে একজন দয়ালু - সৌম্য ব্যক্তিত্ব, নম্রভাষী ও সমাজসেবী বলেই সকলে চেনেন। কিন্তু, আজ থেকে দুই-এক যুগ আগের যুবা গেটস কিন্তু অফিসের বদমেজাজি বড়কর্তার উপাধিই পেতেন কর্মীদের কাছে।
১৯৯৩ সালে বিল গেটসের জীবনী "হার্ড ড্রাইভ: বিল গেটস অ্যান্ড মেকিং অব দ্য মাইক্রোসফট এম্পায়ার" গ্রন্থটি লেখেন জেমস ওয়ালেস ও জিম এরিকসন। সেখানে লেখকদ্বয় জানাচ্ছেন, মধ্যরাতে কর্মীদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়ার মতো ইমেইল পাঠাতেন গেটস। এগুলোর নামই দেওয়া হয়েছিল 'ফ্লেম মেইল'। অধিকাংশ ই-বার্তা থাকতো কড়া সমালোচনা অথবা পরিহাসের সুরে ভরা। সারাদিন খাটাখাটুনির পর বলাই বাহুল্য বসের এমন বার্তায় রাগেক্ষোভে ফেটে পড়া বা চাকরির আতঙ্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন কর্মীরা।
গেটস তার থোরাই পরোয়া করতেন। মাঝেমধ্যে রাত ২টায় দুর্ভাগা কোনো কোনো প্রোগ্রামার তার মেইল পেয়েছেন, এমন রেকর্ডও ছিল। আর বার্তায় থাকা ভাষাও তেমনই।
শুরুটা হতো অনেকটা এভাবে, "ইতিহাসের সবচেয়ে নির্বোধ কোডটি তুমি লিখেছ।" রাতবিরাতে বদমেজাজি বসের এমন বার্তায় কেই বা নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন! বার্তার ধরন সম্পর্কে সেই জীবনী গ্রন্থ সম্পর্কেই জানা গেছে। ওই সূত্রেই জানা যায়, মাইক্রোসফটের তৎকালীন কর্মীরা তাদের দপ্তরকে আগ্রাসী আচরণপূর্ণ একটি পরিবেশ বলেই মানতেন। তাদের কাছে গেটস ছিলেন সবসময় তীব্র কাজের চাপ দেওয়া এবং আরও বেশি উন্নতি দাবি করা এক ব্যক্তিত্ব।
আরেকটি ঘটনা জানা যায় স্ট্যাক এক্সচেঞ্জ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা জোয়েল স্পোলস্কি মারফত। তিনি মাইক্রোসফট এক্সেল প্রোডাক্ট লাইনে পোগ্রামার হিসাবে মাইক্রোসফটে ছিলেন। ২০০৬ সালে লেখা এক ব্লগ পোস্টে তিনি তুলে ধরেন এক্সেলের নানা সক্ষমতা নিয়ে বিল গেটসের করা প্রোডাক্ট রিভ্যিউ এর অভিজ্ঞতা।
স্পোলস্কি বলেন, "ওই বৈঠকে তো কিছু শীর্ষ ব্যবস্থাপক উপস্থিত ছিলেনই। আর এমন একজন ছিলেন যার কাজ ছিল, গেটস কতোবার 'অশ্লীল' গালি দিলেন, তার একটি সঠিক হিসাব রাখা।"
হিসাব রক্ষক কেন দরকার সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। "যার উপস্থাপনার সময় বিল যত কম অশ্লীল গালি দেবেন, বুঝতে হবে সে ততো ভালো কাজ করেছে। ওই বৈঠক চলাকালে বিল তাকে আরও কঠিন থেকে কঠিনতর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন।
কড়া শাসন যখন মঙ্গলজনক:
অতীতে গেটসের বদমেজাজ নিয়ে এই যা নানা মুখরোচক ঘটনার আলোচনা, তা কিন্তু শুধু তার চরিত্রের একদিক বা রাগের দিকটাই তুলে ধরে। অন্যদিকটা হচ্ছে, সম-সাময়িক অন্য যেকোনো উদ্যোক্তার চাইতে গেটস তার কর্মীদের বেশি উদ্দীপ্ত করার জ্ঞান রাখতেন। সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়ে একটি লক্ষ্য অর্জন করার উৎসাহ দিতেন তিনি। সৃজনশীল কাজের জন্য দিতেন স্নেহময় সুযোগ।
এজন্যে স্পোলস্কি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে পরবর্তীকালে জানতে পারেন, "বিল তোমার পরিকল্পিত পণ্য বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করতে চায়নি। তুমি ঠাণ্ডামাথায় চাপের মধ্যেও কাজটি করতে পারবে কিনা- শুধু সেটাই যাচাই করেছে। এজন্য তার সেরা উপায় হচ্ছে, একের পর এক কঠিন প্রশ্ন করে যাওয়া, যাতে শেষমেশ তুমি হার স্বীকার করে মেনে নাও যে তুমি কিছুই জানো না। আর তখন সে তখন বাগে পেয়ে প্রস্তুতি না নেওয়ার দোষে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ উচ্চবাচ্য করবে।"
বর্তমানে জেরক্স সংস্থায় কর্মরত এবং এককালে বিলের কর্মী স্কট ম্যাকগ্রেগর বলেন, গেটস অন্যকে নিজের মধ্য দিয়েই বিচার করতেন। তিনি নিজেই ছিলেন কঠিন চ্যালেঞ্জপ্রেমী। তাই কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করুক সেটাও প্রত্যাশা করতেন।
তিনি গেটসের জীবনীকারকদের জানান, মাইক্রোসফটে এসব ব্যাপারে কোনো সমস্যা হয়নি। "আমরা কে কী করছি, তা নিয়ে যা বিল জানে, সেটা আমরা সকলেই বুঝতে পারতাম। এটাই অনেক পোগ্রামারকে লক্ষ্য অর্জনের অনুপ্রেরণা যোগাতো। তাদের তৈরি পণ্য (সফটওয়্যার) যেন বিল পছন্দ করেন, সেটা নিয়েই চলতো সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা।"
মাইক্রোসফটের প্রথমদিককার এক প্রোগ্রামার স্টিভ উডস জানান, সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপারটা হচ্ছে, কেউ যুক্তি দিয়ে ঠেকাতে পারলে, বিল সঙ্গে সঙ্গে তার মনোভাব পরিবর্তন করতেন। এনিয়ে তিনি হেরে যাওয়া বা লজ্জার ভয় পেতেন না। আর তার এই গুণটি স্টিভকে মুগ্ধ করেছিল।
- সূত্র: সিএনবিসি