গাছের সঙ্গে কথা বলা: যে নীরব শ্রোতা আমাদের মানসিক চাপ কমায়
দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম প্রয়োজনে কত মানুষের সাথেই না আমরা কথা বলি। কথা বলা আমাদের যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। কিন্তু কখনো কি আপনার ঘরে থাকা গাছের সঙ্গে কথা বলেছেন? গাছকে বন্ধু ভেবে তাকে শুনিয়েছেন নিজের গল্প? গাছের যে প্রাণ আছে, তা তো অনেক আগেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত; এবার গবেষকরা দেখেছেন যে গাছের সঙ্গে কথা বললেও মন শান্ত হয়। কারণ গাছের সাথে কথা বলার সময় সে কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় না, তর্ক করে না, কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে না—যা মানুষের সাথে যোগাযোগের বেলার ঘটে। তাই কেউ যদি আপনমনে নিজের গৃহকোণে থাকা গাছের সঙ্গে কথা বলে থাকেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
২০২২ সালে ট্রিজ ডটকম পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ১,২৫০ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৫০ শতাংশই তাদের বাড়ির গাছ বা গাছের চারাদের সঙ্গে কথা বলেন। এর কারণ জানতে চাওয়া হলে ৬৫% মানুষ জানিয়েছেন, তারা মনে করেন কথা বলা গাছের বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে। গবেষণাটি যদিও এই ব্যাপারে নিশ্চিত নয়; তবে অন্য কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে শব্দের মাধ্যমে সৃষ্ট কম্পন গাছের ওপর প্রভাব ফেলে, যদিও মানুষের কণ্ঠস্বর বিশেষ কোনো সুবিধা দেয় কি না সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি জুরিরা।
গাছপালা রোপণ করেন এবং নিজের কাছে রাখেন এমন অনেক ব্যক্তি অবশ্য এসব বৈজ্ঞানিক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। এই যেমন ইনডোর নার্সারির সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্কুইস ম্যাটসন বলেন, তিনি তার গাছের সাথে কথা বলেন, কারণ এতে তার ভালো লাগে। তার ভাষ্যমতে, 'আমি মনে করি গাছপালার সাথে কথা বললে তারা এক ধরনের সম্প্রীতি অনুভব করে এবং এটি তাদের বিকাশে সাহায্য করে।'
ওহাইওর ওবেরলিন কলেজের সাইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধ্যাপক সিন্ডি ম্যাকফারসন ফ্রানৎজ বলেন, 'মানুষের মধ্যে একটি ব্যাপার খুবই ভালো, আর তা হলো নরত্বারোপ [দেবতা, প্রকৃতি, জীবজন্তু ইত্যাদিতে মানুষের রূপ বা নরত্ব আরোপ]। আমরা মানুষ ছাড়াও আরও অনেক কিছুর সাথে কথা বলি, যেমন আমাদের কুকুর-বিড়াল। আমরা এক ধরনের সংবেদনশীল চিন্তা বা অনুভূতি অন্য মানুষ বা বস্তুর মধ্যেও তৈরি করতে চাই, সংযোগ স্থাপন করতে চাই। আর গাছ এই চাহিদা পূরণে সাহায্য করতে পারে।'
শব্দের প্রভাব
আলট্রাসনিকস নামের একটি জার্নালে ২০০৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় চীনা বাঁধাকপি ও শসার বৃদ্ধির ওপর ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত এবং পাখি-পোকামাকড়ের শব্দ ও পানির প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, দুই ধরনের শব্দের প্রভাবেই উভয় শাকসবজির বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অভ ইন্টেগ্রেটিভ সায়েন্সেস, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি-তে ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গবেষকরা গাঁদা ফুল ও ছোলা গাছকে হালকা ইন্ডিয়ান সংগীত ও যানবাহনের শব্দের সংস্পর্শে নিয়ে এসে পরীক্ষা করেন। গবেষকরা দেখেন, দৈনিক চার ঘণ্টা করে সংগীতের সংস্পর্শে থাকার পর দুই ধরনের গাছেরই বৃদ্ধি ও বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে—গাছগুলো লম্বায় বেড়ে গেছে, গাছে পাতার সংখ্যা বেড়েছে এবং তাদের আরও সতেজ দেখাচ্ছে। কিন্তু যানবাহনের শব্দের সংস্পর্শে এসে এই পরিবর্তনগুলো ঘটেনি।
ওহাইওর ইউনিভার্সিটি অব টলেডোর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক হিডি অ্যাপেলের ভাষ্যে, 'গাছ তাদের আশপাশের পরিবেশে ঘটতে থাকা বিভিন্ন ভাইব্রেশন বা কম্পনে অবশ্যই সাড়া দেয়—যা গাছকে ভিন্নভাবে বেড়ে উঠতে এবং গাছের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। এসব কম্পন বায়ুবাহিত শব্দ বা গাছের ওপর বিভিন্ন পোকামাকড়ের নড়াচড়া থেকে উৎপন্ন হতে পারে। আর নীরবতার চাইতে বিভিন্ন ধরনের শব্দ ও সঙ্গীতের প্রতি গাছ ভিন্নভাবে সাড়া দেবে।' তবে তিনি এ-ও যোগ করেন, 'শব্দ অবশ্যই গাছকে প্রভাবিত করে, কিন্তু আমরা এখনও জানি না গাছের সাথে কথা বললে এগুলো ভিন্নভাবে বেড়ে ওঠে কি না।'
গাছের সঙ্গে কথা বলার ফলে তাদের বৃদ্ধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারে গবেষণা ও প্রমাণের অভাব থাকা সত্ত্বেও, অন্তত একটি তাত্ত্বিক দিক তো আছেই। 'জীবন্ত কোনোকিছুর যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব যখন আমাদের ওপর বর্তায়, তখন আমরা অবশ্যই ভালোভাবেই এর যত্ন নেব,' বলেন অধ্যাপক অ্যাপেল।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি গাছের সঙ্গে কথা বলে তাদের সাথে একাত্মবোধ করে, তাহলে সে গাছে সময়মতো পানি দেবে, সেগুলোর যত্ন নেবে, পোকামাকড় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে এবং গাছগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে।
'গাছেরা কাউকে বিচার করে না'
গাছের সাথে কথা বললে তাদের যতটা না উপকার হয়, মানুষের কি তার চেয়ে বেশি উপকার হয়? ২০২২ সালে ট্রিজ ডটকমের করা একই জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬২% জানিয়েছেন যে তারা তাদের গাছের সাথে কথা বলেন, কারণ এটি তাদেরকে মানসিকভাবে শান্তি দেয়। এযাবত প্রচুর গবেষণায় দেখা গেছে, গাছের যত্ন নিলে শরীর-মন ভালো থাকে।
২০১৮ সালে হর্টসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাছ লাগানো তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। আর ২০২২ সালে প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যবান নারীদের মধ্যে যারা প্রতিদিন বাগান করার পেছনে এক ঘণ্টা ব্যয় করেন, তাদের মনমেজাজ ভালো থাকে এবং দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের লুইসভিলের বাসিন্দা স্টেফান বুকার জানান, তার স্ত্রী মেগান প্রতিদিন তাদের গাছেদের সঙ্গে কথা বলেন। রিদম অভ দ্য হোম-এর প্রতিষ্ঠাতা বুকার বলেন, 'গাছেদের যত্ন নেওয়া এবং তাদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করাটা নিজের মনকে শান্ত রাখার একটা উপায় হতে পারে এবং গাছের সঙ্গে কথা বললে এই অভিজ্ঞতা আরও বেশি হয়। একই সাথে, গাছদের সঙ্গে কথা বললে কৃতজ্ঞতাবোধ ও গুণগ্রাহিতার চর্চা করা করা যায়।'
গাছের সঙ্গে কথা বলা মানুষের জন্য প্রশান্তিদায়ক কি না—এ ব্যাপারে বিশদ কোনো গবেষণা প্রকাশিত না হলেও, এরকম ভাবনার পেছনে আপাতদৃষ্টিতে ন্যায়সংগত কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নর্থওয়েস্ট ইকোথেরাপির সাইকোথেরাপিস্ট প্যাট্রিসিয়া হ্যাজবাক বলেন, 'মানুষ যাদেরকে নিয়ে ভাবে, তাদের সাথেই কথা বলে বেশি—এটা সহজাত প্রবৃত্তি। এটা আমাদেরকে মননশীল হতে সাহায্য করে।'
আরেকটি বিষয় হলো, গাছের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে নিজের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা যায়। ওহাইওর স্ট্রেস ট্রমা অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স প্রোগ্রাম-এর পরিচালক ও সমাজকর্মী আর. ইয়েগার বলেন, 'আমি গাছের সাথে কথা বলি অনেকটা নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো করেই, যেন আমরা নিজেরাই নিজেদের সাথে কথা বলছি—এবং আমাদের চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া সাজাচ্ছি।' অন্যভাবে বলতে গেলে, বাড়ির গাছেদের সঙ্গে কথা বলা অনেকটা নিজের সঙ্গে কথোপকথনের মতো এবং কোনো বিষয় সম্পর্কে নিজের চিন্তাধারার নতুন নতুন দিক অন্বেষণ করার মতো। অর্থাৎ আমাদের চিন্তাগুলোকে কথায় রূপ দেওয়াটা এক ধরনের প্রশান্তি বয়ে আনতে পারে।
আবার গাছেদের সঙ্গে কথা বলার বড় উপকারিতা হলো, এটি তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ। 'অর্থাৎ যে কথা আপনি অন্য মানুষের সামনে বলতে পারবেন না, তা গাছের সঙ্গে বলা যায়,' বলেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলমট বোটানিক্যাল গার্ডেনস কলেজ অব মেডিসিন-এর থেরাপিউটিক হর্টিকালচার'র পরিচালক এলিজাবেথ ডিয়েল। আপনি যখন গাছের সঙ্গে কথা বলেন, তখন তারা বিমুগ্ধ শ্রোতা। ডিয়েলের ভাষ্যে, 'গাছেরা কাউকে বিচার করতে যায় না। গাছদের সামনে আপনি যে-কেউ হতে পারেন এবং যা ইচ্ছা বলতে পারেন—তারা শুধু এতেই খুশি যে আপনি তাদের যত্ন নিচ্ছেন।'
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট