জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পঞ্চমবারের চেষ্টায় বিসিএসে সফল হলেন তৃপ্তি
''অনেকেই অবজ্ঞা করে বলতো- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি বলে বিসিএস কৃতকার্য হব না অথবা ভালো কোনো ক্যাডার হতে পারব না। কিন্তু আমি হতাশ হইনি, মানুষের নেতিবাচক কথাগুলোকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছি। হাল না ছেড়ে, চেষ্টা চালিয়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত নিজের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি।''
কথাগুলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৩৮তম ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া শিক্ষিকা আলেয়া জাহান তৃপ্তির। চারবার অকৃতকার্য হয়ে পঞ্চমবার মনের আশা পূরণ হয়েছে তার।
তৃপ্তির বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দাতিয়ারা এলাকায়। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। বাবা আলমগীর ভূইয়া ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আর মা আফরোজা খানম গৃহিনী। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় দায়িত্বটা একটু বেশি ছিল তৃপ্তির। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি ভীষণ মনযোগী তৃপ্তির লক্ষ্য ছিল শিক্ষক হওয়া। পড়ালেখায় বাবা-মা তাকে উৎসাহ দিয়েছেন সবসময়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে অনার্স এবং ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে মাস্টার্স করেন তৃপ্তি। শিক্ষাজীবন শেষ করেই যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে। প্রথমে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংগঠনিক নানা কর্মকাণ্ডেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তিনি। বর্তমানে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঙ্কুর অন্বেষা বিদ্যাপীঠে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
শিক্ষকতা ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ফাঁকেই নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। তৃপ্তি ৩৪, ৩৫, ৩৬ ও ৩৭ তম বিসিএসে অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। মন খারাপ হলেও হাল ছাড়েননি, মনোবল দৃঢ় রেখে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। দিনে কর্মব্যস্ত সময় পার করা তৃপ্তি বিসিএসের পড়াশোনা করেছেন মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকে রাতজেগে পড়াশোনা করেছেন।
শেষমশ কাক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরে সন্তুষ্ট তৃপ্তি বলেন, মেয়েদের পদে পদে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করার কারণে- অনেক কাছের মানুষও আমাকে অবজ্ঞা করেছে। কিন্ত পরিবার আমাকে বরবারই সাহস দিয়েছে।
''চারবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েও অকৃতকার্য হয়েছি। কোনোবারই প্রিলিমিনারি পাস করতে পারিনি। বিসিএসের প্রথম ধাপ পার হতে না পারায় খুব খারাপ লাগতো, কিন্তু মনে জেদ ছিল আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতেই হবে'', বললেন তৃপ্তি।
তৃপ্তি আরও বলেন, আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিকন্যা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুনকে দেখে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আমার ঝোঁক আরও বেড়ে যায়। সেজন্য বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য মনে জেদ চেপে বসে।
''আমি অন্য ছেলে-মেয়ের মতো ভালো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারিনি, কোচিং করারও সুযোগ পাইনি। বিসিএসের জন্য যা কিছু করেছি, সবকিছুই নিজে নিজে। মানুষের নেতিবাচক কথাগুলো আমি সবসময়ই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছি। তবে আমার শিক্ষক ওসমান গণি সজিব আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন'', বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ৩৮ তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরীক্ষার আগে কয়েক মাস সারারাত পড়াশোনা করেছি। দিনের বেলায় সময় পেতাম না বলে রাতজেগে পড়েছি। বাবা-মা চেয়েছিলেন আমি যেন প্রশাসন ক্যাডার হই। কিন্তু আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিল শিক্ষা ক্যাডার।
তৃপ্তি বলেন, যদিও বাবা-মায়ের কথা রাখতে গিয়ে ফরমে প্রথম পছন্দ হিসেবে প্রশাসন ক্যাডার দিয়ে দ্বিতীয় পছন্দ দিয়েছিলাম শিক্ষা ক্যাডার। আমি মনেকরি, প্রশাসনসহ অন্য ক্যাডারের চাকুরেরা তাদের কাজের বাইরে কিছুই করতে পারেন না। কিন্তু একজন শিক্ষক তার মনের সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করে দেশ ও জাতির জন্য কাজে লাগাতে পারেন এবং অনেক মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারেন। মানুষ গড়ার কারিগরের এমন পেশায় যুক্ত হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।
তৃপ্তির বাবা মো. আলমগীর ভূইয়া বলেন, পড়ালেখার প্রতি মেয়ের প্রবল আগ্রহ ছিল সবসময়। আমি নিজে দেখেছি সারারাত জেগে থেকে পড়াশোনা করেছে। অবশেষে কষ্টের ফল পেয়েছে সে। এ জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
তার শিক্ষক ওসমান গণি সজিব বলেন, ভালোভাবে পড়াশোনা করলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও বিসিএস ক্যাডার হতে পারে। প্রতিবারই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বিসিএসে উত্তীর্ণ হচ্ছে। তৃপ্তি ছাত্রী হিসেবে খুবই মেধাবী, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও সমানভাবে পারদর্শী সে। তার এই সাফল্যে শিক্ষক হিসেবে আমি খুবই আনন্দিত।