‘১০ টাকার ডাক্তার’ ডা. এবাদুল্লাহ
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আরোগ্য নিকেতন' উপন্যাসটি যদি পড়ে থাকেন, তবে সেই পরোপকারী মশাইয়ের কথা মনে আছে নিশ্চয়! মনে না থাকলে, একটু মনে করিয়ে দিই। মশাই ছিলেন দেবীপুর নামক এক অখ্যাত গ্রামের প্রখ্যাত কবিরাজ। মশাই সেবার ব্রত নিয়ে কবিরাজি করতেন কয়েক পুরুষ ধরে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে গ্রামের সমস্ত মানুষের চিকিৎসা দিতেন। এই মশাইয়ের ওষুধ আর সেবায় অনেক সময় মুমূর্ষু রোগী পর্যন্ত জীবন ফিরে পেত। আর তাই, মশাইয়ের ডাক্তারখানার নাম 'আরোগ্য নিকেতন'।
এসব তো গল্প উপন্যাসে হরহামেশা হয়ে থাকে। সত্যি সত্যি হয় নাকি? হয় বটে! এমনই এক জ্বলজ্যান্ত মশাইয়ের সন্ধান পাওয়া গেল সাতক্ষীরায়। মোঃ এবাদুল্লাহ নামের এক চিকিৎসক মাত্র ১০ টাকা ফি'তে দেখেন রোগী। শুরুটা কিন্তু আজকালের নয়। ৪৬ বছর ধরে ডা. মোঃ এবাদুল্লাহ এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর চিকিৎসা সেবা। বর্তমান যুগে যেখানে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের পরামর্শ ফি কম করে হলেও ৫০০-৭০০ টাকা, সেখানে ডা. মোঃ এবাদুল্লাহ মাত্র ১০ টাকা ফি'তে রোগী দেখেন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কাদাকাটি গ্রামে ডা. মোঃ এবাদুল্লাহর জন্ম। ১১ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছোটোবেলা থেকেই এবাদুল্লাহ ছিলেন মনোযোগী ছাত্র। রেজাল্টও তেমন ভালো। প্রথম বিভাগে আশাশুনি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করলেন। একসময় দাদা নওয়াব আলী মেধাবী এবাদুল্লাহর পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব নেন।
দাদা নওয়াব আলী চেয়েছিলেন, নাতি এবাদুল্লাহ ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। তিনি এবাদুল্লাহকে ডাক্তার হিসেবে ব্যবসার পরিবর্তে সেবাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলতেন। ডা. এবাদুল্লাহ দাদার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি ডাক্তার হবেন, মানুষের সেবা করবেন। কেউ কথা রাখে না, এ কথা সত্যি নয়। কেউ কেউ কথা রাখে। এবাদুল্লাহও দাদাকে দেওয়া কথা রাখলেন সারাজীবন ধরে।
ডা. এবাদুল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধা। তখনও তিনি ডাক্তার হন নি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি কোনোরকম একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেন নি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মেডিকেল কলেজ থেকে ফিরে যান নিজ এলাকা সাতক্ষীরায়। মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত সময়জুড়ে তিনি নির্যাতিত মা-বোনদেরকে চিকিৎসা প্রদান করেছেন। পাশাপাশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে অনেককেই দিয়েছেন চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা, করেছেন যুদ্ধের গোপন খবরাখবর বিনিময়। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এবাদুল্লাহ সেসময় আশ্রয় দিয়েছেন নিজের বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসক হিসেবে জীবন শুরু করেন।
সময়টা ১৯৮০ সাল। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় চিকিৎসক এবাদুল্লাহ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মাত্রাতিরিক্ত ফি দিয়ে গরিব মানুষের পক্ষে এমবিবিএস ডাক্তারের চিকিৎসা নেওয়া অবাস্তব কল্পনা মাত্র। ডাক্তার হয়ে দাদার কাছে করা প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন না তিনি। তরুণ ডাক্তার এবাদুল্লাহ গরিব, অসহায় মানুষকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনার জন্যে হাসপাতালে সেবা দানের পাশাপাশি নিজস্ব চেম্বার শুরু করলেন। ফি নির্ধারণ করলেন মাত্র ৫ টাকা। এরপর আর থেমে থাকেন নি তিনি। চালিয়েছেন অসংখ্য অসহায় মানুষের চিকিৎসা। বাঁচিয়েছেন বহু প্রাণ।
বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতাল, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করেছেন ডা. এবাদুল্লাহ। ২০১০ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর যান অবসরে। কিন্তু অবসর নেওয়ার পরও রোগীর সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন নি তিনি। ডাক্তারদের জীবনে অবসর বলে কিছু থাকে না বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।
এখন পর্যন্ত নিরলসভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন সেবা। অনেকটা বাধ্য হয়েই ২০১৫ সালের দিকে রোগী দেখার ফি সামান্য বাড়িয়ে ১০ টাকা করতে হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল, ক্লিনিক ভাড়া, স্টাফদের বেতনসহ মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফি বাড়াতে হলো। তবে তিনি চেষ্টা করেছেন ফি যাতে রোগীর ওপর অতিরিক্ত বোঝা না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখার, জানালেন সেবাব্রতী চিকিৎসক এবাদুল্লাহ নিজেই।
"আমার ক্লিনিকের নাম নওয়াব মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশান সেন্টার। ক্লিনিকের নাম আমার দাদার নামে রেখেছি। দাদা-ই আমাকে সর্বপ্রথম মানুষকে ভালোবাসবার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে আমি সারাজীবন মানুষের সেবা করবার চেষ্টা করেছি। এখনো করে যাচ্ছি। যতদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকব, করবো। আমি যখন ৫ টাকায় সেবা দেওয়া শুরু করেছি অনেক মানুষ খুব ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে। '৫ টাকার ডাক্তার' বলে হাসাহাসি করেছে। আমি নিন্দুকের কথায় কান দেই নি। কাজ করে গেছি। টাকা পয়সা বা খ্যাতি কোনোকিছুরই প্রয়োজন নেই আমার। আমি শুধু মানুষের দোয়া চাই," বলেন ডা. এবাদুল্লাহ।
অসহায়, গরিব ও দুঃস্থ মানুষ ডা. এবাদুল্লাহকে ভালোবাসে। দেখে শ্রদ্ধার চোখে। সাতক্ষীরা জেলায় সবাই ডা. এবাদুল্লাহকে চেনে গরিবের ডাক্তার নামে। শহরের আনাচে কানাচে শুধু ডাক্তার এবাদুল্লাহর নামটুকু বললে যে কেউ চিনবে, হোক সে ফেরিওয়ালা কিংবা দিনমজুর। শুধু শহর নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলার মানুষের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয়। এমনকি উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও তাঁকে চেনে, সম্মান করে।
ভ্যানচালক শুকুর আলী। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তার। ছেলের চিকিৎসার জন্যে যান ডা. এবাদুল্লাহর কাছে। তাঁর চিকিৎসায় ছেলে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে যায়। শুধু ডাক্তার ফি স্বল্প তাই নয়, ডা. এবাদুল্লাহর ক্লিনিকে বিভিন্ন টেস্টের খরচও তুলনামূলকভাবে কম। ডাক্তারের আন্তরিক ব্যবহারে মন ভালো হয়ে যায়। এমন ডাক্তার হাজার বছর বেঁচে থাকুক– এমন কথা বলতে বলতে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়লো এই ভ্যানচালকের কণ্ঠে।
নওয়াব আলী হাসপাতালে গিয়ে দেখা হলো আয়না খাতুনের সাথে। তিনি জানালেন, "আমার স্বামী মারা যায় আজ থেকে ৩০ বছর আগে। গৃহকর্মীর কাজ করে পেট চালাতে হয়। আমার ছেলে মেয়ের বিভিন্ন রোগবালাইয়ে ছুটে আসি ডা. এবাদুল্লাহর কাছে। তিনি গরিব মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমরা কী আর ১,০০০ টাকা ফি দিয়ে ডাক্তার দেখাতে পারি? এই ডাক্তার ফি নেন ১০ টাকা। বেঁচে যাওয়া ফির টাকা দিয়ে ওষুধ পথ্যটুকু কিনে নিতে পারি।"
সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোগী আসেন ডা. এবাদুল্লাহর খোঁজে। নওয়াব মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশান সেন্টারে গেলে, সকাল কিংবা বিকেলে দেখবেন রোগীদের ভিড়। এসব রোগীর অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। তবে রোগীদের মুখে হীনম্মন্যতার বদলে দেখতে পাবেন প্রশান্তির ছাপ। কারণ ডাক্তারের পরামর্শ ফি এর কথা ভেবে রোগ লুকোতে হচ্ছে না অন্তত।
বেশ সময় নিয়ে রোগী দেখেন ডাক্তার। প্রয়োজনীয় পরামর্শের পাশাপাশি দু'চারটে কথা, কিছুটা কুশল বিনিময়। বর্তমানে অধিকাংশ ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে গেলে ওষুধ লেখবার সাথে সাথে যন্ত্রচালিত কিছু কথা, এরপরেই কম্পাউন্ডারের বের হওয়ার তাগাদা। না, নওয়াব মেমোরিয়াল ক্লিনিক মোটেও তেমনটি নয়। 'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য'— এ কথা কতটা সত্যি, তা বুঝবেন এই আদর্শবান ডাক্তারের ক্লিনিকে পা ফেলতেই।
ডা. এবাদুল্লাহ'র কম্পাউন্ডার সুধীন কুমার দাস। ৪০ বছর ধরে নওয়াব মেমোরিয়াল ক্লিনিকে কাজ করেন তিনি। "এত বছর ধরে কাজ করে একটা জিনিস শিখেছি, মানুষকে ভালোবাসতে পারাটাই আসল। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৭০-৮০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন। ক্লিনিকে দুইজন নার্সসহ এক্সরে, ইসিজি প্রতিটা ডিপার্টমেন্টে আলাদা করে একজন টেকনিশিয়ান আছেন। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে," বলেন সুধীন।
সাতক্ষীরা শহরে যখন সেভাবে উন্নত চিকিৎসা সেবা শুরু হয় নি– ডাক্তার সংখ্যাও সীমিত– তখন ডা. এবাদুল্লাহ'র মতো চিকিৎসক এসেছিলেন গরিব রোগীদের পথের দিশা হয়ে। 'কীর্তিমানের মৃত্যু নেই' এ কথা কে না জানে? ডা. এবাদুল্লাহ তাঁর সেবার মাধ্যমে, কর্মের মাধ্যমে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন বহুদিন। সেবার ধর্মকে সামনে রেখে ডা. এবাদুল্লাহর মতো করে যদি অন্য চিকিৎসকরাও এগিয়ে আসেন, তবে বাঁচবে দেশের গরিব, অসহায় আর সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি চিকিৎসকদের নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা কিছুটা হলেও বদলাবে।