১৩৬ বছরের পুরোনো কোম্পানি এখন অন্তিম দশায়
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসার সম্ভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড থমাস শ' এবং চার্লস উইলিয়াম ওয়ালেস মিলে ১৮৮৬ সালে কলকাতায় শ' ওয়ালেস অ্যান্ড কোং লিমিটেড (এসডব্লিউসি) প্রতিষ্ঠা করেন।
শুরুটা সাদামাটা হলেও ১৯৬৪ সাল নাগাদ এটি এজেন্সি হাউজগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে উঠে আসে এবং কলকাতা থেকে যুক্তরাজ্যে চা রপ্তানির পরিমাণে ৯ম স্থানে ছিল- বলে বিভিন্ন প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে।
এই কোম্পানিই ভারতে প্রথম মোটরগাড়ি আমদানি করে। একইসঙ্গে ছিল মার্কনি টেলিগ্রাফ কোম্পানি আর ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজের প্রথম এজেন্ট।
কিছু বর্ণনায় এসডব্লিউসিকে ১৯৩০-৬০ সাল পর্যন্ত সরকারি খাতের বাইরে ভারতের সর্ববৃহৎ সার বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানও বলা হয়েছে।
সহজ অর্থে, কোম্পানিটি ছিল এক সোনার খনি, যাতে অনেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অবসানের পর, বর্তমান ১৩৬ বছরের কোম্পানিটি হাত বদল করে, বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয় এবং ব্যবসায় বৈচিত্র্যও যোগ হয়; তারপরও ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের প্রতীক হিসাবে রয়ে যায়।
কিন্তু, এক শতাব্দীকাল পর বাংলাদেশে কোম্পানিটি এখন নামেমাত্র টিকে আছে, অপেক্ষা করছে আনুষ্ঠানিক অন্ত ঘোষণার।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, চা ও শিপিং ব্যবসার অগ্রণী একটি কোম্পানির এ হাল কীভাবে হলো?
নাম পরিবর্তিত হয়ে এদেশে শ'ওয়ালেস বাংলাদেশ লিমিটেড (এসডব্লিবিএল) নামে পরিচালিত হচ্ছে কোম্পানিটি। এটির গুলশান অফিসে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ছয়জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কাজ করছেন। শুরুতে তারা কেউ কথা না বলতে চাইলেও, এক পর্যায়ে দ্বিধা ভেঙে মুখ খোলেন। আর তাতেই বেড়িয়ে আসে অব্যবস্থাপনা ও মন্দ ভাগ্যের এক করুণ কাহিনি।
শিপিং লাইন আর চা বাগানের ব্যবসা আজ নেই। বর্তমানে চট্টগ্রামে নিলাম থেকে চা কিনে বাজারে বিক্রি করে কিছু আয় হয়। তা দিয়েই কোম্পানিটি টিকে আছে। ট্রাস্ট কোম্পানির শেয়ারের লভ্যাংশ থেকেও কিছু আয় আসে।
বর্তমানে কোম্পানিটির চা বিক্রির একজন এজেন্টও নেই। যা আয় হয় তা দিয়েই কোনো রকমে চলে বেতনভাতা ও অফিসের কার্যক্রম। গত চার বছরে কোম্পানিটি কোনো মুনাফা করেনি। এই অবস্থা থেকে আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা- এ বিষয়ে সংশয়ে রয়েছেন কোম্পানিটির কর্মকর্তারা।
অবস্থাদৃষ্টে, এটাই স্পষ্ট যে শ'ওয়ালেস বাংলাদেশের অধ্যায় করুণ অন্তের দিকে এগিয়ে চলেছে।
শুরুর সোনালী দিনগুলি
ডেভিড থমাস শ এবং চার্লস উইলিয়াম ওয়ালেস ১৮ শতকে কলকাতায় শ' ওয়ালেস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন।
বছরের পর বছর ধরে কোম্পানিটি শিপিং লাইন, রাসায়নিক কারখানা, মদ এবং চায়ের মতো নানান খাতে ব্যবসা প্রসার করেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ব্রিটিশরা কোম্পানিটিকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ফলে শ' ওয়ালেস ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং শ' ওয়ালেস পাকিস্তান লিমিটেড নামে আলাদাভাবে যাত্রা শুরু করে।
এতে লিকার (মদ্য) এবং এগ্রো-কেমিক্যাল যায় ভারতের ভাগে। আর চা এবং শিপিং তৎকালীন পাকিস্তানের কাছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত কোম্পানিটি এভাবেই তাদের আয় করছিল।
রেজাউর রহমান ছিলেন একজন বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী এবং কী হতে চলেছে সে সম্পর্কে তার গভীর ধারণাও ছিল।
তিনি ৫০ এর দশকের শেষদিকে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে নিজের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম শুরু করার আগে অডিট ফার্ম- প্রাইস ওয়াটারহাউস পিট অ্যান্ড কোং-এর অফিসের দায়িত্ব নেন।
ব্যবসায়িক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানি মেসার্স শ ওয়ালেস কিনে নেন।
রেজাউর ব্যবসা বাড়াতে থাকেন, স্থাপন করেন নতুন কারাখানা। নতুন চা বাগানও যোগ হয়। ব্যবসায় বৈচিত্র্য আসে মসলার মাধ্যমেও, এসব পণ্য শ' ওয়ালেস ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত হতো।
১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে কোম্পানির টাকায় ইন্টারন্যাশলনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) এবং ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এনএইচএফআইএল) প্রতিষ্ঠা করেন রেজাউর রহমান।
২০০২ সালে শ'ওয়ালেস বাংলাদেশ লিমিটেড (এসডব্লিউবিএল) শতভাগ কিনে নেন এবং এর মালিকানা তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্ট- এএফ মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশনের কাছে হস্তান্তর করেন।
কোম্পানির আয়েই ট্রাষ্ট চলতো।
রেজাউর শ' ওয়ালেস বাংলাদেশের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং- এর ১৭.৩৬ শতাংশ এবং ন্যাশনাল হাউজিং এর ২.৮১ শতাংশ শেয়ার নেন। এসময় কোম্পানিটি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যেও চা রপ্তানি করতো।
কোম্পানির আয়ে চালিত ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মেধাবি ছাত্রদের বৃত্তি দিত। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এএফ মুজিবুর রহমান গণিত ভবন নির্মাণ করেও দেয় দাতব্যটি।
একজন কর্মকর্তা বলেন, যতদিন রেজাউর রহমান দায়িত্বে ছিলেন ততদিন কোম্পানির ব্যবসা এবং দাতব্যের কাজ ভালই চলেছিল।
শেষের শুরুর যেভাবে
২০০৮ সালে রেজাউর ইংল্যান্ড চলে যান। কিন্তু, অসুস্থতার কারণে ফিরতে পারেননি। তখন কোম্পানির দায়িত্ব নেন তার ছোট ভাই মিজানুর রহমান।
২০০৮ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কোম্পানিতে যোগ দেন নুরুল আলম। বর্তমানে তিনি কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।
যোগদানের পরপরই নুরুল কোম্পানির সাতটি চা বাগানের সবকটি বিক্রি করে দেন। মসলা ব্যবসার ইতি টানেন, বন্ধ করেন শিপিং ও ক্লিয়ারিং ব্যবসাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
২০১০ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং ন্যাশনাল হাউজিং এর পরিচালনা পরিষদেও ছিলেন নুরুল আলম।
তার অধীনে শ ওয়ালেস কোম্পানির ব্যবসা যখন হোঁচট খাচ্ছিল তখনই পিকে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে দেখা গেছে, হালদার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে এবং সেসব নিজেরই গঠিত ভুয়া কোম্পানিকে ধার দিয়ে টাকা লোপাট করেছেন।
কেলেঙ্কারিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর নামও আসে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির অন্তত ২৮শ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে ৭০০ কোটি টাকা লোপাটের সংবাদ জানা যায়।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে ২০১৯ সালে দুদকের তদন্তে পিকে হালদারের সঙ্গে নুরুল আলমের নামও আসে। পরবর্তীতে দুদক তার নামে মামলাও করে। এর জেরে তিনি ন্যাশনাল হাউজিং থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এর ডিরেক্টর পদে এখনও রয়েছেন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে মন্তব্যের জন্য নুরুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে এড়িয়ে যান। পরবর্তীতে কয়েকদিন ধরে তাকে ফোন দেয়া হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।
ঐতিহ্য যখন কালিমালিপ্ত
বর্তমানে কোম্পানিটি ন্যাশনাল হাউজিং এর শেয়ার বিক্রি করে চলছে। গত এক বছরে কোম্পানিটি ন্যাশনাল হাউজিং এর ২৭ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যার বাজার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা।
কোম্পানিটির এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্বল নেতৃত্ব এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কেলেঙ্কারি শ ওয়ালেস কোম্পানির পতনের জন্য দায়ী।
তিনি আরো বলেন, শিপিং এবং কাস্টম এজেন্ট এর লাইসেন্স রয়েছে কোম্পানিটির। এছাড়া চা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উদ্যোগের অভাবে ব্যবসা নেই।
এদিকে শ ওয়ালেস কোম্পানির যে অংশটি ভারতীয় একটি গ্রুপ ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ কিনে নেয়- সেখানে প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবেই ব্যবসা করছে বলে জানা যায়।
এর উৎপাদিত অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় ভারতের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই জনপ্রিয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ভারতের বৃহত্তম বিয়ার উৎপাদনকারী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ভারতের মদ্যপ্রস্তুত বাজারে ৪০ শতাংশের বেশি অংশীদারিত্ব তাদের।
অথচ বাংলাদেশে কোম্পানিটি ধুঁকছে। বর্তমানে এর কর্মকর্তারা মনে করেন, যেকোনো সময় কোম্পানিতে তালা ঝুলতে পারে, এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই তাদের মনে।
কিন্তু, এই নাটকীয় পতনের পেছনে আসলে কী ঘটেছে তা কেউই সঠিকভাবে বলতে পারেন না।