ঊষর মরুভূমির মাঝেই খরস্রোতা নদী বানালো আবুধাবি!
সরুন, সরুন! পেছনে সরে আসুন। এবার সামনের দিকে; থামুন! নিচে নামুন, নিচে নামুন!
আমরা প্রতিটি বাক ঘোরার সাথে সাথে রাজেন্দ্র শ্রেষ্ঠার কণ্ঠ প্রতিমুহূর্তে আবুধাবির জেবেল হাফিত পর্বতমালা মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল। এরপর তিনি বলে উঠলেন,
'সে পড়ে গেছে! পড়ে গেছে সে!'
আমিই পড়ে গিয়েছিলাম। ঘূর্নায়মান জলের তোড় যখন আমাকে নিচের দিকে টেনে নিচ্ছিল, তখন রাজেন্দ্র শ্রেষ্ঠার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। অনেক কষ্টে পানির ওপর মাথা তুলতে পেরে আমি অন্ধের মতো হাত বাড়াচ্ছিলাম আশেপাশে কিছু একটা ধরে রাখার জন্য, যাতে আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারি।
"শান্ত হও, শান্ত হও', আমাকে বললেন রাজেন্দ্র। সব শব্দ-কোলাহলের মধ্যেও তার গলা শুনতে পেলাম। এরপর তিনিই আমাকে আবার ভেলার মতো সেই নৌকায় তুললেন। আমার হাতে প্যাডেল দিলেন এবং আমরা আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
এতক্ষণ যে নদীতে ভ্রমণের বর্ণনা দেওয়া হলো, সেটা কোনো সাধারণ নদী নয়। একদিকে আবুধাবির কঠিন-রুক্ষ পাহাড় এবং অন্যদিকে শুষ্ক মরুভূমির মধ্যে ৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত একটি পার্কের ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে এই নদী।
মরুভূমিতে যেখানে মানুষ এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার করে, সেই মরুভূমির বুকেই বহমান নদী যেন এক বিস্ময়!
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির সিটি সেন্টার থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টা দূরত্বে, মরুর শহর আল আইন-এ অবস্থিত আল-আন অ্যাডভেঞ্চার পার্ক 'ওয়াটার রাফটিং' (ভেলার মতো ছোট বাহনে চড়ে নদীতে ভ্রমণ), কায়াকিং ও সার্ফিং এর জন্য মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে সেরা জায়গা হিসেবে বিবেচিত।
এমন একটি অঞ্চল, যেখানে কোনো প্রাকৃতিক নদীই নেই এবং গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা থাকে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে, সেখানে এরকম একটি মানবসৃষ্ট নদীর দেখা পাওয়া অবাক হওয়ার মতোই বিষয়।
বিশ্বমানের ওয়াটারস্পোর্টস
এমন একটি দেশ, যেখানে সমুদ্রসৈকত, বরফ, এমনকি বৃষ্টিও কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে, সেখানে আল-আইনও একই দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পথেই এগিয়েছে।
আল-আইন এর এই পার্কে দর্শনার্থীরা পাবেন বিশ্বমানের কায়াকিং ও রাফটিং এর অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ। ১.২ কিলোমিটারের এই ওয়াটার চ্যানেল বরং কায়াকার ও রাফটারদেরদের এক চ্যালেঞ্জিং ভ্রমণের সুযোগ দিবে।
রাজেন্দ্র শ্রেষ্ঠা তেমনই একজন ওয়াটারস্পোর্টসপ্রেমী, যিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় রাফটিং করেই পার করে দিয়েছেন। তিনি পেশাদার পর্যায়ে নেপাল, ভারত, জাপান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাফটিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি দুইবার নেপালের জাতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
শ্রেষ্ঠা আল-আইন অ্যাডভেঞ্চার টিমে যোগদান করেন ২০১০ সালে এবং এই পার্কের কাজের পেছনে নিজের অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেন।
তিনি জানান, নিজের কাজের মধ্যে তার সবচেয়ে ভালোলাগার দিকটি হলো একই জায়গায় বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনাকর খেলাধুলার সুযোগ থাকা।
পেশাদারদের জন্য উত্তম জায়গা
আল আইন অ্যাডভেঞ্চার পার্ক এরই মধ্যে পেশাদার খেলোয়াড়দের জন্য একটি কেন্দ্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিভিন্ন ক্রীড়া মাধ্যমে যারা পেশাদার দক্ষতা আরও জোরদার করতে চান তারাও এখানে আসেন অংশগ্রহণ করতে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অ্যাথলেটদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এই পার্ক। এদের মধ্যে সার্ফিং চ্যাম্পিয়ন, রাফটার ও অলিম্পিক কায়াক টিমও রয়েছে। তাদের জন্য এই পার্ক একটি ভালো অনুশীলন কেন্দ্র।
প্রতিবছর নভেম্ভর থেকে মার্চের মধ্যে ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে স্লালোম কায়াকাররা (বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কায়াকিংয়ের ধরন) এই পার্কে আসেন পুরোদমে অনুশীলন করার জন্য। পার্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্বের ৩৫টি দেশ থেকে তিন শতাধিক অ্যাথলেট নিয়মিত এখানে আসেন।
এই পার্কে আয়োজিত উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ল্ড রাফটিং চ্যাম্পিয়নশিপ যেটি আন্তর্জাতিক রাফটিং ফেডারেশন ২০১৬ সালে আয়োজন করেছিল। এছাড়াও বেশ কয়েকটি স্লালোম কায়াকিং প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে।
ওয়াটার পার্ক
মরুভূমির মধ্যে একটি ওয়াটার পার্ক এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে এবং ব্যবস্থাপনাও করতে হচ্ছে খুব সতর্কভাবে।
পার্ক থেকে ৩০০ কিলোটিমার দূরে, দেশের অন্য একটি আমিরাত রাস আল খাইমাহ থেকে লবণমুক্ত পানি নিয়ে আসা হয় এই নদীতে। সমুদ্রের পানিকে মিঠা পানিতে রূপান্তরিত করে তারপর গুণগত মান বজায় রাখার মতো করে প্রস্তুত করে এই পানি নিয়ে আসা হয়।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা যেকোনো সময়ের জন্যই ১২.৪ মিলিয়ন গ্যালনের মতো পানি ব্যবহার করে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আবার চালু হয়েছে আল আইন অ্যাডভেঞ্চার পার্ক।
আর রাজেন্দ্র শ্রেষ্ঠার কাছে এই কাজে ফিরে যাওয়া মানে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া। তিনি বলেন, পার্ক কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা রয়েছে এখানকার কার্যক্রম আরও বাড়ানোর।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মরুভূমির রুক্ষ-শুষ্ক পরিবেশে আল আইন অ্যাডভেঞ্চার পার্ক যেন স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দেওয়ার মতো; আর সেইসঙ্গে অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ ক্রীড়া কার্যক্রম তো রয়েছেই।