পেশেন্ট এম: যুদ্ধে মাথায় আঘাতের পর পৃথিবীকে উল্টো দেখতে শুরু করেছিলেন যিনি
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ চলছে। সময়টা ১৯৩৮ সাল। যুদ্ধে ২৫ বছর বয়সী এক যুবক মাথায় মারাত্মক আঘাত পেলেন। দুই সপ্তাহ পর তার জ্ঞান ফিরে এল। কিন্তু জেগে উঠে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন তিনি। বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে তিনি পৃথিবীকে উল্টোভাবে দেখা শুরু করলেন।
যুবকের চিকিৎসা করেছিলেন ২৮ বছর বয়সী তরুণ ডাক্তার হুস্তো গঞ্জালো। রোগীকে তিনি পেশেন্ট এম হিসেবে ডাকতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো বস্তু উড়ে এসে এম-এর মাথায় লেগেছিল। এর ফলে তার মস্তিষ্কের বাম প্যারাইটো-অক্সিপিটাল অঞ্চলের সেরেব্রাল কর্টেক্স আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান, তার জন্য কোনো সার্জারি বা বিশেষ যত্নেরও প্রয়োজন হয়নি। ডাক্তার গঞ্জালো বুঝতে পারলেন, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এ কেস মানব মস্তিষ্কের কর্মপদ্ধতি জানতে দারুণভাবে সাহায্য করবে।
গৃহযুদ্ধ শেষ হলো। ডাক্তার গঞ্জালো ও তার রোগী তারপরও একে অপরের সঙ্গে প্রায় পাঁচ দশক যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। গঞ্জালো মারা যান ১৯৮৬ সালে। তার মেয়ে ইসাবেল গঞ্জালো বাবার পুরোনো কাগজপত্র বের করে নতুন করে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছেন। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নিউরোসাইকোলজিস্ট আলবার্টো গার্সিয়া মোলিনা।
গঞ্জালো যখন প্র্যাক্টিস করছিলেন তখন বিজ্ঞানীমহল দুইভাগে বিভক্ত ছিল। একপক্ষ মস্তিষ্ককে সামগ্রিকভাবে একক অঙ্গ হিসেবে দেখত। অন্যপক্ষ মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলকে আলাদা-আলাদা হিসেবে বিবেচনা করত। হুস্তো গঞ্জালো পেশেন্ট এম-এর ওপর ভিত্তি করে থিওরি অভ ব্রেইন ডায়নামিক্স নামক নতুন একটি মধ্যবর্তী অনুমান প্রস্তাব করেন।
পেশেন্ট এম তাদের বাড়িতে আসতেন, সেই সুবাদেই তার সঙ্গে ইসাবেল গঞ্জালোর পরিচয়। একবার বিশ্রাম করার সময় বড় কোনো উদ্দীপক ছাড়াই তিনি হঠাৎ করে পৃথিবীকে উল্টোভাবে দেখা শুরু করলেন। তার চোখের সামনে বস্তুগুলো তিনটি করে ও সবুজ রংয়ে আবির্ভূত হতে শুরু করল। তার শ্রবণ ও স্পর্শের অনুভূতিও বিপরীতমুখী হয়ে গেল। পেশেন্ট এম কেসটির বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে নিউরোলজিয়া জার্নালে।
২০ শতকের শুরুর দিকে স্পেনে মানবমস্তিষ্ক নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছিল। ১৮৮৮ সালে গবেষক সান্তিয়াগো রামোন ই কাহাল প্রমাণ করেন আমাদের মস্তিষ্ক নিউরন দিয়ে তৈরি। এ আবিষ্কারের জন্য ১৯০৬ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন তিনি।
কাহালের সময় তার কয়েকজন ভালো শিষ্যও চিকিৎসাবিদ্যায় বেশ ভালো কাজ করেন। এরকম একজন ছিলেন স্নায়ুবিদ গঞ্জালো রদ্রিগেজ লাফোরা। গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এই লাফোরাই হস্তো গঞ্জালোকে তার স্কিল ট্রমা সেন্টারে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন।
সেখানে কাহালের শিষ্য গঞ্জালো পেশেন্ট এমসহ আরও অনেক আহত রোগীর চিকিৎসা করেন। ১৯৪৫ ও ১৯৫০ সালের মধ্যে দুই খণ্ডে তার বই সেরেব্রাল ডায়নামিক্স প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেছিলেন, এম 'যখন মানুষকে উল্টো হয়ে হাঁটতে দেখলেন, তখন তিনি অবাক হয়েছিলেন বটে। তবে সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতি আহত ব্যক্তির দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে বা প্রায় পুরোপুরি এড়িয়ে যায়।
'পরে তারা যখন এরকম পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা টের পান, তখন তারা এ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হন না। বরং তারা এটিকে অস্থায়ী কিছু হিসেবে বিবেচনা করেন, এবং বিশ্বাস করেন এসব পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।'
নিউরোসাইকোলজিস্ট আলবার্টো গার্সিয়া মোলিনা মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসায় বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট গুটম্যান হাসপাতালে কাজ করেন। তিনি বলেন, নিউরোলজির ইতিহাসে অনেকগুলো দুঃখজনক প্রাকৃতিক পরীক্ষার নজির রয়েছে। যেমন ফিনিস গেজের উদাহরণের কথা বিবেচনা করা যাক।
গেজ কাজ করতেন আমেরিকান রেলরোডে। ১৮৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এক দুর্ঘটনায় একটি লোহার রড তার মাথার ভেতরে ঢুকে যায়। সৌভাগ্যক্রমে গেজ বেঁচে যান। কিন্তু তার চরিত্রে একটি অদ্ভুত পরিবর্তন তৈরি হয়। গেজ আগে একজন শান্তপ্রকৃতির লোক ছিলেন, কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি আক্রমণাত্মক ও অশ্লীল হয়ে ওঠেন।
মোলিনা ব্যাখা করেন, ১৯৩০-এর দশকে মস্তিষ্ককে ছোট ছোট বাক্স হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু তখনকার প্রচলিত ধারণা দিয়ে পেশেন্ট এম-এর এ ঘটনা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি ডাক্তার গঞ্জালোর জন্য। সেজন্য তিনি নিজের ব্রেইন ডায়নামিক্স থিওরি প্রদান করেন।
১৯৩৪ সালে ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনা এবং ১৯৩৫ সালে গ্যোটে ইউনিভার্সিটি অভ ফ্রাঙ্কফুর্টে পড়ালেখা করেন হুস্তো গঞ্জালো। তখন জার্মানিতে নাৎসিদের রাজত্ব। ১৯৩৬ সালের জুলাইয়ে স্পেনে বিদ্রোহের পর তিনি গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকের প্রতি অনুগত থাকেন এবং একটি ব্যাটালিয়নে ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরু করেন। যুদ্ধের আগে তিনি সারাদিন লাইব্রেরিতেই কাটাতেন।
পেশেন্ট এম আর হুস্তো গঞ্জালোর মধ্যকার বিভিন্ন চিঠির সুবাদে জানা গেছে, পেশেন্ট এম যুদ্ধে আহত হলেও নিয়মমাফিক পেনশন পাননি। 'আমার বাবা তাকে (পেশেন্ট এম) প্রশংসার চোখে দেখতেন, কারণ তিনি খুবই মেধাবি মানুষ ছিলেন। তিনি নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারেতন, খেতখামারে কাজ করতে পারতেন,' স্মৃতিচারণ করেন ইসাবেল গঞ্জালো।
ইসাবেলার হিসাব অনুযায়ী পেশেন্ট এম মারা গিয়েছেন ১৯৯০-এর দশকে। তার প্রকৃত পরিচয় কখনো প্রকাশ করা হয়নি।