হালের ট্রেন্ড ফ্যাশনেও বহাল তবিয়তে বালা
বলি, ও আমার গোলাপবালা, তোলো মুখানি, -কুসুমকুঞ্জ করো আলা- গানটি রবিঠাকুর লিখেছিলেন সেই ১৮৭৮ সালে, প্রেয়সীকে গোলাপবালার সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। সেইসময় ঠাকুরবাড়ি বা অভিজাত নারীদের হাতে শোভা পেত যে গোলাপবালা, এখন হালের এই ট্রেন্ড ফ্যাশনের যুগেও সেই গোলাপবালা রয়েছে বহাল তবিয়তে। শুধু কি গোলাপবালা! ডিজাইনের তারতম্যের কারণে বালাগুলোর নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। সিংহমুখী বালা, কাঁকনবালা আরও কতই না তার ধরন!
আগেকার দিনে রানি বা জমিদারের স্ত্রীদের হাতে অথবা অভিজাত পরিবারগুলোয় বংশানুক্রমে দিনের পর দিন আগলে রাখা হতো যেসব বালা, সেই বালাতেই এখনও মুগ্ধ হাল আমলের ফ্যাশন সচেতন তরুণীরা।
পার্থক্য একটাই সোনা বা রুপার তৈরি বালার সংগে সংগে ফ্যাশন সচেতনদের হাতে এখন শোভা পাচ্ছে তামা, পিতল, কাঠের তৈরি বালাও!
বালার রকমফের
শাড়ি কিংবা ফতুয়া, সালোয়ার কামিজ সবকিছুর সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে যাওয়ার মতো ফ্যাশনেবল এক গহনা এই বালা। বিভিন্ন পার্টি, বিয়ে বা ঘরোয়া অনুষ্ঠান, সবকিছুতেই মানানসই এ গয়না মুহূর্তেই এনে দেবে অভিজাত এক রূপ।
তবে সেই আমলে অনেক ধরনের বালার প্রচলন থাকলেও এখন গোলাপবালা, দুমুখোবালা কিংবা কাঁকনবালাই দেখা যায় সবচেয়ে বেশি।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এসব বালার রকমফের।
গোলাপবালা: ফুলের মতো পুরোটা জুড়ে কারুকার্য করা থাকে এ বালায়। বতর্মানে এ বালাটিরই চল সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কাঁকনবালা, বাইরের অংশে কিছুটা কোণাকৃতির এ বালাটিও রয়েছে তরুণীদের পছন্দের শীর্ষে।
দুমুখোবালা: এ ধরনের বালার সাধারণত দুটি মুখ থাকে। সিংহর মতো মুখ থাকে যেসব বালায় সেগুলোকে বলে মকরমুখো বালা, ময়ূরের মতো মুখ থাকলে সেগুলোকে বলে ময়ূরমুখী বালা।
অন্যদিকে, পত্রবালা সাধারণত কিছুটা চ্যাপ্টা আকৃতির হয়। এই বালার পাশ দিয়েও কিছুটা চোখা, তবে অন্যান্য বালার তুলনায় এটি কিছুটা পাতলা হয়ে থাকে।
চুড়বালা: একে ঠিক বালা বলা যায় না, আবার বললেও খুব একটা ভুল হবে না। এ বালা সাধারণত চুড়ির চওড়া ভার্সন।
তবে প্রত্যেকটি বালারই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দাদি-নানিদের আমলে এ বালার ডিজাইন যেমন ছিল, এখনও একইরকমই ডিজাইন রয়ে গেছে।
বালার আদ্যোপ্যান্ত
সাধারণ দোকানগুলোতে আন্টিকের ও কাঠের বালা পাওয়া গেলেও ডিজাইনের কিছুটা স্বকীয়তা পেতে চাইলে, ঘুরে দেখতে পারেন আড়ং, মাদল কিংবা ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব চরসের আউটলেটে।
মাদল
পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতাল থেকে ডানদিকে এগিয়ে গেলে পড়বে মাদল। দোতলায় প্রবেশ মাত্রই দেশীয় ঐতিহ্যের ছাপ সুস্পষ্ট। তামা ও পেতলের গয়নার বিশাল এক সংগ্রহ নিঃসন্দেহে বালা ও চুড়িপ্রেমীদের মন জয় করে নেবে মুহূর্তেই। পিতল, তামার পাশাপাশি এখানে মিলবে কাঁসার বালাও।
সনাতনি ডিজাইনগুলো তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে তামা, পেতল, কাঁসার বালাগুলো কিছু কিছু রাখা হয়েছে পুরোনো ধাঁচেই। বেশকিছু তামা ও পিতলের বালায় সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।
দাম: কাঁসা, পিতল বা তামার তৈরি বালাগুলোর দাম অনেকখানি নির্ভর করে এর কাজ ও আকারের ওপর। কাজ যদি বেশি হয়, স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে যায় কিছুটা।
কাঁসা, পেতল ও তামার সঙ্গে কাঠের ওপর ডিজাইন করা বালাও রয়েছে। ঘরটিতে ঢুকে একদম প্রথমে চোখ পড়বে এ বালাগুলোর ওপর।
তামা ও পিতলের বালাগুলোর দাম পড়বে একহাজার টাকা থেকে শুরু করে জোড়া প্রতি ১৫শ' টাকা।কাঠের বালাগুলোর দাম পড়বে জোড়া প্রতি ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকার ভেতর।
মাদলের স্বত্বাধিকারী শাম্মী জানালেন, ২০১৬ সাল থেকে তামা, পিতল এ ধরনের গহনা বিক্রির ওপর জোর দেন তারা। সেই সময় আমেরিকান এম্বেসির একটি প্রদর্শনীতে অংশ নেয় মাদল দল। বিদেশি নাগরিকদের এ ধরনের গয়না সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ দেখেই দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরার ইচ্ছাটা আরও গাঢ় হয় তার। তবে সোনার প্রলেপ দেওয়া গয়নাগুলোর উজ্জ্বলতা কমে গেলে, তা অ্যান্টিক রং দেওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।
তিনি জানালেন, মূলত তামা বা পিতলের বালার দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় এর তুলনায় কাঠের বালার চাহিদা অনেকটাই বেশি।
পহেলা বৈশাখ বা জাতীয় কোনো দিবসে সববয়সীদের পছন্দ থাকে কাঠের বালাগুলোর ওপর। বিশেষ করে চেক চেক বা গামছা দেওয়া বালাগুলো সেসময় অনেকবেশি বিক্রি হয়।
আড়ং
কাঠের কাজের বালার জন্য পছন্দের শীর্ষে রয়েছে আড়ং। তাই কাঠের কাজের ওপর বিভিন্ন ধরনের নকশা করা বালা যারা খুঁজছেন, তারা চলে যেতে পারেন আড়ংয়ের বিভিন্ন আউটলেটে। দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে এসব বালার জুড়ি নেই।
দাম: কাঠের ওপর খোদাই করা প্রতিটি বালার দাম ৫০ টাকা থেকে শুরু করে পাওয়া যাবে ১৫০টাকার ভেতর। দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় সৌন্দর্যে রূপা বা তামাসহ অন্যান্য ধাতুর সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে এসব বালা।
কাঠ ছাড়াও প্লাস্টিকের ওপর রং, সুতা, ছোট কাচের টুকরো, পুঁতি, বিভিন্ন বিট ইত্যাদি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব বালার সৌন্দর্য। এসব বালাও ৫০ টাকা থেকে শুরু হয়েছে। ১৫০-২০০ টাকার ভেতর মিলবে দারুণ সব ডিজাইনের বালা।
ছোট ও বড়দের জন্য বিভিন্ন সাইজের বালা রয়েছে আড়ংয়ের বিভিন্ন আউটলেটে। আড়ংয়ের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এদের প্রত্যেকটি আউটলেটে ডিজাইনের ভিন্নতা রয়েছে।
কালারস অব চরস
ফ্রেন্ডশিপ কালারস অব চরসের গুলশান ও ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে গেলেও চোখে পড়বে কাঠের ও প্লাস্টিকের ওপর ডিজাইন করা বিভিন্ন বালা।
১০০টাকা থেকে শুরু করে এসব বালাগুলো পাওয়া যাবে, ৩০০ টাকার ভেতর। তবে এসব বালাগুলোসহ অন্যান্য গয়নাগুলোর বেশিরভাগই তৈরি করেন চরের নারীরা।
এছাড়া দেশীদশের দোকানগুলোতেও মিলবে আন্টিকের বালা। এসব বালাতেও ডিজাইনের দিক থেকে সেই সনাতনি ধারাকেই অনুসরণ করা হয়েছে। সেই গোলাপবালা ও মকরমুখো বালার প্রাধান্য বেশি দেখা যায় এসব ডিজাইনের ক্ষেত্রে।
শোরুমে থাকা সেলসম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পছন্দের শীর্ষে রয়েছে এ ধরনের বালা। প্রতিটি বালা জোড়া আড়াইশ' থেকে শুরু করে ৫শ' টাকা।
রমরমে অনলাইন
মূল ধারার শোরুমগুলির বাইরে বিভিন্ন অনলাইন পেজে এখন কাঠ থেকে শুরু করে তামা, পেতলের বালা, গয়না পাওয়া যায়।
প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস নামে একজন বলেন, যে কোনো অনুষ্ঠানেই চুড়ি, বালা পরতে খুব ভালো লাগে। এখন অনলাইনের বিভিন্ন পেইজ থেকে কিনে নেনপছন্দমতো। এমনকি নিজের বিয়েতেও বালা, টিকলিসহ সব নিয়েছেন অনলাইন পেইজ থেকেই।
তবে চুড়ি বা বালায় অনলাইন বা অফলাইন যাই হোক, দামের ক্ষেত্রে খুব একটা হেরফের হয় না বলে জানালেন প্রিয়াঙ্কা।
বালাগুলো তৈরি হয় কোথায়!
সাভারে ভাকুর্তা নামে একটি গ্রামে তৈরি করা হয় বালাসহ বিভিন্ন ধরনের গয়না। `গয়নার গ্রাম' হিসেবে পরিচিত ওই গ্রামটিতে মূলত সনাতনি ধাঁচের গয়না তৈরি করা হয় বংশপরিক্রমায়। পরবর্তীতে ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে এর ওপর রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। অপরিশোধিত এ গয়নাগুলো কিনে নিয়ে পরিশোধন করা হয়, রাজধানীর তাঁতীবাজারে চলে পরিশোধন প্রক্রিয়া। এছাড়া বগুড়া, ময়মনসিংহ থেকেও আসে বালাসহ এসব গয়নার চালান।
সোনা, রুপা কিংবা তামা, পিতল যাইহোক বালার ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে সব একইধরনের ডিজাইনই চলছে বছরের পর বছর। সেই নানি-দাদিদের আমলে শোভা পেত যে ধরনের ডিজাইন, সম্প্রতি বিয়ের পিঁড়িতে বসা তরুণীর হাতেও একইধরনের বালা। এর রহস্য জানালেন মাসুমা খাতুন শাম্মী।
তার মতে, কারিগররা সাধারণত সনাতন ধরনের গহনাই তৈরি করে থাকেন। তৈরির পর গয়নার রঙে ধরা পড়ে পার্থক্য। তবে ট্রেন্ডি ফ্যাশনের ক্ষেত্রে অপরিশোধিত গয়নার চাহিদা অনেকটাই বেশি বলেও জানালেন তিনি।
অন্যদিকে, কাঠের বালার বিষয়ে আড়ংয়ের এক ডিজাইনদাতা জানালেন, বিভিন্ন ধরনের চুড়ি বা বালার ওপর অনেকগুলো করে ডিজাইন করেন তারা। এরমধ্যে থেকে একটি বেছে নেয় আড়ং কর্তৃপক্ষ। মূলত ফেলে দেওয়া কাঠ থেকে তৈরি করা হয় এ গয়না।
তবে বতর্মানে এ ধরনের গয়নাভিত্তিক বেশকিছু অনলাইন পেজও রয়েছে, যেগুলোতে বিভিন্ন শেপের কাজ ছাড়া খালি কাঠের ওপর বালাসহ অন্যান্য গয়না কিনতে পাওয়া যায়। ফলে বর্তমানে এ ধরনের কাজের প্রতি উৎসাহী হয়ে পড়ছে অনেকেই। এজন্যই রবিঠাকুরের সেই গোলাপবালা যুগের চাহিদা হয়ে টিকে থাকবে অনন্তকাল, সেতো বলাই বাহুল্য।