২০২২ সাল বৈদ্যুতিক কারের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত মোটরকারের বিক্রি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। একই সময় প্রায় স্থির ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত যানবাহনের চাহিদা। কোথাও কোথাও ইলেকট্রিক কারের চাহিদা এতোটাই যে, প্রস্তুতকারকরা কয়েক মাস আগেই অগ্রিম ডিপোজিট করতে বলছেন ক্রেতাদের। জনপ্রিয়তা লাভকারী কিছু মডেলের কার আগামী দুই বছর পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেছে। অর্থাৎ, এ সময়ে যতগুলো কার উৎপাদন করা যাবে- সেগুলো অগ্রিম কেনা হয়েছে।
এই অগ্রগতির কারণ ব্যাটারিচালিত কার এখন এক যুগান্তকারী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ বছরেই মূলধারার বৃহৎ গাড়ি উৎপাদকেরা মার্কিনীদের মধ্যে জনপ্রিয় পিকআপ ট্রাকের মতো যানের বৈদ্যুতিক সংস্করণ বিক্রি শুরু করবে। এসব গাড়ির আগমন সম্পূর্ণ অটোমোবাইল শিল্পে আসা আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ।
ঠিক যেমন ১৯০৮ সালে তার 'মডেল টি' কার বাজারে এনে হেনরি ফোর্ড এ শিল্পে নবীন দিকপথ সৃষ্টি করেছিলেন—তেমনই বড় এ পরিবর্তন। উৎপাদন ব্যবস্থায় আসা পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে বৈদ্যুতিক যান শিল্পে নিয়োজিত কারখানা কর্মী, ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি পরিবেশেও ফেলবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব—কারণ অন্তর্দাহ ইঞ্জিনের গাড়ির কালো ধোঁয়া জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। ইভি শিল্পের বিকাশ যার অবসানের নতুন দিগন্ত মেলে ধরেছে।
তবে এখনও প্রচলিত অন্তর্দাহ ইঞ্জিনের গাড়ির বেচাবিক্রিই বেশি। বিশ্ববাজারে মোট যানবাহন বিক্রির মাত্র ৯ শতাংশ এপর্যন্ত অধিকার করেছে ইভি (ইলেকট্রিক ভিহাইকেল) । তবে তা ২০১৯ সালের ২.৫ শতাংশের চেয়ে যা অনেকটাই বেশি- তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা- ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ)।
সংস্থাটির অনুমান, ২০২২ সাল অর্থাৎ চলতি বছরেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে চলেছে ব্যাটারি চালিত মোটরকারের বাজার দখল। অন্তর্দাহ ইঞ্জিন যে সেকেলে হয়ে পড়ছে সে সম্পর্কে এখনও যতটুকু সন্দেহের অবকাশ রয়েছে হবে তারও অবসান।
বৈদ্যুতিক কারের বহুল ব্যবহারে উন্নত হবে বাতাসের মান। কমবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সর্বনাশা গতি। এরমধ্যেই মিলছে তার নজির। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে ইভির ব্যবহার বেশি হওয়ায় সেখানকার বাতাস আরও পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। রাজনীতির ময়দানেও এ পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে নিঃসন্দেহে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে (কংগ্রেস) জলবায়ু নীতি পাস করাতে ব্যর্থ হলেও—ইভির বিকাশ তার পরিবেশ লক্ষ্যের সহায়ক হবে।
বিনিয়োগ বিশ্লেষক সংস্থা- ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের প্রাক্কলন অনুযায়ী, অটো শিল্প আগামী পাঁচ বছরে সম্পূর্ণরুপে বৈদ্যুতিক যান উৎপাদনের মতো রুপান্তর অর্জনে বিনিয়োগ করবে ৫০ হাজার কোটি ডলার। আকাশছোঁয়া এই অঙ্ক খরচ হবে কারখানা নির্মাণ, শ্রমিক প্রশিক্ষণ, সফটওয়্যার ডেভেলেপ, ডিলারশিপ আপগ্রেডসহ নানাবিধ খাতে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই এক ডজনের বেশি নতুন ইলেকট্রিক কার ও ব্যাটারি কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বেশকিছু কোম্পানি।
এনিয়ে জার্মানি ভিত্তিক গাড়ি উৎপাদক ও অটোমোবাইল শিল্পের বিখ্যাত নাম- ভক্সওয়াগন গ্রুপের যুক্তরাষ্ট্র শাখার প্রধান নির্বাহী স্কট কিওঘ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "পুঁজিবাদের ইতিহাসে এ শিল্প রুপান্তর হবে অন্যতম বৃহৎ। বিনিয়োগ যেমন বিপুল হবে—তেমনি মিশনও।"
উপকার সবার হবে এমন অবশ্য নয়। অন্তর্দাহ ইঞ্জিন মেরামতকারী ব্যবসা, তাদের কর্মীরা এতে জীবিকা হারাবেন। একই দশা হবে যন্ত্রাংশ উৎপাদক ও তাদের কর্মীদের। বিশ্বব্যাপী চাকরিহারা এই কর্মীর সংখ্যা হবে লাখে লাখে।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত ইঞ্জিনের গাড়ি নির্মাণ, বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের কাজে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। অটোমোবাইল শিল্প বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বৈদ্যুতিক কার উৎপাদনে কম কম্পোনেন্ট সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা থাকায়- কর্মীও কম লাগবে।
ব্যাটারি প্রযুক্তির উন্নতিই ইভি বিকাশের প্রধান চাবিকাঠি। তাই তো চাঙ্গা- ব্যাটারি উৎপাদনে দরকারি সব খনিজের বাজার। যেমন নিকেল ও কোবাল্ট এখন জ্বালানি তেলের পর অটোমোবাইল খাতে আরাধ্য উঠেছে। চাহিদার ফলে দামও ছুটছে আকাশপানে। এ ঘটনায় ইভির দাম বৃদ্ধির কারণে বিক্রিবাট্টা কমে যেতে পারে, তবে তা হবে স্বল্পমেয়াদী।
বাজার আরও বিকাশের পথে আরেকটি বড় বাধা ইলেকট্রিক কার চার্জিং স্টেশনের অভাব। একারণেই নিয়মিত দূরপাল্লার যাত্রা করেন এমন ক্রেতারা এখনও ইভির কিনতে ততোটা উৎসাহী নন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ইউরোপে অধিকাংশ আবাসিক ভবনের (অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে) প্রত্যেক বাসিন্দার গাড়ি-প্রতি পর্যাপ্ত চার্জিং সুবিধা না থাকাও-তাদেরকে নিরুৎসাহিত করবে।
এই অবস্থার পরিবর্তন চায় মার্কিন কংগ্রেস। গেল নভেম্বরে এ লক্ষ্যে কংগ্রেস পাঁচ লাখ নতুন চার্জার স্থাপনে ৭৫০ কোটি ডলার বরাদ্দ অনুমোদন দেয়। অবশ্য দেশটির বিশেষজ্ঞরা একে যৎসামান্যই বলেছেন।
তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিশাল ঘটনায় ইলেকট্রিক গাড়ির ইতিবাচক প্রভাব যোগ হতে লাগবে দীর্ঘসময়। ২৫০ বছর ধরে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত যানবাহন ব্যবহার করছি। সরকারি প্রণোদনা ও অন্যান্য নীতিসহায়তা ছাড়া এত কোটি কোটি গাড়ির শিল্পকে রাতারাতি প্রতিস্থাপন করা যাবে না। এজন্য ইভি ক্রেতাদের সরকারি ভর্তুকি দেওয়াও জরুরি—নাহলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো হয়ে পড়বে আরও দুরূহ।
এতসব 'কিন্তু' নিয়েও ইতোমধ্যে ফুলেফেঁপে উঠে- অটোশিল্পের চিরচেনা রুপ বদলে দেওয়া শুরু করেছে বৈদ্যুতিক কার।
প্রচলিত জ্বালানির গাড়ির প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন সেলিব্রেটি মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক। তার কোম্পানি টেসলা ২০২১ সালে প্রায় ১০ লাখ গাড়ি বেচেছে, যা ছিল ২০২০ সালের চেয়ে ৯০ শতাংশ বেশি।
প্রচলিত জ্বালানি ভিত্তিক অটোমোবাইল জায়ান্টদের সঙ্গে তুলনা করলে টেসলাকে এখনও তুলনামূলক ছোটই বলা যায়। কিন্তু, পুঁজিবাজারে এই কোম্পানিই বাজারের অন্য সকলকে পেছনে ফেলে লক্ষ্যণীয় বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। ওয়ালস্ট্রিটের বাজারে কোম্পানিটির মূল্যায়ন এক লাখ কোটি ডলার; যা কিনা ফোর্ড মোটরস- এর মতো ঐতিহ্যবাহী কোম্পানির চেয়ে ১০গুণ বেশি। টেসলা এখন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও জার্মানিতে নতুন কারাখানা নির্মাণ করছে। পুঁজিবাজারের সমর্থন থাকায় কোম্পানিটি আরও সহজে সম্প্রসারিত হতে পারবে।
ফোর্ডের সাবেক একজন নির্বাহী এবং বর্তমানে গুগেনহেইম সিকিউরিটিজের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচালক জন ক্যাসেসার মতে, "যে হারে টেসলা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে; তাতে আগামী পাঁচ বছরে এটি জেনারেল মোটরসকেও পিছনে ফেলে দেবে।"
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যতদিন জ্বালানি তেলচালিত গাড়ির মতো সস্তা না হচ্ছে- ততোদিন বৈদ্যুতিক যান সার্বজনীন হতে পারবে না। তবে একথাও সত্য, উদীয়মান বাজার ও উন্নত দেশের ভোক্তাদের কাছে এপর্যন্ত উৎপাদিত অনেক ইভির মডেলই মাঝারি দামের। তারা চাইলে কিনতেও পারছেন। আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আরও কমমূল্য সীমার মাইলফলক অর্জনের পথেই রয়েছে বৈদ্যুতিক যান শিল্প।
জলবায়ু পরিবর্তনই ইভি যানের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার আঘাত যতো বাড়ছে, ততোই বাড়ছে পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ। কিছুটা বাড়তি খরচ হলেও এখন ভোক্তারা বৈদ্যুতিক কার কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ তারা জানছেন, এর রক্ষণাবেক্ষণ সহজ, চালিকাশক্তি বিদ্যুৎ সস্তা আর চালানোতেও আছে অন্যরকম আনন্দ। তাইতো স্বচ্ছল ক্রেতারা কার্পণ্য করছেন না।
গেল বছর দামি কার উৎপাদক পোর্শের ইলেকট্রিক সেডান মডেল- টাইকান কোম্পানিটির সিগনেচ্যার কার ৯১১ এর বিক্রিকে ছাড়িয়ে যায়। অথচ এটির দাম শুরু হয় ৮৩ হাজার ডলার মূল্য থেকে। ২০২১ সালে প্রায় এক লাখ ইলেক্ট্রিক কার বেচেছে মার্সিডেজ বেঞ্জ- যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯০ শতাংশ বেশি।
খুব শিগগির ফোর্ড তাদের বিখ্যাত এফ-১৫০ পিকআপ ট্রাকের বৈদ্যুতিক সংস্করণ লাইটনিং বাজারে আনবে। গেল কয়েক দশক ধরে এটিই যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রিত গাড়ির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। প্রথমে বছরে ফোর্ড ৭৫ হাজার লাইটনিং বিক্রির পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু, ক্রেতাদের মধ্যে তুমুল সাড়া পড়ায় উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে ফোর্ড। মানভেদে এটির দাম হবে ৪০ থেকে ৯০ হাজার ডলার পর্যন্ত। এরমধ্যেই দুই লাখ ক্রেতার অগ্রিম বুকিং পাওয়ার পর আর কারো বুকিং নিচ্ছে না কোম্পানিটি।
ফোর্ডের প্রোডাক্ট প্ল্যাটফর্ম চিফ ও অপারেশন্স কর্মকর্তা হাও থাই-তুং বলেন, "আমরা উৎপাদিত প্রতিটি গাড়ি বিক্রি করতে পারব।"
অটোমোবাইল শিল্পের অন্য জায়ান্টরাও তাদের ইভি পরিকল্পনা নিয়ে মার্কিন দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
ইউরোপ ও চীনের বাজারে ইলেকট্রিক কার যেমন সাড়া ফেলেছে- তাতে সহজেই ইঙ্গিত মেলে দুনিয়ার এক নম্বর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও দেখা যাবে বিস্ফোরণ।
গত বছরের ডিসেম্বরে ইউরোপে প্রথমবারের মতো ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রিকে ছাড়িয়েছে বৈদ্যুতিক কার। ব্রিটেনসহ ১৮টি ইউরোপীয় দেশে এসময়ে বিক্রি হওয়া নতুন কারের ২০ শতাংশের বেশি ছিল বৈদ্যুতিক—এমন কথাই জানান বার্লিন ভিত্তিক বিশ্লেষক ম্যাথিয়াস স্কিমিদ।
২০১৫ সালে ইউরোপে অর্ধেকের বেশি গাড়ি ছিল ডিজেলচালিত। করনীতির কারণে ডিজেল সস্তা হওয়া ছিল যার প্রধান কারণ। তবে এখন ইলেকট্রিক কারে ভর্তুকি দিচ্ছে ইউরোপের সরকারগুলো। একইসঙ্গে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হওয়া কার প্রস্তুতকারকদের জরিমানা করা হচ্ছে- এসব ঘটনাই বদলে দিয়েছে আমূল সমীকরণ।
সে তুলনায় গেল বছর যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া মাত্র ৪ শতাংশ নতুন কার ছিল বৈদ্যুতিক। অবশ্য তা ২০২০ সালের ২ শতাংশের থেকে এগিয়ে।
ইলেকট্রিক কার বিকিকিনির পেছনে প্রধান যুক্তি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো। ব্যাটারিচালিত গাড়ির একেবারেই পরিবেশগত মূল্য নেই—সেকথা বলা যাবে না। তবে শক্তির উৎস এবং কাঁচামালের কথা বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়; পরিবেশের জন্য ইভি প্রচলিত কারের চেয়ে অনেকটাই সেরা উপায়। আর এ তথ্য জানিয়েছে বিশ্বখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রোমেন্ট স্টাডির গবেষণা।
মানতেই হয়, প্রচলিত জ্বালানির গাড়ি থেকে সরে আসার এ রুপান্তরে কর্মসংস্থান ও শিল্পে অনেক স্থানান্তর আর শূন্যতা তৈরি হবে। কিন্তু, পরিবর্তনের ভয়ে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা থেকেও পেছানো যায় না। পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থা, সভ্যতার বিকাশ বা জলবায়ু পরিবর্তনও তার পরোয়া করে না।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস