বাড়ছে চীনা ইলেকট্রিক গাড়ির বাজার, কিন্তু তা কি টিকে থাকতে পারবে?
একটি সরকার কীভাবে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে পারে তা স্পষ্ট বোঝা যাবে বেইজিংয়ের ইলেক্ট্রিক ভেহিকল (ইভি) প্রচলনের দৃষ্টান্ত দেখলে।
পাঁচ বছর আগে চীনা সরকার জ্বালানি-চালিত ট্যাক্সি নিষিদ্ধকরণ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে দেশটির রাজধানী বেইজিংসহ অন্যান্য শহরের রাস্তায় চলছে হাজারো ব্যাটারিচালিত গাড়ি।
ব্যাটারিচালিত এই ইলেক্ট্রিক যানবাহনের (ইলেক্ট্রিক ভেহিকল বা ইভি) চালকদের চার্জিং স্টেশনে সময় অপচয় করা নিয়েও মাথা ঘামাতে হয়না। কারণ চার্জের প্রক্রিয়াটি খুব সহজ। ব্যাটারির চার্জ শেষ হলে ইভিগুলোকে একটি ব্যাটারি-বিনিময় স্টেশনে (ব্যাটারি-সোয়াপিং স্টেশন) নিতে হয়। সেখানে থাকে একটি বিশেষ যন্ত্র, যেটি মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিঃশেষিত ব্যাটারি খুলে একটি চার্জযুক্ত ব্যাটারি স্থাপন করে দেয়।
ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির আই ইয়ুন লিসা বলেন, 'তারা গাড়ি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। সুতরাং তারা নিশ্চয়ই চাইবেন না ইভিতে চার্জ দেওয়ার জন্য তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করার প্রয়োজন হোক।'
এটি চীনের ইলেক্ট্রিক গাড়ির ক্রমবর্ধমান বিচিত্র ও উদীয়মান বাজারের একটিমাত্র দিক। অভূতপূর্ব সংখ্যক চীনা জনগণ ইভি কিনছেন। গত জুলাই মাসে চায়না প্যাসেঞ্জার কার আসোসিয়েশন-এর পূর্বানুমান মতে, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ দেশটিতে মোট ৬০ লাখ নতুন ইভি নিবন্ধন করা হবে। তার আগে চলতি বছরে পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার ইভি বিক্রির যে অনুমান করা হয়েছিল এটি তারই পুনরাবৃত্তি।
গত সেপ্টেম্বর মাস ছিল চীনের বাজারে ধনকুবের ইলন মাস্কের কোম্পানি টেসলার জন্য সেরা সময়। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী টেসলার ৮৩,১৩৫টি গাড়ি বিক্রি হয়েছে।
চীনে নতুন নিবন্ধিত গাড়ির প্রায় এক-চতুর্থাংশ গাড়ি ইভি অথবা প্লাগ-ইন হাইব্রিড যানবাহন। সে হিসাবে এই প্রযুক্তির ব্যবহারে ইউরোপের চেয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে চীন। এমনকি গোটা পৃথিবীর অর্ধেক ইভি বিক্রি হয় চীনে।
এটি সম্ভব হয়েছে মূলত সরকারের আদেশ এবং প্রণোদনার কারণে। ইভি ক্রয়ে চীনের সরকার এক দশকের বেশি সময় ধরে ভর্তুকি দিয়ে আসছে, যদিও ভর্তুকির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসছে এবং ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে। কিন্তু ভর্তুকি বন্ধ হলেও ইলেক্ট্রিক গাড়ি ক্রয় আর্থিকভাবে লাভজনক হওয়ার পেছনে আরও অনেক কারণ আছে।
চীনে এখন জ্বালানিচালিত নতুন গাড়ি কিনলে শুধু গাড়ির দামটাই নয়, লাইসেন্স প্লেইটের দামও পরিশোধ করতে হয়। সাংহাইয়ে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই লাইসেন্স প্লেটগুলোর নতুন একটির দাম প্রায় এক লাখ ইউয়ান (১২,৫০০ থেকে ১৪,০০ ইউরো)।
শহর অনুযায়ী ভিন্ন হলেও ইভি কেনার অনেক সুবিধা রয়েছে। লিউজোউ শহরে কর্তৃপক্ষ বাসের জন্য নির্ধারিত লেনে ইভি চালানোর অনুমতি দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিনামূল্যে পার্কিং করার সুবিধাও পাচ্ছে তারা।
এছাড়াও কিছু ইভি অত্যন্ত সুলভ মূল্যের, সাধারণের সাধ্যের মধ্যে। ইউলিং হং গুয়াং মিনি ইভিগুলো তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে দামী ইভি। স্টর্মক্রো ক্যাপিটাল নামক একটি কনসাল্টিং আন্ড রিসার্চ ফার্ম-এর পরিচালক জন হাইকয়ি বলে, 'ইউকিং হং গুয়াং-এর এন্ট্রি লেভেল গাড়ির দাম মাত্র ৪,২০০ ইউরো। শহুরে বাসিন্দা এবং প্রথমবারের মতো গাড়ি ক্রেতাদের কাছে এগুলো বেশ জনপ্রিয়। এ ধরনের গাড়িই এশিয়াতে ব্যাপকভাবে বিক্রি করা সম্ভব।'
হং হুয়াং মিনিগুলোই চীনে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভি। তবে অন্য প্রাইস রেঞ্জের মধ্যে টেসলার মডেল ওয়াই এবং এক্সপেং-এর পি৭ জনপ্রিয় যেগুলোর মূল্য যথাক্রমে ৪৯,০০ ইউরো এবং ৩০,৪১০ ইউরো। উভয় মডেল চীনে শীর্ষ ১০ বেস্ট সেলিং ইভি'র মধ্যে রয়েছে।
চীনের ইভি বাজার ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক। অনেক কোম্পানি এ বাজারে স্থান পেতে উঠে পড়ে লেগেছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স-এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জুনেয়াও নামক একটি এয়ারলাইন ইলেক্ট্রিক গাড়ি তৈরি শুরু করতে চাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেকনলোজিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড কনসাল্টিং ফার্ম গার্টনার-এর একজন বিশ্লেষক পেদ্রো পাচেকো চীনের কিছু ব্যাটারিচালিত ইভি বিশেষ ভালো বলে উল্লেখ করে বলেন, 'প্রযুক্তি উন্নত করার ক্ষেত্রে ইভি উৎপাদনকারীদের জন্য এটি একটি উত্তম ক্ষেত্র।'
ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে উৎপাদনকারীরা ব্যয়বহুল ইভিগুলোতে স্থাপন করছেন ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেমসহ অন্যান্য গ্যাজেট্রি।
কতদিন টিকবে চীনের এই ইভি বাজার?
চীনের ইভি বাজারকে কেন্দ্র করে দুটো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত এই বাজার কি টেকসই হবে? এবং দ্বিতীয়ত এটি বৈশ্বিক ইভি বাজারকে কোথায় নিয়ে যাবে?
ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর শিল্প বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক অ্যানা নিকোলস বলেন, চীনের ইভি বাজারের এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে তা দেখে তিনিও বিস্মিত। তবে তার মতে ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করলে ইভি কেনার যে আগ্রহ তা স্তিমিত হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, 'ভবিষ্যতে ভর্তুকি ছাড়া ইভি বাজারের বিস্তার ঘটবে- এমনটা কল্পনা করা কঠিন।'
এছাড়া, ইভিগুলোর চার্জ নেওয়ার কাঠামো অসমভাবে বণ্টিত এবং রয়েছে সরবরাহজনিত নানা সমস্যা। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপদাহসৃষ্ট খরার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক কমে যায়। যার দরুন সম্প্রতি কয়েকটি ইভি চার্জিং স্টেশন বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
ইভির সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। তার ওপর চীনা সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে কয়লার ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছে। এর ফলাফল হিসেবে ক্রমবর্ধমান নতুন ইভিগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে চীন।
ঠিক এই কারণেই অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ব্যাটারিচালিত যানবাহনের চেয়ে হাইব্রিড ইলেক্ট্রিক যানবাহনগুলো হতে পারে উত্তম বিকল্প। কারণ এতে বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যায়।
এছাড়াও হাইব্রিড ইলেক্ট্রিক যানের ব্যাটারি তুলনামূলক ছোট হওয়ায় এগুলোতে লিথিয়ামের প্রয়োজনীয়তা কম। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ ধারণা করা হচ্ছে আসন্ন বছরগুলোতে লিথিয়াম সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
চীনের ইভি বাজার বাকি বিশ্বকে কতদূর প্রভাবিত করতে পারে তা এখনো দেখার বিষয়। কিন্তু প্রভাব ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকাসহ নান দেশে চীনের ফার্মগুলো ইভির বিপণন শুরু করেছে। ব্যয়বহুল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিও নরওয়েতে ব্যাটারি-বিনিময় স্টেশন স্থাপন করছে।
পেদ্রো পাচেওর দাবি ইউরোপে ইভি গাড়ির ব্যাপক প্রচলন করতে হলে বহু প্রধান প্রধান গাড়ি কোম্পানিগুলোর ব্যাটারি সোয়াপিং সিস্টেম গ্রহণ করতে হবে। তবে পেদ্রো চীনে উইলুং ও চেরি'র মতো স্থানীয় ব্র্যান্ডের সাশ্রয়ী মূল্যের ইভির সফলতার দিকেও আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, 'চীনে ইতোমধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যের ইভি বাজারে চলছে। ইউরোপে তা এখনও সম্ভব হয়নি।'
পরিস্থিতি বলছে, উদীয়মান বাজারগুলোতে ঠিক এই ধরনের যানবাহনই জনপ্রিয়তা লাভ করবে। ইভি'র বিশ্বজয়ের সময় এসেছে? সম্ভবত। তবে এই ব্যাপারে আরও এক ধরনের মতামত আছে। অনেকে বলছেন সমগ্র বিশ্বে ইভির জয়জয়কার শুনতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
ভর্তুকি বন্ধের পর চীনে ইভির বাজার কীরূপ নেয় তা দেখার বিষয়- এতে একমত বিশ্লেষকরা। এটি চীনের ইভি উৎপাদনকারীদের অন্য বাজারের দিকে ঠেলে দেবে, অথবা হয়তো আমরা ইভির ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে পারব যেটির পরোক্ষ কৃতিত্ব যাবে চীনা সরকারের নীতিমালার কাছে। দেখার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
- সূত্র: বিবিসি