হিন্দুত্ববাদী শক্তির হাতে ভারতে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ: অরুন্ধতী রায়
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ ১৩২ বছর ধরে আয়োজন করছে ক্লার্ক লেকচার। পৃথিবীর নামিদামী লেখক, কবি আর সাহিত্যিক এই বক্তৃতায় অংশ নিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে তাদের সাহিত্য-দর্শন তুলে ধরার সুযোগ পান।
চলতি বছরের ক্লার্ক লেকচারে আমন্ত্রণ জানানো হয় বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় সাহিত্যিক অরুন্ধতী রায়কে। স্পষ্টভাষী অরুন্ধতী তার বক্তৃতায় ভারতে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের যুগে লেখক হিসেবে তার ভূমিকা তুলে ধরেন। লিটহাব-এ প্রকাশিত ওই বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরতেই এ আয়োজন।
ক্লার্ক লেকচারে অরুন্ধতী নামের নক্ষত্র
সাম্প্রতিক সময়ে আমি সাহিত্য নিয়ে বেশ কিছু সংলাপে অংশ নিয়েছি। আলোচনা করেছি সাহিত্যে ভাষার রাজনীতি নিয়ে। এ কারণে ধরে নিচ্ছি উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকেই আমার লেখার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত। আর যদি তা না হন, তাহলে শুরুতেই ক্ষমা চাইছি।
কবরস্থান ও মুসলমান
ভারতের অধিকাংশ গোরস্থানই মুসলমানদের। কারণ মোট জনসংখ্যার মধ্যে খ্রিস্টান খুবই কম। আর হিন্দুসহ অন্যান্য সম্প্রদায় শবদেহ দাহ করে। ‘কবরিস্তান’ তাই ভারতীয় মুসলমানদের শেষ গন্তব্যের সমার্থক শব্দ।
মুসলমানদের অস্তিত্বের ঘোরবিরোধী ভারতীয় উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কবরিস্তান নিয়ে আগ্রহ আর স্বপ্নের শেষ নেই। তাদের মুখে মুখে আজ জনপ্রিয় স্লোগান ‘মুসলমান কা এক হি স্থান, কবরিস্তান ইয়া পাকিস্তান’; তার মানে মুসলমানদের জন্য দুটি জায়গা, হয় পাকিস্তান চলে যাও নইলে হত্যা করে কবরিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ভারতভূমে যবন শ্রেণির অন্য কোনো ঠিকানা থাকতে পারে না, সড়কে উদ্যত তলোয়ার হাতে জঙ্গি মিছিল থেকে এমন রণহুংকার দেওয়া হচ্ছে অহরহ।
হিন্দুত্ববাদী শক্তির হাতে আজ রাষ্ট্রক্ষমতার সকল স্তরের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ। আর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে আছে অনেক পক্ষ। এদের সম্মিলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কটের তীব্রতায় আজ সমাজ স্তরে মুসলমান সম্প্রদায়ের ঠাঁই হয়েছে উচ্ছিষ্টজীবী হিসেবে।
ঘৃণার এই সংস্কৃতি মুসলিমদের অসাম্প্রদায়িক জনসমাগমে অংশ নেওয়ার সুযোগ কেড়ে নিয়েছে, ঘর ছাড়া করেছে আবাসিক মহল্লাগুলো থেকে। অভিজাত মুসলমানরাও এখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হাতেগোনা কিছু নিরাপদ এলাকায় গণ্ডিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এটা স্বেচ্ছা নির্বাসনের শামিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা অবশ্য এসব এলাকাকে ‘মিনি পাকিস্তান’ নামেই ডাকে। মৃত্যুর মতো এখন জীবদ্দশাতেও পৃথক হয়ে থাকাটাই এখন তাদের পরিণতি।
দিল্লির মতো কিছু শহরে ঘরহারা ও ছিন্নমূল মুসলমানদের আশ্রয়স্থল এখন সুফি সন্তদের মাজার আর পুরোনো সব গোরস্থান । যেন মাটির নিচে মৃত আর উপরে জীবিত, দু’দলের কাছে আজ শেষ ঠিকানা কবরিস্তান।
সমাজ থেকে বিতাড়িতদের, জীবিত ও মৃত বাসিন্দাদের বুকে ধারণ করা এই কবরিস্তান তথা আধুনিক ‘ঘেটো’গুলোই আমার আজকের বক্তৃতার মূল বিষয়বস্তু।
আজকের ভারতে কবরিস্তানের ভূমিকা প্রথম আলোচনা করি ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইয়ে। দুই কবরিস্তানের মাঝে সংলাপ ছিল কাহিনির মূল উপজীব্য। একটি কবরিস্তান ছিল দিল্লির। সেখানে আনজুম নামের এক ছেলে বসবাস শুরু করে। তার মতোই নিরাশ্রয় মানুষের জন্য সেখানে ‘জান্নাত’ (স্বর্গ) নামে একটি অতিথিশালা তৈরি করে আনজুম। আর এই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ পেয়ে জান্নাতে আসতে শুরু করলো নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ।
অন্য কবরিস্তানটা একটু দূরে। হিমালয়ের বুকে ছবির মতো সুন্দর ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীর উপত্যকায়। যে উপত্যকা আজ তিন দশকের সংঘাত আর নিপীড়নের জেরে অসংখ্য কবরে ভর্তি হয়ে উঠেছে। আর এভাবে কাশ্মীর বা মর্ত্যের জান্নাত নিজেই হয়ে উঠেছে আরেক কবরিস্তান। নিগৃহণের সমাজ ব্যবস্থায় এক গোরস্থান যখন হয়েছে জান্নাত, তখন আরেক জান্নাতকে বন্দি করা হয়েছে কবরের বেড়াজালে।