ভারতবর্ষে একসময়ের ‘নিষিদ্ধ’ খাবার বিস্কুট যেভাবে পরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে
মিষ্টি, ঘন চা; হোক তা আদা ও এলাচে দেওয়া কিংবা দুধ মেশানো, তাতে বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ার অনুভূতিই আলাদা। মিষ্টি, সল্টি, ক্রিমি কিংবা টোস্ট; যেমন বিস্কুটই হোক না কেনো চা-এর সঙ্গে তা গ্রোগ্রাসে গেলা যায়। কিন্তু শতবর্ষও আগেও বিষয়টি একই রকম ছিল না। তখন অনেক ভারতীয়র কাছে বিশেষ করে বর্ণপ্রথা বিরাজমান সমাজে বিস্কুট ছিল একরকম নিষিদ্ধ খাবার।
ভারতীয়রা শত শত বছর ধরেই বিস্কুট জাতীয় খাবার; তা হয়তো অন্য কোনো নামে বা রন্ধনপ্রণালীতে তৈরি করে এবং খেয়ে আসছেন। আরব, অতপর পারস্য এবং পরে ইউরোপীয়; নতুন নতুন শাসকের আগমনে স্বাদ এবং প্রস্তুত প্রণালীতে পরিবর্তন এসেছে কেবল। তবে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে বিস্কুট এবং চা-এর মিশেলের সঙ্গে পরিচয় এবং তা জনপ্রিয়তা পায় ব্রিটিশ আমলে।
'দ্য বিস্কিট: দ্য হিস্ট্রি অব আ ভেরি ব্রিটিশ ইনডালজেন্স' বইয়ের লেখক খাদ্য ইতিহাসবিদ লিজি কলিহাম বলেন, গোয়া এবং পন্ডিচেরির বেকারিতে যখন পর্তুগিজ এবং ফরাসি বিভিন্ন খাদ্য তৈরি শুরু হয় তখনই ব্রিটিশদের দখলে থাকা প্রধান শহর কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে ইংরেজদের কেক এবং বিস্কুটের প্রচলন শুরু হয়। হান্টলে অ্যান্ড পালমার্স-এর মতো কোম্পানি তখন ব্রিটেন থেকে ভারতে বিস্কুট আমদানি করতো। যদিও বিস্কুটের বাজার ছিল সীমাবদ্ধ। বিস্কুট তখন শ্রমিক শ্রেণির নাগালের বাইরে থাকা অভিজাত এক নাস্তা হিসেবে পরিচিত ছিল। আর অন্যদিকে, বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী হিন্দুদের জন্য বিস্কুট ছিল নিষিদ্ধ।
হিন্দু সমাজে খাদ্য ধর্মীয় এবং নৈতিক ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশুদ্ধতা এবং অপবিত্রতা যাচাইয়ের বিষয়টি বর্ণপ্রথার সর্বস্তরে বিরাজমান ছিল। অর্থাৎ ভারতীয় ইতিহাস অন্যদের চর্চিত বিষয়কে আত্তীকরণের ইতিহাস হলেও শুরুতে নতুন খাদ্য বাধার মুখে পড়ে। উনবিংশ শতকে, একজন গোঁড়া হিন্দু স্বাভাবিকভাবেই বিস্কুটকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাদের কাছে বিস্কুট ছিল ম্লেচ্ছদের (দখলদার বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দ) খাবার। আর সামাজিক ও বিভিন্ন শ্রেণির নিয়মের কারণে অনেক হিন্দু অশুদ্ধ হিসেবে রুটি, পাখির মাংস, বরফ এবং লেমনেডের মতো বিস্কুটও খেতেন না। এর প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পন করলে তার জন্মগত জাত থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আশঙ্কাও ছিল।
বাঙালী স্বাধীনতা সংগ্রামী, লেখক ও শিক্ষাবিদ বিপিন চন্দ্র পল তার স্মৃতিকথা 'সত্তর বৎসর' এ পূর্ববঙ্গের কাছাড় জেলায় বিস্কুট নিয়ে বিশৃঙ্খলার কথা লিখেছেন। বইতে তিনি লেখেন, নতুন ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবৃত্ত শ্রেণির মানুষজন বাড়িতে চা-এর সঙ্গে বিস্কুট খায় এমন তথ্য দ্রুত সিলেট থেকে কাছাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এসব 'বিদ্রোহীরা' কঠোর প্রায়শ্চিত্ত না করলে তাদের বিতাড়িত হওয়া থেকে বাঁচার সুযোগ নেই বলা হয়েছিল তখন।
বেকারিতে কাজ কিংবা মালিকানাতেও আপত্তি
বিস্কুট নিয়ে এতটাই গোঁড়ামি ছিল যে, সুরাট ও ভারুচে; যেখানে ১৬২৩ সালে ব্রিটিশরা প্রথম বেকারি স্থাপন করে সেখানে উঁচু বর্ণের হিন্দুরা কাজ করতো না। কারণ সেখানে তাড়ি এবং ডিম ব্যবহার হতো। এগুলোকে অপবিত্র বলে মনে করা হতো। মহাবংশী: দ্য সাকসেস স্টোরি অব আ শিডিউল কাস্ট-এ লেখক ভিএস পারমার এ কথা লেখেন।
তখন মুসলমান ও নিচু বর্ণের হিন্দুরা সেখানে কাজ করতো। এটিও আবার উচ্চ জাতের হিন্দুদের বেকারি এড়িয়ে চলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ জাতপ্রথায় নিচু জাতের মানুষ থেকে খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আছে। এই নিয়ম ভঙ্গ করলে সেই ব্যক্তি সামাজিক আচার নষ্ট করা এবং নিজের বর্ণের মর্যাদা হারায়।
এমনকি বেকারির মালিকানাও তাদের জন্য অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ভিএস পারমার তার বইতে এ ধরনের একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন। মুলশঙ্কর ভেনিরাম নামে এক উঁচু বর্ণের হিন্দু তখন ইউরোপীয়দের কাছ থেকে বেকারির কাজ শেখেন এবং তার বাড়িতে একটি বেকারি খোলেন। দেখা যায়, এই কারণে স্বগোত্রিয় লোকজন তাকে বয়কট করে শাস্তি দেয়।
আর এসব কারণেই বেশিরভাগ বেকারির মালিকানা ছিল ইংরেজ কিংবা পারস্যের লোকজনের।
তবে এসব প্রথার বিরুদ্ধে একসময় 'বিদ্রোহ' ঘটে। ১৯ শতকে অনেক মানুষ পুরনো ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে পশ্চিমা জীবনযাপনের পন্থাকে বেছে নেয়। এসময় বিস্কুট কেবলই একটি খাদ্য নয় বরং জাতপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ব্যবহৃত পণ্যে রূপ নেয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাঙালি বুদ্ধিজীবী রাজনারায়ণ বসু শেরি (এক জাতীয় মদ) এবং বিস্কুট খেয়ে ব্রাহ্মসমাজে তার প্রবেশ উদযাপন করেছিলেন।
এই বিদ্রোহীরা সাহসের সাথে 'নিষিদ্ধ' ফল এবং বিস্কুট খেয়ে প্রতিবাদ করতেন। যদিও অ-হিন্দু এমনকি অ-ভারতীয় বলে তিরস্কৃত করা হতো তাদের। কারণ জাতীয়তাবাদী ধারণায়, বিস্কুট ছিল ইংরেজিকরণের প্রতীক।
জাতভেদ প্রসঙ্গে দুর্গাচরণ রায় তার ১৯ শতকের সামাজিক ব্যঙ্গাত্মক বই 'দেবগণের মর্তে আমগন' এ দেখান, পৃথিবী ভ্রমণে আসা দেবতারা বিস্মিত হন যে, ব্রাহ্মণরা পবিত্রতার জন্য নিচু জাতের হিন্দুদের হাতে তৈরি বিস্কুট বা পাউরুটি না খেলেও মুসলিম বেকারদের হাতে তৈরি একই পণ্য খেতে তাদের কোন দ্বিধা ছিল না।
তবে নিষিদ্ধ প্রকৃতির কারণেই বিস্কুট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উৎস রায় তার কিউলিনারি কালচার অব কলোনিয়াল ইন্ডিয়া-তে লেখেন, বিস্কুট একটি নিষিদ্ধ খাবার হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং অনেকের কাছে তা খাওয়া ছিল লোভনীয় ব্যাপার। ইউরোপীয়দের খাবারের দোকানে থাকা বিস্কুটের চাহিদা ভারতীয় মধ্যবিত্তদের মধ্যে বাড়তে থাকে।
জয়িতা শর্মা 'অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব ফুড হিস্ট্রি' প্রবন্ধে লেখেন, তরুণরা এই লোভনীয় পণ্যের জন্য সৃজনশীল কায়াদা বের করে। উচ্চ বর্ণের হিন্দু স্কুলছাত্ররা তাদের মুসলিম সহপাঠীদের এই 'অবৈধ খাবার' আনতে রাজি করাতো।
১৯ শতকের শেষের দিকে ভারতবর্ষজুড়ে দেশীয় বিস্কুট কারখানা গড়ে উঠছিল। মাম্বলি বাপু নামে একজন ব্যবসায়ী-যিনি বার্মা থেকে মিশরে ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে দুধ, চা এবং রুটি পাঠাতেন- ১৮৮০ সালে কেরালার থ্যালাসেরিতে রয়্যাল বিস্কুট ফ্যাক্টরি খোলেন। আর পূর্বে, কলকাতায় ১৮৯২ সালে যাত্রা শুরু হয় 'ব্রিটানিয়া' বিস্কুটের।
খাদ্য ইতিহাসবিদ কে টি আচায়া 'ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া' তে লেখেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের বড় বড় শহরে অন্তত আটটি বড় বিস্কুট কারখানা ছিল এবং সারাদেশে বেশ কয়েকটি ছোট বেকারি ছিল।
গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা
বর্ণপ্রথা বিদ্যমান থাকা হিন্দু সমাজে বিস্কুটকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা তখনও সহজ ছিল না। অবশেষে সেই সমস্যার সমাধান করলেন লালা রাধামোহন।
১৮৯৮ সালে দিল্লিতে 'হিন্দু বিস্কুট কোম্পানি' চালু করেন রাধামোহন । দুই দশকের মধ্যে এই কোম্পানি ৫৫ ধরনের বিস্কুট তৈরি করে। ক্যান্টিন, কেবিন, ইম্পেরিয়াল, করোনেশন; এসব নামে বিস্কুটগুলোর নামকরণ হয়। কারখানায় আবার ৩০ ধরনের কেকও তৈরি হতো। রাধামোহনের পণ্য অসংখ্য পুরস্কার জিতে নেয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতার উইলসন হোটেলে (পরে দ্য গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল) ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য সামরিক গ্রেডের বিস্কুটের প্রধান সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তার কোম্পানি।
সৈন্যদের কাছে সরবরাহের পাশাপাশি, হিন্দু বিস্কুট কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ছিল বর্ণপ্রথা-সচেতন হিন্দুদের মধ্যে বিস্কুটকে জনপ্রিয় করা। এই লক্ষ্য অর্জনে কোম্পানি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের নিয়োগ দিয়েছিল, যাতে পণ্যগুলি গোঁড়া হিন্দুদের দৃষ্টিতে পবিত্র এবং গ্রহণযোগ্য হয়।
১৮৯৮ সালে প্রকাশিত কোম্পানির এক বিজ্ঞাপনে ঘোষণা করা হয়েছিল, উৎপাদন থেকে প্যাকেজিং; সবকিছুই হয়েছে শুধুমাত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতের স্পর্শে। কেবলমাত্র দুধ ব্যবহার করা হয়েছে, কোনো পানি দিয়ে তৈরি নয়।
রাধামোহনের হিন্দু বিস্কুট কোম্পানি জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও বিস্কুটের সঙ্গে 'হিন্দু' নাম জুড়ে দিয়ে বিস্কুট বিক্রি করা শুরু করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গ্রাহকদের বিভ্রান্তিতে ফেলা, আর এটি কাজও করেছে। অনেক গ্রাহক মনে করতেন বিস্কুটগুলো রাধামোহেনের হিন্দু বিস্কুট কোম্পানির তৈরি করা।
আচায়া তার প্রবন্ধে লেখেন, এমন অবস্থায় হিন্দু বিস্কুট কোম্পানি তাদের নাম পরিবর্তন করে দিল্লি বিস্কুট কোম্পানি রাখতে বাধ্য হয়। এই সুযোগ নিয়ে ব্রিটানিয়া (পরবর্তীতে গুপ্তা অ্যান্ড কো.) পশ্চিমাদের অনুরূপ বিস্কুট তৈরি শুরু করে এবং নাম দেয় হিন্দু বিস্কুট। ১৯৫১ সালে এসে দিল্লি বিস্কুট কোম্পানি এবং ব্রিটানিয়া এক হয়ে যায়।
এসময় হিন্দু বিস্কুটের রন্ধনপ্রণালী অনেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়। একসময় পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলো এবং সারাদেশের রেল স্ট্রেশনগুলোতে হিন্দু বিস্কুটের উপস্থিতি সাধারণ দৃশ্য হয়ে ওঠে। মুসলমানদেরও এ বিষয়ে কোন আপত্তি ছিল না। হিন্দুদের বড় অংশও তখন 'হিন্দু বিস্কুট' খাওয়া শুরু করে।
আচায়া এই পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, '১৯০৫ সালের পর স্বদেশী আন্দোলন জোরদার হলে দেশীয় পণ্য ব্যবহারে উৎসাহ বাড়ে এবং চা দোকানগুলোতে তখন বিস্কুট পরিবেশন করা শুরু হয়। বিস্কুটের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও দ্রুত পরিবর্তিত হয়। ১৯১৯ সালে সুক্কুরে (বর্তমান পাকিস্তানে) চালু হয় জেবি মানঘারাম বিস্কুট কারখানা। কাছাকাছি সময়ে 'পার্লে' শিশুদের শক্তির উৎস হিসেবে প্রচার করে তাদের গ্লুকোজ বিস্কুটকে ঘরে ঘরে জনপ্রিয় করে তোলে।
এভাবে বছরের পর বছর প্রত্যাখ্যানের পর, বিস্কুট কোম্পানিগুলো সদ্য স্বাধীন ভারতে জাতি গঠনে বড় অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়।