হাটহাজারীর লাল মরিচ কেন সবার চাই!
লাল মরিচ, হালদা মরিচ, মিষ্টি মরিচ! হরেক রকম নাম চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বিখ্যাত এ মরিচের। কিন্তু মরিচ আবার মিষ্টি হয় কী করে? যে মরিচের ঝাল কম, যে মরিচ কাঁচা বা শুকনা যেকোনো অবস্থাতেই আচার বানিয়ে অনায়াসে খেয়ে ফেলা যায়, যে মরিচের আছে মিষ্টি ঘ্রাণ- সেটাই জনমুখে পরিচিত মিষ্টি মরিচ হিসেবে। প্রতিটি নামের সাথে এই মরিচেরও যেন অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। লাল টকটকে রঙ, কম ঝাল এবং মিষ্টি ঘ্রাণ-এই তিনের সমন্বয়ে এই মরিচ।
এ মরিচের জনপ্রিয়তার কারণ জানতে চাইলে হাটহাজারীর মরিচসহ নানান ঐতিহ্যবাহী জিনিস নিয়ে নিজ উদ্যোগে কাজ করে চলা নারী উদ্যোক্তা কমরো তাজ টিবিএসকে বলেন, "এই মরিচের রঙ এতই লাল যে প্রথমে দেখে মনে হবে হয়তো খুব ঝাল এই মরিচের তরকারি। কিন্তু যখনই খেতে যাবে তখনই এই ভ্রান্তি কেটে যাবে। তারকারিতে স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি এ মরিচ তরকারির রঙ এতই সুন্দর করে তোলে যে কারো পক্ষে এর প্রতি লোভ সামলানো রীতিমতো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ মরিচের সাথে এ মরিচের পার্থক্য ঘ্রাণে, রঙে, ঝালে।"
৭৫০০ বছর পূর্বে আমেরিকায় প্রথম মরিচের ব্যবহার শুরু হলেও পর্তুগিজদের হাত ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে মরিচের ব্যবহার শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় বাঙালী তা আপন করে নিয়েছে নিজেদের মত করে। এই উপমহাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে রান্নার অন্যতম সংযোজন মরিচ। রান্নায়, ফুচকা-চটপটি সাজানোর প্লেটে, বিভিন্ন রকমের ভর্তায়, ঝাল মুড়ি মাখানোয়- সবখানে মরিচ থাকা চাই। যেকোনো বাঙালির মতে মরিচই একমাত্র খাবার যা পুরো রান্নার চিত্রপট পালটে দিতে পারে নিমিষেই।
গ্রীষ্ম মৌসুমেই সংগ্রহ করতে হয় এ মরিচ
মূলত কার্তিক-অগ্রহায়ণে এ মরিচের চারা রোপন করা হয় এবং মরিচ পরিপক্ক হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে।
'বারো মাসে বারো ফল, না খেলে যায় রসাতল'- খনার এই বচনের মতো বলতে হয়, যদি মৌসুম থাকতে হাটহাজারীর লাল মরিচ না খাওয়া হয়, তবে পস্তানো ছাড়া উপায় নেই। কারণ এই মরিচের চাহিদা এতই বেশি যে অন্য কোনো সময়ে এই মরিচ পাওয়া দূর্লভ। এমনকি মৌসুম শেষ হলে কৃষকের ঘরেও মজুদ থাকে না এ মরিচ।
তাহলে এত মরিচ যায় কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে হাটহাজারারীর মরিচ চাষী মো. সেলিম বলেন, "এ মরিচ যখন আমরা বাজারে নিয়ে আসি তখন দেখা যায় কিছু কোম্পানীর লোকজন এসে একসাথে অনেক মরিচ কিনে নিয়ে যায়। এভাবেই সব মরিচ খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়।"
'হালদা মরিচ' নাম কেন?
হাটহাজারীর এই লাল মরিচ সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত 'হালদা মরিচ' নামে। ছেলে-বুড়ো সবাই এক হালদা মরিচ নামেই সম্বোধন করে থাকেন। এই নামের পেছনেও আছে খুব মজার কাহিনী।
মূলত হালদার পাড়ে এই মরিচের চাষ হয়ে থাকে। চাষীরা মনে করেন হালদার পাড়ের মাটির উর্বরতার কারণেই এই মরিচ এত বেশি পরিমাণে চাষ হয়। তাছাড়া এই মরিচ মিষ্টি হওয়ার পেছনেও তারা হালদার পাড়ের মাটি, হালদার পানি এবং আবহাওয়াকে অন্যতম প্রধান কারণ মনে করেন।
হালদার পাড়ে এই মরিচ বেশি চাষ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ৪০ বছর ধরে এর চাষ করা মো. হারুন বলেন, "এই মাটি অন্যসব মাটির মতন নয়। এই মাটিতে বালি ও কাদার সমান মিশ্রণ আছে। কোনো মাটি বেশি কাদাযুক্ত না, আবার শুধু বালিযুক্তও না। কাদামাটি ও বালির মিশ্রণ আছে বলেই এই মাটিতে হালদা মরিচ হয়ে থাকে।"
তাছাড়া এই চাষীর মতে, হালদা মরিচ হাটহাজারী ছাড়া অন্য কোথাও চাষ হওয়া সম্ভব নয় বলে জানান। কারণ এই মরিচ গাছ অতি বৃষ্টি এবং অতি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মরিচ চাষ
এ মরিচ চাষের সাথে যারা সম্পৃক্ত প্রত্যেকেই এই কাজ করে থাকেন তাদের বংশ পরম্পরায়। তাই মরিচ চাষী মো. হারুন এবং মো. সেলিমের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৫৫ বছর বয়সী মো. হারুন এই মরিচ চাষ করছেন ৪০ বছর সময় ধরে। খুব ছোটবেলায় এই কাজে নিযুক্ত হন তিনি। এই মরিচ চাষ তার কাছে এখন শুধুই আর পেশা নয়। কোনো এক দুর্ঘটনায় হাতের দুটি আঙুল হারালেও এখনো একইরকম উদ্যমে এই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তার মতে, "এই কাজের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেছে। শুধু যে টাকার জন্য এই কাজ করি তা নয়। কাজ না করলে কেমন জানি খালি খালি লাগে। এই কাজ করলে শান্তি লাগে, ভালো সময় কাটে।"
একইভাবে ৬০ বছর বয়সী সেলিমও ৪০ বছর এর বেশি সময় ধরে করে যাচ্ছেন এই মরিচ চাষ। তাদের বাবা, দাদা, দাদার বাবা সবাই এই কাজে সংযুক্ত ছিলেন বলে জানান তারা। এই কাজে তাদের ক্লান্তি নেই বরং এই কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখলেই যেন ক্লান্তি গ্রাস করে তাদের!
লাল মরিচে অনন্য মেজবান
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানী রান্নারও অন্যতম প্রধান উপকরণ এই লাল মরিচ। মেজবানী রান্নার অসাধারণ রঙ এবং স্বাদের পেছনে গোপন তরিকাটি হলো এই মরিচের ব্যবহার। অনেকেই মেজবানী রান্নার এমন অসাধারণ রঙ এবং অসাধারণ স্বাদে বিমোহিত হলেও জানতেন না ঠিক কোন কারণে এমনটা হয়ে থাকে।
মরিচ চাষী মো. হারুন বলেন, "এই এলাকায় যত মেজবান হয় সবখানে এই মরিচ ব্যবহার করা হয়। এই মৌসুমে আমি কিছু মরিচের গুঁড়াও করে রাখি যাতে মেজবান উপলক্ষে বিক্রি করতে পারি। অনেকেই মেজবানী রান্নার জন্য চার, পাঁচ, আট বা দশ কেজি করে মরিচের গুঁড়া আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যান। এভাবে প্রায় আমি ৮০ কেজি মরিচের গুঁড়া বিক্রি করেছি।"
লাল মরিচের লোভনীয় আচার
শুধু কি রঙে, স্বাদে, ঘ্রাণেই সীমিত এই মরিচের গুণ? এমনটা ভাবলে ভুলই ভাবছেন। এই মরিচ দিয়ে তৈরি হয় অসাধারণ স্বাদের আচার যা খাওয়ার পরে মুগ্ধ হতে বাধ্য হবে যেকেউ। লাল মরিচ যখন হলুদাভ সবুজ অবস্থায় গাছে থাকে তখন তা আচার হিসেবে বানানোর জন্য তুলে নেওয়ার উপযোগী হয়ে উঠে।
এই মরিচের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো তা ক্যাপসিকাম ব্যতীত অন্য যেকোনো মরিচের তুলনায় আকারে অপেক্ষাকৃত বড়। সুন্দর আকারের কারণে এই মরিচের আচার দেখতেও অনেক লোভনীয় হয়।
হালদা মরিচের আচার দেশের নানা প্রান্তের মানুষের নিকট জনপ্রিয় করে তুলতে বদ্ধপরিকর তরুণ নারী উদ্যোক্তা কমরো তাজ। কীভাবে এই মরিচের আচার তৈরির চিন্তা মাথায় আসলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এই মরিচ কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থাতেই ঝাল অনেক কম, কিন্তু খেতে অসাধারণ। এমন কম ঝালের মরিচকে আচার বানালে কেমন হয় তা দেখতে আচার বানিয়ে দেখলাম তা খেতে অন্যান্য অনেক আচারের তুলনায় বেশ মজাদার। অনেকেই ভাবেন মরিচের আচার মানেই তা অনেক ঝাল হবে। কিন্তু এই মরিচের বেলায় একেবারে তার ব্যতিক্রম। অনেকেই খেয়ে বুঝতেই পারবে না এটি আসলেই মরিচের আচার এবং এই লাল মরিচের আচার এতই সুস্বাদু যে খাওয়ার পরেও আচারের স্বাদ লেগে থাকবে মুখে।"
অতি দামী এই মরিচের ক্রেতাও বেশি
হাটহাজারীর এই লাল মরিচ বা হালদা মরিচের দাম সাধারণত অন্যান্য অনেক মরিচের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে ক্রেতার কমতি নেই। ৬০০-৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় হাটহাজারীর মিষ্টি।
মরিচ চাষী সেলিম বলেন, "এই মরিচের চাহিদা এতই বেশি যে অনেক সময় বিদেশে যারা থাকে তারাও এই মরিচ কিনে নিয়ে যায়। আমার কাছ থেকে অনেকেই এই মরিচ বাইরে খাওয়ার জন্য কিনে নিয়েছে। দাম হলেও কেনে কারণ এমন টকটকে লাল ও মিষ্টি মরিচ বাংলাদেশে আর কোথাও নেই।"
বাজারে এই মিষ্টি মরিচ ছাড়াও কুমিল্লার ঝাল মরিচও বিক্রি হয়। কুমিল্লার এই মরিচ দামে কম হলেও ক্রেতারা সেটা কেনে কম।
যারা চাষী তারাই ব্যবসায়ী
এই মরিচ যারা চাষ করেন তারাই বাজারে নিয়ে সেটা আবার বিক্রির কাজ করেন। ফলে চাষীরা খুশিমনে ন্যায্য দামেই বিক্রি করতে পারেন এই মরিচ।
মরিচ চাষী সেলিম বলেন, "আমরাই চাষ করি আবার আমরাই বাজারে মরিচগুলো বিক্রি করতে নিয়ে আসি। প্রায় সব চাষীরাই এমনটা করে থাকে। যদি কেউ আমাদের কাছ থেকে মরিচ কিনে বিক্রিও করে, তাহলে কেজিতে ১০-২০ টাকার দামের পার্থক্য থাকে। এর বেশি দামের পার্থক্য সাধারণত হয় না।"
ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রকল্প গ্রহণ
চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান ইত্যাদি এলাকায় হালদা নদীর অববাহিকায় এই লাল মিষ্টি মরিচের চাষ হয়ে থাকে। তবে এই মরিচের সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হাটহাজারী উপজেলায় হয়। হাটহাজারী উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান মাহমুদ জানান, প্রায় ২২০ হেক্টর জমিতে এই মরিচের চাষ হয়ে থাকে এবং মরিচের মোট উৎপাদন ৩৩০ মেট্রিক টন।
উপজেলা কৃষি অফিসার, কৃষিবিদ মো. আল মামুন শিকদারের মতে, এখন আর আগের মত মরিচের উৎপাদন হয় না। এর কারণ হিসেবে তিনি পানির সংকটকে দায়ী করেন। মরিচ ভালোভাবে উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন সে পরিমাণ পানি পাওয়া যায় না। হালদার পানি কমে গেলে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তাই পানির সমস্যাকে অন্যতম সমস্যা হিসেবে মনে করেন তিনি।
এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে হালদার পানি মরিচ ক্ষেত পাশাপাশি নিয়ে আসার জন্য একটি কৃত্তিম খাল তৈরি করা হয়। এই খালে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টির পানি ও হালদার পানি এসে জমা হয়। তিনি বলেন, "পানি বৃদ্ধি পেলে উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। পানির সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমরা যা যা করা যায় করছি। টেকনিক্যাল সাপোর্ট থেকে শুরু করে মরিচ গাছের রোগ বালাই সম্পর্কে কৃষকদের জন্য ট্রেনিং সেশন এর ব্যবস্থা, মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগ, কৃষকদের সতর্কীকরণসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি আমরা।"
হাটহাজারীর এই মিষ্টি মরিচকে বিশ্বব্যাপী একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সবটাই তারা করছেন বলেও দাবি তার। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি অনলাইনে কৃষকদের জন্য গ্রুপ তৈরি করে তাতে কৃষকদের যুক্ত করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছেন। তিনি বলেন, "কোনো তথ্যের জন্য কোনো কৃষককে আসতে হবে না। কৃষকরা অনলাইনে যুক্ত থাকবে এবং তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য তাদের হাতের নাগালেই থাকবে।"
শুধু কৃষিবিদ মামুন শিকদারই নন, এই মরিচকে বিশ্ব দরবারে জনপ্রিয় করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তা রঞ্জন বিবেক। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই মরিচ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, "কোথাও সুযোগ পেলেই আমি এই মরিচকে উপস্থাপন করি মানুষের কাছে। আমার কাছে এই মরিচ আমাদের হাটহাজারীর ঐতিহ্যের মত এবং সেটা রক্ষা করতে যা যা করার দরকার তা আমি করে যাব।"