ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে জার্মান তেলাপোকা
গত জুন মাসে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মর্মান্তিক এক ঘটনার কথা জেনে শিহরিত হন ঢাকার বাসিন্দারা।
একই পরিবারের স্কুলপড়ুয়া দুুই শিশু – শাহির মোবারত (৯) ও শায়ান মোবারত (১৫) – কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় মারা যায়।
পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকে জানান, ২ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকের বাসাটিতে তেলাপোকার কীটনাশক দেন পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের কর্মীরা।
রাজধানীর বাসিন্দারা তেলাপোকার মতো কীটপতঙ্গের জ্বালাতনে কতোটা অতিষ্ঠ যে, পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে – হৃদয়স্পর্শী এ ঘটনা তারই প্রমাণ।
বালাইদমন সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো জানায়, ঢাকার ৮০ শতাংশ অ্যাপার্টমেন্টে রয়েছে তেলাপোকার উপদ্রুপ। এরমধ্যে জার্মান তেলাপোকার বিস্তার অতি-দ্রুত হারে বাড়ছে, যা বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে।
'অল দ্য জার্মান ককরোচেস ম্যান'
ঢাকায় তেলাপোকার উপদ্রুপ নতুন কিছু নয়। অতীতে আবাসিক ফ্ল্যাট, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল থেকে শুরু করে শহরের বাজারহাটেও দেখা যেত এক ইঞ্চি-দৈর্ঘ্যের আমেরিকান তেলাপোকা। তবে গত এক দশকে আমেরিকান তেলাপোকার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত খুবই ছোট আকারের জার্মান তেলাপোকা, যা চীনা তেলাপোকা নামেই বেশি পরিচিত– এত বেশি মাত্রায় বেড়েছে যে– তা এক গুরুতর সমস্যায় রূপ নিয়েছে।
সাধারণত রান্নাঘরের প্রায় সব কোণায় দেখা যায় এই তেলাপোকার অবাধ বিচরণ। আকারে খুবই ছোট হওয়ায় হওয়ায়, এরা সহজেই সূক্ষ্ম ফাঁকফোকর দিয়ে এমনকি ঢাকা দেওয়া খাবারেও প্রবেশ করতে পারে। ছোট্ট বাদামি রঙের এই তেলাপোকা দ্রুতই এক ফ্ল্যাট থেকে অন্য ফ্ল্যাটে বংশবিস্তার করে, মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
২০০৩ সাল থেকে ঢাকায় বালাইদমন পরিষেবার কর্মী হিসেবে কাজ করছেন লিটন মিয়া। তিনি জানান, তেলাপোকা দমনের অনুরোধ জানিয়ে দৈনিক তাদের কোম্পানিতে পাঁচটির বেশি ফোনকল আসে।
লিটনের মতে, গত ২০ বছরে ঢাকার প্রায় পাঁচ হাজার বাসাবাড়ি, হাসপাতাল ও হোটেলে তিনি বালাইনাশক দিয়েছেন।
'আমার ধারণা, ঢাকার প্রায় ৮০ শতাংশ বাসাবাড়িতে ছোট আকারের জার্মান তেলাপোকার বংশবিস্তার হচ্ছে। যখন তা আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, মানুষ তখন আমাদের ফোন করে'- যোগ করেন তিনি।
নেহা পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী জিয়া উদ্দিনও বলেন যে, বর্তমানে ঢাকার অন্তত ৮০ শতাংশ বাসাবাড়িতে তেলাপোকার এ প্রজাতির উপদ্রুপ আছে।
গত নয় বছর ধরে এ ব্যবসায় থাকা জিয়া উদ্দিন জানান, এসময়ে ঢাকার প্রায় ৫০০ ফ্ল্যাটে তার কোম্পানি বালাইদমন সেবা দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তারা জার্মান তেলাপোকার সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বাড়তে দেখেছেন বলেও জানান তিনি।
আগ্রাসী প্রজাতির আমেরিকান তেলাপোকা থেকে বর্তমানে জার্মান তেলাপোকার আধিক্য বাড়ার এই চিত্র তুলে ধরেন বালাইদমন সেবা প্রদানকারীরা। তাদের মতে, এ দুই ধরনের তেলাপোকা-ই মূলত ঢাকায় বেশি দেখা যায়।
জিয়া উদ্দিন বলেন, 'আমেরিকান তেলাপোকার সংখ্যা এখন ব্যাপকভাবে কমে গেছে, ফলে সচরাচর তেমন দেখা যায় না।' অনেক বছর ধরে বালাইদমন সেবা প্রদানকারীদের প্রয়োগ করা কীটনাশকের প্রভাবে এগুলোর বংশবিস্তার কমেছে বলে মনে করেন তিনি।
'বর্তমানে ঢাকার বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ, হোটেল, হাসপাতাল – সর্বত্র জার্মান তেলাপোকার দৌরাত্ম্য। এই পোকা নগরবাসীর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে'-যোগ করেন তিনি।
বালাইদমনকারীদের মতে, সবচেয়ে বাজে অবস্থা দেখা যায় রেস্তোরাঁগুলোর রান্নাঘরে; দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, বেশিরভাগ রেস্তোরাঁর রান্নাঘর যেন জার্মান তেলাপোকার আতুরঘর।
কীভাবে দেশে এলো জার্মান তেলাপোকা?
বসতবাড়িতে তেলাপোকার আনাগোণা সব সময়েই ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিদেশ ভ্রমণ আর আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ বাড়ার কারণেই জার্মান তেলাপোকার বিস্তার ঘটে।
তাছাড়া, নামে জার্মান তেলাপোকা হলেও, মোটও এটি শুধু জার্মানি থেকে আসেনি, বরং বিভিন্ন দেশ থেকেই বাংলাদেশে এসেছে।
জিয়া উদ্দিন বলেন, 'আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এখন বিদেশে যান, তারা যখন দেশে আসেন, তখন লাগেজে করে কিছু জার্মান তেলাপোকাও চলে আসে।
অনেক সময় লাগেজগুলো বিমানবন্দর বা উড়োজাহাজের স্টোররুমে বা লাগেজরুমে রাখা হয়। ফলে এক লাগেজ থেকে অন্য লাগেছে দুই এক জোড়া তেলাপোকা ঢুকে পড়তে পারে অনায়সেই।'
তিনি আরো জানান, ব্যবসায়ীরা যখন পেঁয়াজ, আদা বা রসুন আমদানি করেন, তখন অনেক পোকাও এসব পণ্যের সাথে চলে আসে। আমদানি করা পণ্যের গুদাম তাই তেলাপোকাদের স্বর্গরাজ্য, কারণ অনেক বছর হয়তো সেগুলো ঠিকমতো পরিস্কার করাই হয় না। মুদি দোকানগুলোও তেলাপোকার বংশবিস্তারের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। আমদানি করা পেঁয়াজ, আদা বা রসুনের গায়ে এই তেলাপোকার লার্ভা বা ডিম সেঁটে থাকে।'
অর্থাৎ, আমদানি করা পণ্য থেকে প্রথমে মুদি দোকানে ছড়ায় জার্মান তেলাপোকা, তারপর ক্রেতাদের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে চলে আসে।
'একটু খেয়াল করলে কখনো কখনো পেঁয়াজের গায়ে কালো কালো দাগ দেখতে পারবেন, আসলে এগুলোই হলো জার্মান তেলাপোকার পিউপা বা লার্ভা। তাই এগুলো আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে'- বলছিলেন জিয়া উদ্দিন।
জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি
যেকোনো পরিবেশেই মারাত্মক কীট জার্মান তেলাপোকা। তাই বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ বা হাসপাতাল– যে স্থাপনাই হোক না কেন – সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা একেবারেই অপরিহার্য।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ২০১৮ সালে এক যৌথ গবেষণা করেছে।
'ককরোচ অ্যাসোসিয়েটেড ফুডবর্ন প্যাথোজিনস: ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড অ্যান্টিবায়োগ্রাম' শীর্ষক ওই গবেষণা জানায়, বাসাবাড়ি ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে সবচেয়ে বেশি যে পতঙ্গ দেখা যায়, তা হলো তেলাপোকা। তেলাপোকা রোগজীবাণুর বাহক ও তাদের মাধ্যমে মানবদেহে রোগ-বিস্তারের ঝুঁকি থাকে।
অনেক সময় রোগীর দেহে যে রোগ থাকে না, হাসপাতালে এসে চিকিৎসা গ্রহণকালে তার দেহে ওই রোগ ছড়াতে পারে। একে বলা হয়, নসোকমিক্যাল ইনফেকশন। বিশেষত, রোগীর দেহে তেলাপোকার মাধ্যমে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়ার বিস্তারও ঘটতে পারে। এতে তিনি যে রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তার যথাযথ চিকিৎসা করাই কঠিন হয়ে যায়।
গবেষণার লক্ষ্য ছিল তেলাপোকার প্রধান প্রধান প্রজাতিগুলো শনাক্তকরণ, তেলাপোকা থেকে খাদ্যের মাধ্যমে বিস্তারলাভকারী রোগজীবাণু পৃথক করা এবং এসব ব্যাক্টেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সক্ষমতার বিশ্লেষণ।
২০১৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়কালে (হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ ও বাসাবাড়ি থেকে ১৫০টি করে) ঢাকা শহর থেকে ধরা ৪৫০টি তেলাপোকার ওপর এই গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, ধৃত তেলাপোকাগুলোর শতভাগই হচ্ছে ব্ল্যাটেল্লাজার্মানিকা বা জার্মান তেলাপোকা।
এর সবগুলোই ব্যাক্টেরিয়াবাহী হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত হয়। এছাড়া, তাদের ফাঙ্গাস ও পরজীবী বহনের হার ছিল যথাক্রমে ২৮.২ ও ৩.৭ শতাংশ।
গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, 'ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া স্ট্রেইনসহ তেলোপোকা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর অণুজীবের সম্ভাব্য উৎস; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক হুমকির কারণ হতে পারে।'
তেলাপোকা-ঘটিত সংক্রমণ হ্রাসে যথাযথ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়।
'অ্যান্টিবায়োগ্রাম অ্যান্ড এমডিআর প্যাটার্ন অব দ্য ব্যাক্টেরিয়াল আইসোলেটস ফ্রম জার্মান ককরোচেস অ্যাট আরএমসিএইচ, রাজশাহী, বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালিত হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ওয়ার্ডগুলোয়। এতে দেখা যায়, তেলোপোকা রোগজীবাণু বহন ও ছড়াতে অত্যন্ত সক্ষম। তাদের মাধ্যমে রোগীদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক ও একাধিক ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার ঘটছে।
আশঙ্কাজনক এ ঘটনা বিশ্বস্তরেও ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী উদ্বেগজনক হারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বাড়ার ঘটনায় সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
দমনের উপায় কী
ঢাকায় তেলোপোকার উপদ্রুপ মুক্ত থাকার দুটি উপায় আছে, এর একটি হলো– রান্নাঘর সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, আর তাতেও ফল না মিললে বালাইদমন সেবাদাতাদের সাহায্য নেওয়া।
তবে পরিষ্কার রান্নাঘরের চেয়ে অপরিচ্ছন্ন রান্নাঘরেই জার্মান তেলাপোকার সংখ্যাধিক্য থাকে। বালাইদমন সেবাদাতারা বলেছেন, রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন রাখলেই বাসাবাড়ি অনেকাংশেই জার্মান তেলাপোকা মুক্ত রাখা সম্ভব।
জিয়া উদ্দিন বলেন, 'অপরিচ্ছন্ন রান্নাঘর তেলাপোকার স্বর্গরাজ্য। আপনি যদি এটা পরিষ্কার রাখতে পারে, তাহলে কখনোই তেলাপোকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।'
'যেসব রান্নাঘর একটু বেশি ময়লা, সেখানেই বাসা বাধে এই তেলাপোকা। অন্যদিকে যারা রান্নাঘর একদম পরিচ্ছন্ন রাখেন– তাদের বাড়িতে তেলাপোকার উপদ্রুপ হয় না।'
বিষ দিয়ে তেলপোকা মারতে নগরবাসী বালাইদমন সেবা প্রদানকারীদের সহায়তাও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হতে পারে।
জিয়া উদ্দিন বলেন, 'পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস ডাকার সামর্থ্য সবার নেই। সেক্ষেত্রে নিজ উদ্যোগে রান্নাঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।'
তিনি জানান, তেলাপোকারা রান্নাঘরের তৈলাক্ত খাদ্যাবশিষ্ট, পচা খাবার খেতে পছন্দ করে। 'ধরুন যদি চিকেন ফ্রাইয়ের অবশিষ্ট ফেলে রাখেন, তাহলে ওরা মহানন্দে খাবে'।
বাড়িতে কীটপতঙ্গের প্রবেশ ঠেকাতে বিভিন্ন ছিদ্র বন্ধ করার পরামর্শ দেন জিয়া। একইসঙ্গে, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের মতো পণ্য কেনার বেলায় সতর্ক থাকতে বলেন।
'ধরুন যদি ডিম কেনেন, তাহলে ডিমের কেস-সহ বাড়িতে আনবেন না। ডিমগুলো আলাদা করে আনবেন। কারণ ডিমের কেসে এসব তেলাপোকা বাস করে।' কেসের গায়ে তেলোপোকার লার্ভা বা ডিমও থাকে বলে জানান জিয়া উদ্দিন।