চুল কেন ঝরে পড়ে? কীভাবে থামাবেন চুল পড়া?
গত কয়েক দশক ধরে আমাদের চুল কীভাবে গজায় এবং পুরুষদের কীভাবে টাক পড়ে-এ সংক্রান্ত নানা জটিলতার সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন জীববিজ্ঞানীরা। এবং অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পেয়েছেন তারা।
মেডিক্যাল নিউজ টুডে-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চুল পড়া ও প্রতিকার সংক্রান্ত বিজ্ঞানের সর্বশেষ ব্যাখ্যা।
আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব ডার্মিটোলজি আসোসিয়েশনের তথ্যমতে, একজন স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সাধারণত প্রায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার চুল থাকে এবং দৈনিক ৫০ থেকে ১০০টি চুল পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি চুল পড়লে তা অবশ্যই দুশ্চিন্তার বিষয়।
কেন চুল পড়ে- এর উত্তর পেতে হলে জানতে হবে আমাদের চুল গজানোর প্রক্রিয়া কী। চলুন জেনে আসা যাক এসব প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
চুলের বীজকোষে বৃদ্ধির চক্র
চুল গজানোর জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। আমাদের চুলের প্রধানত দুটো অংশ থাকে। ফলিকল বা বীজকোষ এবং শাফট বা দণ্ড।
চুলের ফলিকল বা বীজকোষ হলো টিউবের মতো লোমকূপ যা চুলের গোড়াকে ঘিরে থাকে। আমাদের মাথায় যে এক লাখ চুলের বীজকোষ আছে, এগুলোর সবকটি একসাথে জন্মায় না। চুলের জন্ম, বড় হওয়া এবং পড়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজ ধাপে ধাপে অর্থাৎ চক্রাকারে হয়ে থাকে যেটিকে হেয়ার গ্রোথ সাইকেল বা চুলবৃদ্ধির চক্র বলে।
সব চুল একসাথে এই চক্রে ঢুকে না এবং বের হয় না। এর ফলেই আমাদের সব চুল একসাথে পড়ে না আবার সব একসাথে গজায় না। তা না হলে আমরা সবাই টাক হয়ে যেতাম! প্রত্যেক বীজকোষ বারবার এই একই বৃদ্ধিচক্রের মধ্য দিয়ে যায় যার তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায় রয়েছে; অ্যানাজেন, ক্যাটাজেন এবং টেলোজেন।
অ্যানাজেনের সময়কে বলা হয় চুলের বাড়ন্তকাল যা দুই থেকে সাত বছর ধরে চলে। চুলের জন্মের পর থেকেই শুরু হওয়া এই ধাপে বীজকোষের প্রতিটি চুল প্রতি মাসে প্রায় এক সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়ে।
এরপর শুরু হয় ক্যাটাজেন। অ্যানাজেন থেকে এই ধাপে যেতে দুই সপ্তাহের মতো সময় লাগে। এসময় চুলের গোড়ায় রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণে পুষ্টি প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে চুলের বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। এসময় চুল তার গোড়া থেকে চামড়ার কাছাকাছি অর্থাৎ উপরের দিকে চলে আসে। তখন একে ক্লাব হেয়ার বলে।
টেলোজেন ধাপে এসে ক্লাব হেয়ারগুলো বিশ্রাম বা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে এবং একসময় পড়ে যায়। খালি হওয়া বীজকোষে নতুন চুলের জন্ম হয় তবে যা সর্বোচ্চ চার মাস পর্যন্ত সময় নিতে পারে।
ট্রমাটিক অথবা অতিরিক্ত মানসিক চাপে পড়লে দুই থেকে তিন মাসের মাথায় বীজকোষ টেলোজেনের অক্ষম অবস্থায় রয়ে যেতে পারে। ফলে সে স্থানে আর চুল গজায় না বলে মাথায় চুল কমতে থাকে যা টেলোজেন এফ্লুভিয়াম নামে পরিচিত।
কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ চুল পড়া বাড়ায়
গত বছরের মার্চ মাসে কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ চুলের বীজকোষকে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় অনেক দিন রাখতে পারে তার ব্যাখ্যা দেন বিজ্ঞানীরা।
আমাদের দেহে যে অল্পকটি টিস্যু নিজেরাই পুনরুৎপাদন করতে পারে তার মধ্যে চুলের বীজকোষ একটি। তারা এই কাজটি করতে পারে মূলত অ্যাডাল্ট স্টেম নামক এক ধরনের বিশেষ কোষের বদৌলতে। হার্ভার্ড ডিপার্টমেন্ট অভ স্টেম সেল অ্যান্ড রিজেনারেটিভ বায়োলজির গবেষকরা ইঁদুরের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় জানতে পারেন কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এই অ্যাডাল্ট স্টেম কোষগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে।
তাদের গবেষণায় উঠে আসে, কর্টিকোস্টেরোন (যা মানবদেহে থাকা কর্টিসোল হরমোনের সমমান) নামক এক হরমোন বীজকোষের স্টেম কোষগুলোকে নিষ্ক্রিয় রাখে। কর্টিকোস্টেরোনের অনুপস্থিতিতে ইঁদুরের স্টেম কোষগুলো বহুবার পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপের কারণে কর্টিকোস্টেরোনের মাত্রা বেড়ে যায় যা কোষগুলোকে নিষ্ক্রিয় রাখে এবং ফলত চুল গজানোর হার কমে যায়।
অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া
এটি চুল পড়ার সাধারণ একটি কারণ যার ফলে নারী ও পুরুষ উভয়ের অতিরিক্ত চুল পড়তে পারে। পুরুষের ক্ষেত্রে মাথার উপরিভাগ এবং কপালের পার্শ্ববর্তী চুল পরে গিয়ে টাক হয় এবং নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণত উপরের চুল পাতলা হয়ে যায়।
অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া সাধারণত বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে হয়ে থাকে কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের পরে যেকোনো সময়ে এটি হতে পারে। হরমোনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে নারীদের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত রজোবন্ধের পর হয়ে থাকে।
গর্ভধারণ
সন্তান জন্মদানের পর অনেক নারীর অতিরিক্ত চুল পড়তে পারে। এটি এস্ট্রোজেনের মাত্রার হ্রাসের কারণে হয়ে থাকে। এ ধরনের চুল পড়া সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয় এবং এক বছর বা আরও কম সময়ে চুলের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
অ্যালোপেশিয়া এরিয়াটা
অকালে চুল পড়া অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কিন্তু মাথার যত্রতত্র থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল পড়ে যাওয়া আরও দুশ্চিন্তার ব্যাপার। এর জন্য দায়ী অটো ইমিউন নামে এক রোগ যা অ্যালোপেশিয়া এরিয়াটা নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে কেবল মাথার চুল নয়, চোখের ভ্রুও পড়ে যেতে পারে।
পুষ্টির অভাব
পুষ্টির অভাবে অনেকের চুল পড়ে। কেউ কেউ ওজন হ্রাসের জন্য এত চরম মাত্রায় ডায়েট করেন যে তাদের আমিষ, ভিটামিন, আয়রন ইত্যাদির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এর ফলে অতিরিক্ত চুল পড়তে শুরু করে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী পিল
জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী পিল গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও অনেকের চুল পড়তে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এসব পিল গ্রহণ বন্ধের কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
দাদ রোগ
দাদ একটি সংক্রামক চর্মরোগ যা শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের হতে পারে। ডার্মাটোফাইট নামক এক ফাঙ্গাসের সংক্রমণে দাদ হয়। এটিকে ডাক্তারি পরিভাষায় টিনিয়া বলে। দাদ চুল পড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
এছাড়াও আরও অন্যান্য কারণে অতিরিক্ত চুল পড়তে পারে যেমন, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, বিটা ব্লকার, লেভোডোপা এবং কেমোথেরাপির ওষুধ গ্রহণের কারণেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চুল পড়ে।
থাইরইয়েড ডিসঅর্ডার, সেক্স হরমোনের ভারসাম্যহীনতা অথবা প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, বায়োটিন ইত্যাদির অভাব হওয়া চুল পড়ে যাওয়ার কারণ।
টাইট বা আটসাঁট করে চুল বাঁধলেও চুল পড়তে পারে যা বিজ্ঞানে ট্র্যাকশন অ্যালোপেশিয়া নামে পরিচিত।
প্রতিকার
চুল পড়ার একাধিক কারণ থাকার কারণে এর প্রতিকারও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
মিনক্সিডিন ব্যবহারে অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়ার কারণে সৃষ্ট চুল পড়া সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
গর্ভধারণের সময় চুলবৃদ্ধি স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য যা করা যেতে পারে:
- ভলিউমাইজিং শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করা।
- অতিরিক্ত কন্ডিশনার ব্যবহার না করা।
- কন্ডিশনার মাথার ত্বকে নয়, কেবল চুলের আগায় ব্যবহার করা।
- জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী পিল গ্রহণ করলে এমন পিল বাছাই করতে হবে যেগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম অ্যান্ড্রোজেন রয়েছে।
নিজের যত্ন
চুল পড়া রোধে কেবল চুলের যত্ন নিলেই হবে না, নিতে হবে শরীরের যত্নও।
মানসিক চাপ কমাতে লাইফস্টাইল পরিবর্তনসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে পারেন।
নিয়মিত ভিটামিন ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ।
টাইট বা আটসাঁট করে চুল না বাঁধা।
চুলে যথাসম্ভব তাপ (হেয়ারড্রায়ারে চুল শুকানো, হেয়ার স্ট্রেটনার ব্যবহার) না দেওয়া বা ব্যবহার কমানো।
আমাদের নিয়মিত চুল পড়া স্বাভাবিক। মানুষের সাধারণত দৈনিক ১০০টি চুল পড়ে। অতিরিক্ত চুল পড়লে চুলের বাড়তি যত্ন নেওয়া উচিত। এরপরেও কাজে না দেওয়া মানে হলো এর পেছনে কোনো অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে যা আপনি ধরতে পারছেন না। এমতাবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং সে অনুযায়ী নিয়ম মেনে চলা উচিত।