ঢাকার মনোহর লুঙ্গিপল্লির গল্প
বাংলাদেশের পুরুষদের জাতীয় পোশাক কী? এই প্রশ্নের হয়তো গৎবাঁধা কোনো উত্তর নেই। কিন্তু যদি পুরুষদের সবচেয়ে পরিহিতি পোশাক কোনটি জিজ্ঞেস করা হয়, তবে উত্তর হিসেবে হয়তো বলা হবে লুঙ্গি। যদিও বিশ্বায়ন কিংবা পশ্চিমাকরণের প্রভাবে সংস্কৃতিতে বেশ পরিবর্তন আসছে, তবুও পোশাক হিসেবে লুঙ্গি পুরুষদের নিকট এখনো সমান জনপ্রিয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে লুঙ্গিশিল্প বা লুঙ্গির বাজার বেশ বড়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই শিল্পের অনেকটাই এখন যান্ত্রিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। তবে কিছু পুরোনো পদ্ধতি এখনো চোখে পড়ে। যেমন, পরিবারের সদস্যদের নিজ হাতে সুতা রং করা, রং করা সুতাগুলো ঐতিহ্যবাহী কাঠের তাঁতে বসানো এবং পরিশেষে নির্ভুলভাবে বিভিন্ন নকশা এবং কারুকাজ ফুটিয়ে তুলতে তুলতে লুঙ্গি বুনন করা।
হাতে তৈরি তাঁতশিল্পের কথা উঠলেই হয়তো যে কারও সিরাজগঞ্জ কিংবা টাঙ্গাইলের কোনো তাঁতপল্লির ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কিন্তু রাজধানীর অদূরেই ঢাকা জেলার দক্ষিণের উপজেলা দোহার ও নবাবগঞ্জেই রয়েছে হাতে তৈরি তাঁতশিল্প।
যদিও সময়ের সাথে সাথে হস্তচালিত তাঁতকে সরিয়ে তার জায়গা দখল করেছে বিদ্যুৎচালিত সেমি-অটোমেটিক তাঁত; তা সত্ত্বেও, ঢাকার এই দুই উপজেলার শত শত পরিবার এখনো হস্তচালিত তাঁতের সাহায্যে জীবিকার সংস্থান করে আসছে।
শুধু তা-ই নয়, হাতে চালিত তাঁতযন্ত্র দিয়ে তৈরি লুঙ্গিগুলো যান্ত্রিক তাঁতযন্ত্র দিয়ে তৈরি লুঙ্গি অপেক্ষা বেশি সূক্ষ্ম এবং দামে চড়া।
বাহারি বুননের গ্রাম
ঢাকার দোহার উপজেলার জয়পাড়ায় অহরহই দেখা যায় লুঙ্গির কারখানা। কেউ একজন এলাকাটিতে ঢুকে যেকোনো দিকে নজর করলেই লুঙ্গিশিল্পের সাথে যুক্ত কোনো না কোনো কর্মকাণ্ড তার চোখে পড়বে।
রায়পারা ও ছনটেক এলাকায় প্রবেশ করামাত্রই আমরা শাহেলা ও রহিমা নামের দুই নারীর দেখা পাই। এ দুই নারী বাড়ির উঠানে একাধিক ববিনের সাথে লাগানো সমান্তরাল বিন্যাসে থাকা ফ্রেমে সুতা বুনছিল (স্থানীয় ভাষায় বলে 'বও গাঁথা')। এর সাহায্যে কাপড়ের প্রাথমিক সুতাবিন্যাস করা হয়। এটা লুঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ যেখানে লুঙ্গির ডিজাইন আবছা আবছা দেখা যায়। পরে সেটিকে তাঁতে তুলে দস্তার (হাতের মুষ্টিতে যে গিঁটপাকানো কাপড় ধরা হয়) টানে মাকুর ঘুরানিতে তাঁতশ্রমিকেরা বাকি সুতার সংযোজন ঘটায়।
বাইরে সরু এক রাস্তায় দুই ব্যক্তি লম্বা করে সাজানো সুতোগুলো টানার আগে তাতে ভাতের মাড় দিচ্ছিলেন। পরের ধাপে প্রায় চার ফুট লম্বা প্রাকৃতিক আঁশ দিয়ে তৈরি ব্রাশ দিয়ে সুতাগুলো ব্রাশ করা হয়। এতে করে সুতাগুলো আরও শক্তিশালী ও মসৃণ হয়। এর ফলে সুতায় আর কোনো ফাইবার অবশিষ্ট থাকে না।
গ্রামগুলোর যেকোনো জায়গায়তে গেলেই লুঙ্গি তৈরির মোট পাঁচটি ধাপ চোখে পড়বে। এগুলো হলো, সুতার ব্লিচিং ও ডায়িং, সুতা মাড়াইয়ের পর জটপাকানো সুতাগুলোকে ছাড়ানো, বাঁশ বা শক্ত কাঠে রেখে সুতাগুলোকে চিপে অপ্রয়োজনীয় রং বা ডায়িং বের করা এবং সুতাগুলো চরকার সাহায্যে ববিনে সুতা তোলা।
লুঙ্গি তৈরির এ প্রতিটি ধাপ একদম ভোর থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত চলে। এক্ষেত্রে দেরি করে গেলে হয়তো কোনো একটি ধাপ দেখা যাবে না। গ্রামগুলোতে তাঁতের খটর খটর শব্দ শুনেই দূর থেকে ঠাহর করা যায় কারখানা কোনদিকে। আর এই খটর খটর শব্দ তৈরি হয় মাকুর ঘুর্ণনে। মাকু থেকে সুতা বের হয়ে লম্বালম্বিতে রাখা বও-এ (পূর্বে দু'জন মহিলা উঠানে যেটা বুনছিল) আড়াআড়িভাবে সুতা ঢুকে যায়।
২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারের তাঁত বোর্ডের এক জরিপ অনুযায়ী, দোহারে প্রায় ৩৮৬ জন ও পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জে ২০৭ জন তাঁতি রয়েছে। দুই উপজেলা মিলে এসব তাঁতিদের প্রায় ৭৪১টি তাঁত রয়েছে। আগে পার্শ্ববর্তী রুহিতপুর ও কেরানীগঞ্জেও তাঁত ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেগুলো নেই বললেই চলে।
তবে আজও রুহিতপুরি লুঙ্গির নাম ও খ্যাতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে। এই লুঙ্গিগুলো বর্তমানে প্রধানত দোহার ও নবাবগঞ্জেই তৈরি করা হয়। প্রতি বছর এই দুই উপজেলায় প্রায় আট লাখ পিস উন্নতমানের লুঙ্গি উৎপাদিত হয়। এই লুঙ্গিগুলোর মোট বাজারমূল্য প্রায় ১২১ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে তাঁত বোর্ডের দোহার অঞ্চলের লিয়াজোঁ অফিসার আশিস কুমার বলেন, "উৎপাদিত লুঙ্গির সংখ্যা কিছু কিছু ফ্যাক্টরির জন্য হয়তো আরও কম হতে পারে। তবে পূর্বে এই সংখ্যা আরও বেশি ছিল।"
অন্যদিকে জয়পাড়ার খালপাড় এলাকার তাঁতি (যার মালিকানায় তাঁত থাকে) মোহাম্মদ আলমগীর হোসাইন বলেন, "একটা সময় এলাকাটির প্রায় ৮০ ভাগ পরিবার তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত ছিল।"
কম মজুরি, অধিক পরিশ্রম
তাঁত গ্রামগুলোতে কর্মচঞ্চলতা সময়ের সাথে সাথে যেন কমে এসেছে। এর পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ।
শ্রমিকদের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম পর্যায়েই পরিচয় হয় ৫৫ বছর বয়সী শাহেলা নামের এক নারীর সাথে। আমাদের দেখামাত্রই সুতা বুনতে থাকা অবস্থায় তিনি তার জোগানদারকে বলেন, "তারা আমাদের ছবি তুলবেন, এর ফলে আমরা চাকরি পাব। তখন আমাদের আর এগুলো করতে হবে না।"
আমরা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি যে, "আপনারা এই কাজ কেন আর করতে চান না?" পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি যে, তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকেরা হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও খুব কম মজুরি পান।
সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করে শাহেলা মাত্র ৪০ টাকা মজুরি পান। আর তার জোগানদারেরা পায় মাত্র ৬০ টাকা।
চিতাঘাটা এলাকার মাহমুদা নামের আরেক নারী তাঁতের জন্য সুতা প্রস্তুত করছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি এ কাজের জন্য দৈনিক ১০০ টাকা মজুরি পান।
অন্যদিকে মূল কারিগর, অর্থাৎ তাঁতিরা সবচেয়ে বেশি মজুরি পেয়ে থাকেন। মূলত এক পিস ফেব্রিক তৈরি করলে তাদের ৯০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। এক পিস ফেব্রিক তৈরি করতে প্রায় দুইদিন লেগে যায় এবং সেই ফেব্রিক থেকে মোট ছয়টি লুঙ্গি পাওয়া যায়। কেউ যদি সপ্তাহে মোট ছয়দিন কাজ করে, তবে সর্বসাকুল্যে ২৭০০ টাকা আয় করতে পারবে।
একটি লুঙ্গি তৈরির পুরো প্রক্রিয়ার পেছনে প্রায় ১০ জন শ্রমিক যুক্ত থাকেন। এদের কম মজুরি দেওয়া সত্ত্বেও, মোট খরচ কারখানার মালিকের জন্য খুব একটা কম নয়। বরং একটা মোটামুটি লাভ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়।
ফলশ্রুতিতে তাঁত মালিকেরা চাইলেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে পারে না। ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই পূর্বপুরুষদের পেশায় আর যুক্ত হচ্ছে না।
৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ নারী ফিরোজা বলেন, "আমরা সন্তানেরা এখানে কাজ না করে বরং রিকশা চালালে ভালো হতো। কিংবা বিদেশে চলে গেলে।"
ফিরোজা জানান, তার দাদা, শ্বশুর, স্বামী সকলেই এই হাতে তৈরি লুঙ্গি উৎপাদনের সাথে যুক্ত ছিলেন। এটা বেশ খাটুনির একটা কাজ।
ফিরোজার কথার সাথে সুর মিলিয়েছেন অন্য অনেক শ্রমিক ও তাঁতিরাও। দোহারের চিতাঘাটা এলাকার তাঁতি আবুল কালাম বলেন, "এই শিল্প আর বেশিদিন টিকবে না।"
অনেক দিন ধরেই অঞ্চলটিতে লুঙ্গির উৎপাদন কমে পড়তির দিকে। এছাড়াও, শ্রমিকের অভাবও দেখা দিয়েছে। আমরা এমন কয়েকজন তাঁতির দেখা পাই যারা মূলত কুমিল্লার অধিবাসী।
ঈদুল আযহার দুই সপ্তাহ পরেও সকল কারখানা সীমিত সক্ষমতা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু তখনো অনেক শ্রমিক কাজে ফেরেননি।
বিদ্যুৎচালিত তাঁতের অগ্রগতি যেন খাল কেটে কুমির আনা
দোহার এলাকার অন্তত চারটি বৈদ্যুতিক তাঁতযন্ত্রের কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় প্রায় ৩০ টি বৈদ্যুতিক তাঁত রয়েছে। প্রতিটি তাঁত একটি করে ফ্যাব্রিক তৈরি করতে পারে যা থেকে একই রকমের প্রায় ৩০০ টি লুঙ্গি তৈরি করা যায়। যেখানে হস্তচালিত তাঁতের একটি ফ্যাব্রিক থেকে মাত্র ছয়টি লুঙ্গি তৈরি করা যায়। একইভাবে বৈদ্যুতিক ঘুরন্ত চাকাগুলো হাতে চালিত যন্ত্রগুলোর তুলনায় বেশ বড়।
এছাড়াও হস্তচালিত তাঁতের তুলনায় যান্ত্রিক তাঁতের লুঙ্গি তৈরির খরচও বেশ কম। শ্রমিক ও মিল মালিকদের ভাষ্যমতে, এই খরচ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম।
তবে এতসব সুবিধার মাঝেও যান্ত্রিক তাঁতের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমরা বেশ ক'জন হস্ত চালিত তাঁতি কাছে জানতে চাই তারা এখনো কেন যান্ত্রিক তাঁত দিয়ে কাপড় বোনানো শুরু করছেন না।
রিমা বেগম নামের এক নারী বর্তমানে নিজের পারিবারিকসূত্রে পাওয়া হাতে চালিত তাঁত কারখানার দেখভাল করছেন। তিনি বলেন, "যন্ত্র চালিত তাঁত কারখানা স্থাপন করতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগের দরকার হয়। একইসাথে প্রয়োজন বেশ বড় জায়গা।"
এবার আসি লুঙ্গির গুণের আলাপে। হস্তচালিত তাঁতেবোনা লুঙ্গির গুণগত মান যে যন্ত্রে উৎপাদিত লুঙ্গির তুলনায় বেশি, তা নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ থাকার কথা না। আর তাই হাতে তৈরি লুঙ্গির চাহিদা আজও ব্যাপক।
হাতে তৈরি লুঙ্গি বিক্রির অনলাইন শপ 'বাংলার লুঙ্গির' সহ-প্রতিষ্ঠাতা সজীব বর্মণ বলেন, "নবাবগঞ্জ-দোহারের হাতে তৈরি লুঙ্গি নরম, আরামদায়ক এবং খুবই টেকসই। যেহেতু এসব লুঙ্গির ফ্যাব্রিক দীর্ঘ সময় ধরে টেকে, তাই এর রঙও হয় দীর্ঘস্থায়ী।"
সজীব বর্মণ জানান, অত্র এলাকায় হাতে তৈরি লুঙ্গির ক্ষেত্রে ৮০ থেকে ১০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়। যেটা শুধু দেশের ক্ষেত্রেই নয়, বরং দেশের বাইরে আশেপাশের অঞ্চলেও খুব কম চোখে পড়ে। মূলত স্থানীয় মানুষদের শত শত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে এমন মানের ফ্যাব্রিক তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
এতসব ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও হস্তচালিত তাঁতশিল্পের প্রবণতা কমছে আর যান্ত্রিক তাঁত ফ্যাক্টরির চাহিদা বাড়ছে।
তবুও, আব্দুল মান্নান নামক এক ব্যক্তি মোট সাতটি গতানুগতিক ধারার পিট তাঁত (গর্ত তাঁত, গর্ত খুড়ে তাঁত বসানো হয় – মাটির আর্দ্রতা দরকার পড়ে এজন্য) দিয়ে একটি কারখানা চালু করেছেন। তিনি লুঙ্গির পাইকারি ব্যবসা করতেন। দোহার এলাকার লুঙ্গির পুরনো পাইকারি বিক্রেতারা বরং বেশ ধনী। তাদের বাড়িতে থাকা আধুনিক ডুপ্লেক্স ঘরগুলো যেন তারই প্রমাণ।
তবে বর্তমানে নতুন নতুন পাইকারি বিক্রেতা বাজারে প্রবেশ করেছে। ফলে পুরাতন পাইকারি বিক্রেতারা আর আগের মতো ব্যবসা করতে পারছেন না। ঠিক তেমনি একজন এই আব্দুল মান্নান।
আব্দুল মান্নান জানান, তিনি তার ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে নতুন করে কারখানা খুলেছেন। একথা বলার সময় তার কণ্ঠে বিদ্যমান হতাশা কেন যেন তার উদ্যোগ বা কাজেকর্মে ছাপ ফেলতে পারল না।
সুতার পোঁটলা নিয়ে কাজ করতে করতে আব্দুল মান্নান জানান, সুতা ও ডাইয়িংয়ের খরচ বর্তমানে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে।
বিদ্যমান সমস্যা কীভাবে ঠিক করা যাবে এমন প্রশ্ন করা হলে জনাব মান্নান উত্তরে বলেন, "সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তাঁতিরা যেন ন্যায্য দামে সুতা এবং ডায়িং (কাপড় রঙ করার কেমিকেলস) পায়।"