‘হরতাল কী জানো তোমরা?’ — আজ হরতাল, আজ রাস্তা নীরব গলি সরগরম
মিরপুর জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পেছনের গলি। মিরপুর ১০ নম্বরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস সেভেনের রাফসান অপেক্ষা করছে ব্যাট করবে বলে। অন্যদিন তার স্কুল থেকে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। আজ দুটো ক্লাস হয়ে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। তাই বাসায় ফিরে উল্টোদিকের বাড়ির সজীবকে ডেকে নিয়ে এসেছে বাইরে। দুজনে খেলা শুরু করেছিল প্রথমে, তারপর আরও ৬–৭ জন এসে যোগ দেয়। হরতাল কী? জানতে চাইলে রাফসান বলল, 'আগে তো কখনো দেখিনি, এবারই দেখলাম রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া কম, ক্লাসও হলো না। এটাই বুঝলাম যে হরতাল হলে ক্লাস হয় না।'
বহু বছর পর আবারও শহরে হরতাল। কতদিন আগে শেষ হরতাল হয়েছে ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে একসময় খুব হরতাল হতো, তা বেশ মনে আছে । একদল বলত, 'সকাল-সন্ধ্যা আগামীকাল, হরতাল হরতাল'। অন্যদল পালটা দিত, 'যারা করে হরতাল, তাদের মাথায় পানি ঢাল'। এ বহু বছরে অনেক নতুন মানুষ এসেছে ধরায় তথা শহর ঢাকায়। রাফসানের মতো এবারই হয়তো অনেকে প্রথম হরতাল দেখল।
এর মধ্যে স্কুল ড্রেস পরে রাফসানদের চেনা এক ছেলে ব্যাগ কাঁধে করে স্কুলে চলেছে। ছেলেটা এক ক্লাস ওপরে পড়ে, তবে তারা বন্ধু। সজীব টিপ্পনী কাটল, কিরে তোর দেখি অনেক সাহস! ছেলেটা বুকে হাত রেখে বলল, 'জিগার মে দম।'
অন্যদিন সড়কগুলোয় পা ফেলা যায় না, আজ কিন্তু ভিড় কম। পাড়ার গলিগুলো বরং সরগরম। এদিন স্কুলে যায়নি অনেকে, অফিসও কামাই করেছেন কেউ কেউ। গলিগুলোতে তাই ভিড় জমিয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন বয়সি মানুষ। ছোটরা ক্রিকেট খেলছে, বড়রা গতকালের খেলায় বাংলাদেশের নিদারুণ পরাজয় নিয়ে হা-হুতাশ করছেন।
মিরপুর ২ নম্বরের কাছে একটা নিরিবিলি কানাগলিতে গিয়ে দেখি চারটি ছেলে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলছে। বড় ছেলেটির নাম সোহান, পড়ে বাংলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে। এখন তার ক্লাস চলছে না, কোচিং হচ্ছে। কিন্তু আজ সকালে সে স্যারের কাছে পড়তেও যায়নি। বাবা বলেছেন, বাঁচলে পরে পড়াশোনা। সোহানের কাছে হরতাল মানে মারামারি, এর বেশি কিছু জানা নেই তার।
আগের রাতে আহনাফ প্রথম হরতাল শব্দটি শুনেছে। বাবা কাল (আজ রোববার) অফিস যাবে কি না তা নিয়ে মায়ের সঙ্গে আলাপ করছিল। মা বলেছিল, না গেলেই ভালো। বলা তো যায় না, কী ঘটে যায়, ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই। সাত বছর বয়সি আহনাফ বাবার কাছে জানতে চেয়েছে, হরতাল কী? বাবা অল্প কথায় বলেছেন, হরতাল হলে গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ থাকে।
ঘুরতে ঘুরতে প্রশিকা মোড়ে এলাম। ৩৬ বছর বয়সি ক্যাপ বিক্রেতা হোসাইন হাতে একটা আলনা বয়ে নিয়ে চলেছেন। ৬–৭ বছর ধরে এ ব্যবসায়। আজ হরতালের দিন হোসাইনের ইচ্ছে ছিল না পথে নামার। কিন্তু ঘরে বাজার নেই বলে বাধ্য হয়েই বের হয়েছেন। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা অব্দি আড়াই ঘণ্টায় মোটে ২০০ টাকার ব্যবসা করেছেন। অন্য সাধারণ দিনে যা তিন–চারশ টাকায় দাঁড়ায়। হোসাইন ঠিক করেছেন আর ১০০ টাকা হলে ঘরে ফিরে যাবেন।
৬ নম্বর বাজার মসজিদের দিকে এগিয়ে কিছুটা গিয়ে একটা কচি বটগাছের তলায় নারায়ণ রবিদাসের সঙ্গে দেখা। ছোট্ট চৌকি বিছিয়ে বসে আছেন এ পাদুকা সারাইকারি । তার চৌকিতে বসে কথা হলো। গ্রামে তেমন রোজগার হয় না, নইলে দুই বছর আগে ঢাকায় আসতেন না। স্ত্রী-কন্যার সংসারে মাসে মোট ১২ হাজার টাকা রোজগার না করলে চলতে কষ্ট হয়। আজ এখন পর্যন্ত একজন কাস্টমারও পাননি, তিন ঘণ্টার বেশি হয়ে গেল এসে বসে আছেন। অন্যদিন এতটা সময়ে দেড়-দুশো টাকা রোজগার হয়ে যায়। রবিদাস চিন্তিত, নির্বাচন পর্যন্ত না জানি এমনই চলতে থাকে!
নারায়ণকে ছাড়িয়ে মিরপুর ৬ নম্বরের ডি ব্লকের মুকুল ফৌজের কাছের রাস্তায়ও আবার একই দৃশ্যের সঙ্গে মোলাকাত — ক্রিকেট খেলা চলছে। এখানে খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক বেশি, দর্শকও কম নেই। দর্শকদের মধ্যে আরমান, তামিম, তৈমুরও আছে। তারা তিনজন পাড়াত বন্ধু। সবাই এক ক্লাসেরও নয়, বয়স তাদের বারো–চৌদ্দর ঘরে। তিনজনকে লক্ষ্য করেই প্রশ্নটা ছুড়লাম:
'হরতাল কী জানো তোমরা?'
'আজ স্কুলে যেতে হয়নি, এটাই হরতাল,' বলে হেসে উঠল তৈমুর। আরমান খবর দেখে। বলল, 'কাল টিভিতে জ্বালাও-পোড়াও দেখেছি। আর ভাইয়া বলেছে হরতাল হলে যানবাহন বন্ধ থাকে। আমার ব্যাপারটা খারাপই লাগছে। একটু ভয়ও পাচ্ছি।' একটু সময় নিয়ে তামিম বলল, 'মারামারি আমার ভালো লাগে না। হরতাল মানে মারামারি, গোলমাল। আমার পছন্দ নয়।'
এগিয়ে চললাম বাজার মসজিদের দিকে। বাজার মসজিদের নীচতলার বাজারে আমাদের পূর্বপরিচিত মুদি দোকানি সাজাহান ভাইয়ের দোকানে গেলাম। তাকে বেশ বিরক্ত দেখাল। তিনি বললেন, 'সামনে বাচ্চাদের পরীক্ষা। আর এখন জ্বালাও-পোড়াও! আসলে ভাই বহু মানুষের কাজ-কর্ম নাই।…'
সাজাহান ভাই বলতে শুরু করলে থামতে পারেন না। আমি বেশি সময় দিলাম না তাকে। এখনই বিদায় না নিলে তিনি চা খেতে জোর করবেন, সময় ফুরিয়ে যাবে। আমি 'জিগার মে দম' নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম — এই আকালে এটুকুই যা সম্বল।