প্লাস্টিক বৃষ্টি হলো নতুন এসিড বৃষ্টি
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশে আছে মুক্ত, স্বচ্ছ বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বেশকিছু সংরক্ষিত অঞ্চল। নির্মল পরিবেশ, বন্য জীবন, পাহাড়, গিরিখাদ আর প্রকৃতির আশীর্বাদ আগলে রাখে এসব জাতীয় উদ্যান। ছুটিতে প্রকৃতির নির্ভার সঙ্গ নিতে পারেন দেশটির নাগরিকেরা।
জশুয়া ট্রি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, ব্রাইস ক্যানিয়ন নানা নামের এসব উদ্যান- প্রকৃতি সংরক্ষণে মার্কিন সরকার আর নাগরিক সমাজের সম্মিলিত সাফল্যেরও ফসল।
অথচ অদৃশ্য এক ভয়াবহ শত্রু এখন হুমকির মুখে ফেলেছে এদের নির্মল পরিবেশকে। কখনো বাতাসে ভেসে, কখনোবা বৃষ্টির ফোটার সঙ্গে ঝরে- জড়ো হচ্ছে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। পাঁচ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট আণুবীক্ষণিক এ কণাকেই মাইক্রোপ্লাস্টিক নাম দেওয়া হয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত প্লাস্টিকের কাপড় বা পরিবেশ দূষণকারী অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্য ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট এসব কণা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখান থেকেই পানি আর বাতাসের প্রাকৃতিক চক্রের হাত ধরে তা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের নির্মল বন্য এলাকাগুলোয়।
আজ রোববার (৩০ আগস্ট) প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাময়িকী সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে মানবসভ্যতার তৈরি নতুন হুমকিটির ব্যাপারে জানানো হয়। গত ১৪ মাস ধরে বাতাস আর বৃষ্টির পানির নমুনা সংগ্রহের পর, বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেন, ওই সময়ে এক হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি সংরক্ষিত উদ্যানে পড়েছে। যা ১২ কোটি পানির বোতল তৈরিতে ব্যবহার করা প্লাস্টিকের সমান।
গবেষণা প্রবন্ধের মূল লেখক জেনিস ব্রাহনি বলেন, ''আমরা দুঃখিত, শঙ্কিত, ব্যথিত। পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষিত উদ্যানের আয়তন সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ সেখানেই কিনা বছরে এ বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বৃষ্টি হচ্ছে।''
উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রকৃতি বিজ্ঞানী আরো বলেন, ''আমরা সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি এটা আবিষ্কার করে।''
বিজ্ঞানীর কথাগুলো মোটেই বাড়াবাড়ি নয়। বরং বর্তমান গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে; এভাবে হয়তো ইতিমধ্যেই পৃথিবীর দূরতম সব বন্যপ্রান্ত যেমন; ফেঞ্চ পিরেনিজ বা উত্তর মেরুতেও বাস্তুসংস্থানের উপর আঘাত হানা শুরু করেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের বর্ষণ।
প্লাস্টিক পণ্যগুলো সমুদ্রে এসে বছরের পর বছর ধরে স্তূপ হয়ে ভাসে। সেখানেই সমুদ্রস্রোত আর প্রখর সুর্যালোকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা তৈরি হয়। পানি থেকে বাষ্প হয়ে এসব আণুবীক্ষণিক কণা জমছে মেঘমালায়। আবার কখনোবা ক্ষয় হয়ে যাওয়া প্লাস্টিক কণা সামুদ্রিক বাতাসে ভর করে ফিরে আসছে ভূমিতেই।
প্রাকৃতিক দুই চক্র; বৃষ্টি ও বাতাসের মাধ্যমে এভাবেই শুধু পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। বৃষ্টির সঙ্গে প্লাস্টিক ঝরে পড়ার এ ঘটনাকে এযুগের অ্যাসিড বৃষ্টির মতোই মারাত্মক হুমকি বলছেন বিজ্ঞানীরা।
বড় হুমকি কোনটি?:
প্লাস্টিক বৃষ্টি অনেকগুণে ভয়াবহ, অ্যাসিড বৃষ্টির চেয়ে। নিয়ন্ত্রণ করাটাও দুরূহ। মানুষের শিল্প কর্মকাণ্ডের ফলে নির্গত সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডের বায়মন্ডলীয় দ্রবণ –অম্লবৃষ্টির জন্ম দেয়। কিন্তু এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত স্ক্রাবার প্রযুক্তি প্রথমোক্ত দূষণটি অনেকাংশে কমিয়েছে। আর নাইট্রোজেন অক্সাইডের নির্গমন কমেছে গাড়িতে কনভার্টার সংযোজনের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গত কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় অনেকটাই কমেছে অ্যাসিড বৃষ্টির সমস্যা।
মাইক্রোপ্লাস্টিক বর্ষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্তরের হুমকি। ইতোমধ্যেই পৃথিবীর দুর্গমতম অঞ্চলে এটা ছড়িয়ে পড়েছে। আর বাতাস বা পানি থেকে এ দূষণকণা সরিয়ে ফেলার কোনো উপায়ও নেই। বলতে গেলে, পানি চক্রের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর সব মহাসুমুদ্রই হয়ে উঠেছে প্লাস্টিকের আস্ত ভাগাড়। আর সেখান থেকেই আবার বাষ্পীয়করণে মেঘমালায় রূপ নিচ্ছে এটি।
মানুষের হাতে প্লাস্টিক শুষে নেওয়ার মতো কোনো চুম্বকও নেই, যা মহাসমুদ্রের ছোঁয়ালেই তা নিমিষে সব প্লাস্টিক টেনে নেবে। প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় (ব্যবহারিক) গুণ হচ্ছে এর স্থায়িত্ব, আর একারণেই এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিবেশ বিনাশী উপাদান।
প্লাস্টিক কখনোই পুরোপুরি দূর হয়, এর ক্ষুদ্র কণারা সমুদ্রের তলে যেমন জড়ো হচ্ছে, তৈরি করছে নতুন স্তর। তেমনি পানিতে মেশা এ কণার প্রভাব পড়ছে বায়ুমন্ডলের মেঘমালায়। প্রতিমুহূর্তেই আরো ক্ষুদ্র কণায় রূপ নিয়ে ছড়াচ্ছে প্লাস্টিক।
আর মানুষই বা কম কিসে? প্রতিমুহূর্তে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদের বাস্তুসংস্থান বিনাশী ক্ষুধা আর পণ্যের চাহিদা। বাণিজ্যিক পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিনসে বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ আমাদের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ২৬ কোটি টন থেকে বাৎসরিক ৪৬ কোটি টনে উন্নীত হবে। যার পেছনে মূল ভূমিকা রাখবে; অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি। এর সহজ অর্থ আরো পণ্য চাহিদা এবং সেসব পণ্য মোড়কের নতুন আবর্জনা।
কী দেখলেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা:
মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমস্যা পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা জানতেই ১১টি জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত অঞ্চলের বাতাস আর বৃষ্টির পানির নমুনা সংগ্রহ করেন বিজ্ঞানীরা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য বিশেষ একটি বালতি ব্যবহার করা হয়, বাতাসের নমুনা সংগ্রহেও ছিল আলাদা ধরনের বালতি। এগুলো বিশেষ সেন্সর সমৃদ্ধ।
তাই বৃষ্টির সূচনা পেলেই নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যেত বাতাস সংগ্রহ করা পাত্রের মুখ। আবার রৌদ্রজ্জ্বল দিনে বন্ধ থাকতো পানির নমুনা সংগ্রহকারী ধারক (ওয়েট বাকেট)। এভাবে টানা ১৪ মাস প্রতিদিন নমুনা সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ চলে পরীক্ষাগারে।
তাছাড়া, বিজ্ঞানীরা বৃষ্টির পানির নমুনা কোন ঝড়ো মেঘরাশি থেকে এসেছে, তা শনাক্ত করার একটি মডেল তৈরি করতে সক্ষম হন। ওয়েট বাকেটে পানি ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের নমুনা নিয়ে ঝরে পড়ার আগে কয়টি বড় শহরের উপর দিয়ে- মেঘদলটি বয়ে এসেছে তা শনাক্ত করার পদ্ধতিও তারা আবিষ্কার করেন।
এক বছরের বেশি সময় পর বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, সংগ্রহ করা নমুনার ৯৮ শতাংশেই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক কণার সরব অস্তিত্ব রয়েছে। বায়ুমন্ডলের ক্ষুদ্র কণামণ্ডলীর ৪ শতাংশই ছিল সিনথেটিক পলিমারের। তাছাড়া, বৃষ্টির সঙ্গে ঝরে পড়া কণাগুলো আকারে বাতাসে ভেসে আসা সূক্ষ্মকণার চাইতেও বড় ছিল। এব্যাপারে বিজ্ঞানীরা জানান, প্লাস্টিকের সূক্ষ্মকণা বাতাসে বহুদূর ভেসে আসে, এরপর তা আবার নিচের দিকেই ঝরে পড়ে।
বৃষ্টির পানির নমুনায় সিনথেটিক উপাদানের পরিমাণ ছিল ৬৬ শতাংশ এবং বাতাসের ক্ষেত্রে তা ছিল ৭০ শতাংশ। পলেস্টার কাপড় ক্ষয় হয়েই এগুলো পানি ও বাতাসের প্রাকৃতিক চক্রে যোগ হয়েছে।
বিজ্ঞানী ব্রাহনি বলেন, ''প্রতিটি নমুনায় নানা বর্ণের উজ্জ্বল প্লাস্টিক কণাগুলো দেখে আতঙ্কে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো। কারণ আমি জানতাম প্লাস্টিকের সাদা বা বর্ণহীন কণাগুলোকে শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমাদের গবেষণা দলের হাতে নেই। তাই প্রকৃত ভয়াবহতার চাইতে অনেক কমই বলেছি আমরা।
ব্রাহনি ও তার গবেষক দলটি বাতাস-পানির আবহাওয়া চক্রের সাহায্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়ানোর ব্যাখ্যাও দেন। তারা বলছেন, ''বাতাসের তোড়ে কোনো নগর বা শিল্পাঞ্চলের মাইক্রোপ্লাস্টিকের সূক্ষ্মকণা অনেকদূরের পথ পাড়ি দেয় বটে। কিন্তু, মধ্যাকর্ষণের টানে তারা আবার পৃথিবীর বুকেই ফিরে আসে। তবে জলচক্রের ব্যাপারটা ভিন্ন। বৃষ্টি বায়ুমণ্ডলে থাকা সব কণাকে ধুয়েমুছে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনে। মেঘে দ্রবীভূত প্লাস্টিক হোক বা বাতাসের কণা- বৃষ্টিঝর সব ধুয়ে ভূপৃষ্ঠে ফিরিয়ে আনে।''
তাছাড়া, প্লাস্টিকের সূক্ষ্মকণা মেঘের জলকণা আকৃষ্ট করার মতো চুম্বকীয় প্রভাব তৈরি করছে বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে অতি বা অনাবৃষ্টির কারণ অনুসন্ধানে আগামীদিনে যা নতুন ধরনের গবেষণার সূচনাও করবে।
- সূত্র: দ্য অয়ারড