ফাঁকা দোকান, ক্রেতার ভিড়: সোলার মার্কেট যেভাবে এক সপ্তাহে প্রায় পণ্যশূন্য হয়ে গেল
দোকানি: আমার এখানে কোনো সোলার আইটেম নেই, পাশের দোকানে যান।
আমি: আসলে আমি ক্রেতা না, একটু কথা বলতে চাই।
দোকানি: পাশের দোকানে যান।
এভাবেই আমাদের সোলার মার্কেটের দরজা দেখিয়ে দেওয়া হলো, অনেকটা রুক্ষভাবেই। এ থেকেই দেশের দুই বৃহত্তম পাইকারি সোলার মার্কেট, ঢাকার কাপ্তান বাজার কমপ্লেক্স ও নবাবপুরের সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের বর্তমান অবস্থা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়।
চলমান ডলার সংকটের কারণে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র হয় বন্ধ হয়ে গেছে অথবা জ্বালানির স্বল্পতার কারণে কম সক্ষমতায় চলছে। এর জেরে দেখা দিয়েছে ঘন ঘন লোডশেডিং। আর সেজন্যই বিকল্পের সন্ধানে সোলার মার্কেটে ভিড় জমাচ্ছে মানুষ। তবে গত সপ্তাহেই দোকানগুলোতে বেশিরভাগ সোলার পণ্য শেষ হয়ে গেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে পণ্য আসবে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে সোলার পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক ক্রেতাই খালি হাতে ফিরে গেছেন।
যে দোকানদার আমাদের পাশের দোকান দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি শুধু রিচার্জেবল বৈদ্যুতিক পাখা বিক্রি করছিলেন, তবু আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ফুরসত ছিল না তার। পণ্য প্যাকেজ করতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। কুরিয়ারে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাবেন ওগুলো।
পাশের দোকানে সোলার প্যানেলের স্টক আছে, তাই সেখানে ক্রেতাদের গিজগিজে ভিড়। মেহেরপুরের একজন ক্রেতা ১০০ ওয়াটের সোলার প্যানেল খুঁজছিলেন, কিন্তু দোকানদার জানালেন ২৫০ ওয়াটের নিচে কোনো প্যানেল নেই।
তারিক আহমেদ নামের ওই গ্রাহক বললেন, 'মেহেরপুরে আমার একটা ছোট গরুর খামার আছে। এই তীব্র গরমে গরুর জীবন বাঁচানোই বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ আমরা দিনে মাত্র ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাই। এখন একটা সোলার সিস্টেম বসাব ভাবছি।'
১০০ ওয়াটের সোলার প্যানেল না পেয়ে তারিক বাজারের আরেকদিকে চলে গেলেন।
দোকানদার সারোয়ার চৌধুরী জানালেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার পর থেকে এবং বিদ্যুৎবিভ্রাট শুরু হওয়ার পর থেকেই ফটোভোলটাইক প্যানেল, ব্যাটারি ও ইনভার্টারের মতো সৌরবিদ্যুতের আইটেমের বিক্রি আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে এসব পণ্যের দামও বেড়েছে।
সারোয়ার সৌরবিদ্যুৎচালিত স্ট্রিট ল্যাম্পের মতো সোলার পণ্যও আমদানি করেন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চাহিদা বেড়ে গেলেও তার বিপরীতে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। ডলার সংকটে এলসি (ঋণপত্র) খোলা কঠিন হয়ে গেছে। সেজন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পণ্য আমদানি করাও খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এক সপ্তাহ আগে যে ব্যাটারির দাম ছিল ১৬,৫০০ টাকা, এখন সেটার দাম বেড়ে হয়েছে ২১,০০০ টাকা। সোলার প্যানেলের দাম ছিল প্রায় ৪০ টাকা প্রতি ওয়াট, যা এখন ৫৫ টাকা।'
কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ড অবশ্য প্রতি ওয়াট ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি করছে।
সারোয়ারের দোকানে কোনো ব্যাটারি বা সোলার ইনভার্টার নেই। তবে তিনি আমাদের আরেকটি দোকান দেখিয়ে দিলেন। ওই দোকানে ব্যাটারি বিক্রি হয়।
শান্ত ব্যাটারি অ্যান্ড সোলার নামে ওই দোকানটির তাক অর্ধেক ভর্তি। অথবা একটু ঘুরিয়ে বললে, অর্ধেক খালি।
ব্যাটারি ডিলার সজলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি বেশ হতাশ। ছবিও তুলতে চাননি তিনি। পরে অবশ্য দোকানের তাকের ছবি তোলার অনুমতি দিয়েছেন আমাদের।
সজল বলেন, 'ব্যাটারির চাহিদা অনেক বেশি। আমাদের টার্গেট প্রতিদিন ১০০ ব্যাটারি বিক্রি করা, কিন্তু আমরা কোম্পানি থেকে পাচ্ছি মাত্র ১০টি।' সজল জানালেন, চাহিদা বেশি ও সরবরাহ কম থাকার কারণে দামও বেড়ে গেছে।
রাস্তার ঠিক অপরপাশে সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটেও একই অবস্থা। নিচতলায় একজন গ্রাহক একটি স্থানীয় ব্র্যান্ডের ব্যাটারি খুঁজছিলেন। ওয়ার্ল্ড পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং নামের দোকানে এই ব্যাটারি চাওয়ার পর বিক্রেতা তাকে জানালেন, ওই আইটেম এখন বাজারে নেই।
বাংলাদেশের ব্যাটারির বাজারে স্থানীয় নির্মাতাদেরই আধিপত্য, তাই ডলার সংকট এ শিল্পে প্রভাব ফেলার কথা না।
বিক্রেতা রাকিব বলেন, 'লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাটারি প্রস্তুতকারকরা উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারছেন না। এজন্যই ঘাটতি দেখা দিয়েছে।'
গত সপ্তাহে সোলার আইটেম ও আইপিএস নিয়ে আলোচনা করে, এমন বাংলাদেশি ফেসবুক গ্রুপগুলোর সদস্যরা সোলার সিস্টেমের বিষয়ে পরামর্শ ও দাম জানতে চেয়ে অজস্র পোস্ট করেছেন। অনেক সদস্য তাদের নতুন কেনা সোলার সিস্টেমের ছবি গ্রুপগুলোতে পোস্ট করছিলেন। লোডশেডিংকে হারাতে পেরে বেশ খুশি হয়েছেন তারা।
তবে ইদানীং সোলার মার্কেট অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় হতাশা বেড়েছে।
মাসুদ সরকার রানা বেশ অনেকদিন ধরে সোলার হোম সিস্টেমের জন্য পেইড কনসালটেন্সি সার্ভিস দিচ্ছেন। তিনি গোটা পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখেছেন।
সেই অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মাসুদ টিবিএসকে বলেন, 'সপ্তাহখানেক আগে কাপ্তান বাজার কমপ্লেক্সে আমি প্রচুর সোলার আইটেম দেখেছি। কিন্তু পরশু দেখলাম মাত্র কয়েকটা আইটেম বাকি আছে।
'এই মুহূর্তে মানসম্পন্ন পণ্য খুঁজে পাওয়াটা ভীষণ কঠিন। পণ্যগুলো একদিক দিয়ে বাজারে আসে, আরেকদিক দিয়ে ঝটপট বিক্রি হয়ে যায়। মানুষ অবিরাম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে।'
চলমান ডলারের সংকটের মধ্যে আর দুই সপ্তাহ পর বাজারের অবস্থা কী দাঁড়াবে?
সারোয়ার চৌধুরী বলেন, 'এই সংকট চলতে থাকলে আর এক সপ্তাহ পর আমাদের দোকানপাট বন্ধ রাখতে হবে।'
কাপ্তান বাজার কমপ্লেক্স ভবন-১ মালিক সমিতির সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন অবশ্য এখনই এরকম সিদ্ধান্তে আসতে রাজি নন।
জয়নাল বলেন, 'এটা বেশ কয়েকটা ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। লোডশেডিং চলতে থাকলে সোলার মার্কেটের সংকট আরও বাড়বে। আবহাওয়া একটু ভালো হলে সোলার সিস্টেমের চাহিদা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসতে পারে এবং সংকট কেটে যেতে পারে।'