ইওর ক্যাম্পাস: ভেন্ডিং মেশিন-ওয়াশিং মেশিনে একটু নির্ঝঞ্ঝাট হলজীবন
সারাদিন ক্লাস, লাইব্রেরি ও টিউশনে সময় দিয়ে কামরুন্নাহার সাথী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে ফেরেন, তখন ক্লান্তিতে রাতের খাবার তৈরি করতে তার আর ইচ্ছে করে না।
কিন্তু রান্না না করেও উপায় নেই, কারণ 'হলের ক্যান্টিনের খাবারের মান অত্যন্ত খারাপ।' এরমধ্যে কোনো কোনো দিন তাকে আবার জামাকাপড়ও ধুতে হয়। শুধু সাথী নন, তার হলের অন্য বাসিন্দাদের রুটিনটাও একইরকম।
তবে এখন তারা একটু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন কারণ তাদের হলে এখন ওয়াশিং মেশিন রয়েছে। আর এসব মেশিন ব্যবহারের খরচও খুব বেশি নয়।
সাথী যেমনটা বলছিলেন, 'এ মেশনিগুলোর কল্যাণে এখন একটু বাঁচোয়া। আর খরচ খুব কম হওয়ায় নিয়মিত ব্যবহারেও গায়ে লাগে না।'
এর বিকল্প উপায়টি হচ্ছে হলের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছে কাপড় দেওয়া। '৩০ টাকায় ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতে পারি, যদিও আজকাল খরচ কিছুটা বেড়েছে। আমি যদি ১০টা কাপড় ধোয়ার জন্য খালাদের (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) ৩০ টাকা দিই, তাহলে সেটা অমানবিক হবে।'
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ. এফ. রহমান হলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তানভীর রানা প্রায়ই রাত জেগে পরীক্ষার জন্য পড়েন। গভীর রাতে যখন হলের ছোট দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি লবিতে যান। সেখানে থাকা বিভিন্ন হালকা খাবারভর্তি ভেন্ডিং মেশিন তার খিদে মেটায়।
তার ভাষায়, 'এটা একটা লাইফসেভার।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব আবাসিক হলে এখন এ ধরনের ভেন্ডিং মেশিন রয়েছে। শিক্ষার্থীরা সময়ে-অসময়ে এগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
এসব উদ্ভাবনী এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সমাধানগুলোর পেছনে রয়েছে 'ইওর ক্যাম্পাস' নামক আইওটিভিত্তিক একটি উদ্যোগ। শিক্ষার্থীদের জীবনকে আরেকটু সহজ করতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫টি আবাসিক হলে নিজেদের পরিষেবা প্রদান করে ইওর ক্যাম্পাস।
যেভাবে কাজ করে ইওর ক্যাম্পাস
গেট এইড লিমিটেড-এর স্টার্টআপ ইওর ক্যাম্পাস দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সেবা প্রদান করে। বর্তমানে দেশজুড়ে ৯৫টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও হলে এটির ১৩৮টি স্ন্যাক ও বেভারেজ ভেন্ডিং মেশিন রয়েছে। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ওয়াশিং মেশিনের সেবা চালু করার পর থেকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১টি হলে ১৪৭টি ওয়াশিং মেশিন স্থাপন করেছে ইওর ক্যাম্পাস।
ইওর ক্যাম্পাস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিলজার রহমান ম্যাচেল বলেন, 'প্রতি সপ্তাহে এ সংখ্যা বাড়ছে এবং আমরা ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবা চালুর লক্ষ্য স্থির করেছি'
ব্যবহারকারীরা ইওর ক্যাম্পাস অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিবন্ধন করতে পারেন। তারপর তারা অ্যাপটি থেকে তাদের ওয়াশিং স্লট নির্বাচন করতে পারেন।
একবার ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারের জন্য ৫০ টাকা খরচ হয়। তবে কেউ চাইলে ৬০০ টাকা দিয়ে ২০ বার ধোয়ার প্যাকেজ কিনতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রতিবার ধোয়ার জন্য খরচ পড়ে ৩০ টাকা। সবচেয়ে জনপ্রিয় প্যাকেজটিতে ২০০ টাকায় পাঁচবার ধোয়া যায়, অর্থাৎ প্রতি ওয়াশের দাম পড়ে ৪০ টাকা।
আর পুরো প্রক্রিয়াতেই কাগুজে টাকার কোন বালাই নেই। শিক্ষার্থীরা বিকাশ বা নগদ-এর মাধ্যমে টাকা দিতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থী তানজিম নোমান বলেন, কিছু শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ টাকা একটু বেশি হতে পারে।
তবে বঙ্গমাতা হলের নুবাহ খান মুমুর পরামর্শ, 'বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে একটি বড় প্যাকেজ কিনে নেওয়া যেতে পারে। যেমন, ১০টি ওয়াশের প্যাকেজ কিনলে প্রতিটি ধোয়ার খরচ মাত্র ৩৫ টাকা। আর ২০ ওয়াশের প্যাকেজের খরচ আরও কম।'
একজন শিক্ষার্থী জানান, তিনি অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে ইওর ক্যাম্পাস অ্যাপটি খুঁজে পাননি। ইওর ক্যাম্পাস-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিআরও মো. ইসতিয়াক উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, 'আমাদের এখনও আওএস সংস্করণ নেই। আমরা তা নিয়ে কাজ করছি এবং খুব শীঘ্রই এটি চালু হবে বলে আশা করছি।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের মো. ফাহিমের মতে, ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারের সুবিধা অনেক। প্রথমত এটি কাপড় ধোয়ার বিড়ম্বনা বহুলাংশে কমায়, একইসঙ্গে সময়ও বাঁচায়। তাছাড়া ধোয়ার পর মেশিন থেকে কাপড় প্রায় ৮০ শতাংশ শুকনা পাওয়া যায়। মেশিনে বিভিন্ন ধরনের কাপড় একসঙ্গে ধোয়া যায়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হলো অ্যাপটি প্রতিটি ওয়াশের আগে ও পরে ব্যবহারকারীর স্মার্টফোনে নোটিফিকেশন পাঠায়।
তবে এর অসুবিধাগুলো বেশিরভাগ প্রযুক্তিগত। যেমন, নেটওয়ার্কের সমস্যা বা ফিল্টার জ্যাম হওয়ার মতো প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে মেশিনটি তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে থাকতে পারে। বড় প্রযুক্তিগত সমস্যা হলে ঠিক করতে দুই থেকে তিন দিনও সময় লাগতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ওয়াসিব মাহমুদ সিয়াম বলেন, 'কিউআর কোডের স্টিকার নাই দেখে ওদের ফোন দিয়েছিলাম। রাত তখন ১২টা। অবাক হলাম দেখে যে তারা ওই সময়েও সাড়া দিয়েছেন এবং পরদিনই সমস্যার সমাধান করেছেন। আমি এখন পর্যন্ত সেবা নিয়ে খুশি।'
ওয়াশিং মেশিনের সেবা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেশ সন্তুষ্ট। তবে ভেন্ডিং মেশিনগুলো থেকে আরেকটু বেশি প্রত্যাশ করেন তারা — বিশেষ করে এসব মেশিনে আরও বিভিন্ন জাতের খাবার থাকলে ভালো হতো বলে তাদের অনুযোগ।
অ্যাপ দিয়ে দ্রুত ভেন্ডিং মেশিন থেকে খাবার কেনা যায়। তবে ওয়াশিং মেশিন কেবল অ্যাপটি দিয়েই ব্যবহার করতে হয়। ইওর ক্যাম্পাস-এর আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা মো. শিহাব আহমেদ বলেন, আগামী মাসগুলোতে তারা দামের ওপর অ্যাপভিত্তিক ছাড় রাখার পরিকল্পনা করছেন।
পেছনের গল্প
কোভিড-১৯ মহামারির সময় জন্ম হয় ইওর ক্যাম্পাস-এর আইডিয়ার। ২০২০ সালের মার্চের প্রথম দিকে মিলজার ম্যাচেল একবার তার বাবার সঙ্গে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন।
সেখানে একটু জুস আর পানি কিনতে গিয়ে তার ১০–১৫ মিনিট সময় লেগেছিল। 'তখন আমার মনে হলো, ভেন্ডিং মেশিন থাকলে প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হতো,' মিলজার বলেন।
তখন তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে কাজ করতেন। তিনি ভেন্ডিং মেশিনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং শেষতক তার বস প্রকল্পটির অনুমোদন দেন ও অর্থায়ন করেন। "২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি 'স্ন্যাককিপার' নামক প্রথম ভেন্ডিং মেশিনটি সীমান্ত স্কয়ারে বসানো হয়েছিল," মিলজার বলেন।
পরে তিনি বুঝতে পারলেন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে এসব মেশিনের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এভাবেই শুরু হয় ইওর ক্যাম্পাস-এর যাত্রা। মিলজার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আরও চার সহ-প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে আরও কিছু পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে ইওর ক্যাম্পাস নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন।
'২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রস্তাবকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন,' তিনি বলেন। ছাত্র সংগঠনগুলোও তাদেরকে দারুণ সমর্থন দিয়েছিল।
'পরে আমরা ওয়াশিং মেশিনের আইডিয়া নিয়ে এগোই। আমাদের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা কাজী ইলিয়াস একজন আওটি বিশেষজ্ঞ। তিনিই এটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিলেন। গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা সল্যুশন কস্ট অপ্টিমাইজ করেছি। মানে ভালো ও দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হাইয়ার ওয়াশিং মেশিন বেছে নেওয়া হয়,' তিনি আরও বলেন।
ইওর ক্যাম্পাস-এর প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে। এটি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট (বিআইজি) ২০২৩-এ হাজারেরও বেশি স্টার্টআপের মধ্যে শীর্ষ ৫২ স্টার্টআপের স্বীকৃতি পেয়েছে। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, আওটিভিত্তিক অ্যাপটি এর আগে আর-ভেঞ্চার ৩.০ প্রতিযোগিতায় শীর্ষ ১১ র্যাঙ্কিং অর্জন করেছিল।
ভবিষ্যৎ
ইওর ক্যাম্পাস শীঘ্রই সাবান, ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু ইত্যাদি পণ্যসহ আরেকটি ভেন্ডিং মেশিন চালু করতে যাচ্ছে। এসব পরিষেবার পাশাপাশি 'ক্যারিয়ার' নামক আরেকটি উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ার উন্নয়ন, পরামর্শদান, নেটওয়ার্কিং, চাকরি মেলা, সেমিনার এবং প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে নজর দিচ্ছে ইওর ক্যাম্পাস।
'বর্তমানে ইওর ক্যাম্পাস থেকে সেবা পাচ্ছেন ৪০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী। আমরা ইওর ক্যাম্পাস-এর মাধ্যমে দেশের প্রতিটি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পরিষেবা দিতে চাই,' বলেন এটির অন্য সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিওও রাকিবুল হাসান শিহাব।
তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া 'আপনার অফার'-এর মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে ছাড়ে পণ্য দেওয়ার পরিকল্পনা করছি।'