‘ওই দেশ': কোকাকোলার বিতর্কিত বিজ্ঞাপন যেভাবে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করেছে
ধরুন, আপনি কোনো একটা বিষয়ে অবস্থান নিচ্ছেন। কিন্তু কেউ আসলে ঠিকভাবে বুঝতেই পারলো না যে, আপনার অবস্থানটা কী?
সম্ভবত, এটা কোনো অবস্থান ব্যক্ত করাও না। তাহলে এটা কি এক প্রকার আর্জি? বলছিলাম কোকাকোলার সম্প্রতি প্রচারিত ক্যাম্পেইনের কথা।
মূলত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আক্রমণকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে নানা পণ্য বর্জনের ডাক ওঠে। এই বয়কট প্রচারণার প্রসঙ্গক্রমে যুক্ত হয় কোকাকোলার নামও। এক্ষেত্রে কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ডটি ইসরায়েল থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখা এবং ফিলিস্তিনকে যে তারা প্রকৃতপক্ষে স্বীকৃতি দেয় সেটা দেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে।
তবে কোকাকোলার উদ্যোগ পুরোপুরিভাবে ভোক্তার মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ বরং এটি তাদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি করেছে; যে পরিস্থিতির সাথে পানীয়ের কোম্পানিটি খুব একটা পরিচিত নয়।
মূল প্রসঙ্গটি উঠেছে যখন ক্যাম্পেইনে 'ওই দেশ' কথাটি ব্যবহার করার ফলে। মূলত এটি দ্বারা ইসরায়েলকে বোঝানো হয়েছে।
উপস্থাপনের এই পদ্ধতিটি দর্শকেরা খুব একটা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। কেননা যে দেশটির বিরুদ্ধে অনেকটা গণহত্যার মতো অভিযোগ রয়েছে, তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয়নি।
ইসরায়েল কি কোকাকোলার লর্ড ভলডেমর্ট?
বিষয়টি খুব একটা পরিষ্কার না।
বিজ্ঞাপনটির মাধ্যমে দর্শকদের জানানো হয় যে, কোকাকোলার মূলত ফিলিস্তিনে ফ্যাক্টরি রয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সত্যিকার অর্থেই কোম্পানিটির তা রয়েছে।
মূলত গাজা উপত্যকায় কোকাকোলার একটি বোতলজাত প্ল্যান্ট রয়েছে। তবে ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান জাহি খৌরি উদ্যোগটি না নেওয়া পর্যন্ত এটিকে প্রায় অকল্পনীয় বলেই মনে করা হতো। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিলিস্তিনে ফিরে তিনি এই ফ্যাক্টরিটি স্থাপন করেন।
খৌরি মূলত অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্ল্যান্টটি পরিচালনা করেছেন৷ যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই ইসরায়েলি আগ্রাসনের কট্টর সমালোচক ছিলেন।
তার এই সমালোচনা এতটাই শক্ত ছিল যে, ২০১৫ সালে একটি ইসরায়েলি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কোকাকোলার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছিল। এক্ষেত্রে যুক্তি ছিল কোম্পানিটির ফিলিস্তিনি সহায়ক সংস্থা এনবিসি-এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে। প্ল্যান্টের মালিক খৌরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বয়কট কিংবা নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনে সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন।
খৌরির সম্পর্কে কোকাকোলার ওয়েবসাইটেও তথ্য দেওয়া রয়েছে৷ এছাড়া সেখানে ন্যাশনাল বেভারেজ কোম্পানির (এনবিসি) ওভারভিউ পেজের গেলে দেখা যায়, ফিলিস্তিনে কাজ করা সাবসিডারিটি নিয়ে কোকা-কোলা বিবরণ দিয়েছে।
যেখানে লেখা, "এনবিসি গাজাসহ প্রায় ১ হাজার এসোসিয়েটের মাধ্যমে নানা সুবিধা প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে কোকা-কোলাও পরোক্ষভাবে ১০ হাজার ফিলিস্তিনিদের রিটেইল চ্যানেল ও ভ্যালু চেইনের মাধ্যমে সহায়তা করে।"
ওয়েবসাইটে প্যালেস্টাইনের অন্যান্য অনেক এলাকার কথাও উল্লেখ করা হয় যেখানে এনবিসি কাজ করছে। সেসব জায়গার পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট নির্মাণ, স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন ও ইফতারের আয়োজন করা হয়।
এবার বিজ্ঞাপনে ফিরে আসা যাক। কোম্পানিটি এর পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
গত রবিবার প্রকাশিত বিবৃতিতে কোকাকোলা মালয়েশিয়া বলে, "মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কার্যক্রমে নিয়ে 'মিথ্যা তথ্য', ভুলভাবে উপলব্ধি করা ও গুজবের উপর ভিত্তি করে বয়কটের আহ্বান করা হয়েছে। কোকাকোলা ও আমাদের স্থানীয় বোতল প্রস্তুতকারক এনবিসি ফিলিস্তিনের মার্কেটের প্রতি দীর্ঘমেয়াদে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৯৯৮ সালে উৎপাদন শুরু করে আমরা আজ এই অঞ্চলের বৃহত্তম নিয়োগদাতাদের একটি।"
এক্ষেত্রে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোকা-কোলা এনবিসির মাধ্যমে ফিলিস্তিনের তৃতীয় বৃহত্তম নিয়োগদাতা কোম্পানি ছিল।
একইসাথে তাদের ওয়েবসাইটে একটি পুরো পেইজই রয়েছে যার টাইটেল হচ্ছে, "কোকা-কোলা কী নিজেদের লভ্যাংশ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দিয়ে থাকে?"
কোকাকোলার বার্তায় ফিলিস্তিনের জন্য সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে তা রাষ্ট্রত্ব বা অন্য কিছুর জন্য নয়। বরং তা সেখানকার জনগণের জন্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনটি বরং অনেকটা গ্যাসলাইটিং হিসাবে কাজ করেছে।
নতুন বিজ্ঞাপনটিতে কোকাকোলাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এখানে কোকাকোলাকে ১৯৬৬ সালে আরব লীগ যে ২০ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেছিল সেই বিষয়টির ব্যাখ্যা উঠে আসেনি। মূলত ম্যানহাটনের ব্যাংকার ও তৎকালীন ইসরায়েল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম ফেইনবার্গকে ইসরায়েলি কোকা-কোলা ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে যুক্ত করার কারণে এ নিষেধাজ্ঞার সূত্রপাত হয়েছিল।
এদিকে পশ্চিম তীরের অধিকৃত অঞ্চলে কোকাকোলার ফ্যাক্টটিগুলোকেও বিতর্কিত বলে মনে করা হয়। সেক্ষেত্রে ২০২০ সালে জাতিসংঘও অবৈধভাবে ইসরায়েলি বসতিতে কার্যক্রম পরিচালিত করায় কোম্পানিটিকে 'কালো তালিকাভুক্ত' করেছিল।
এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞাপনে শুধু 'ওই দেশ' বলা এবং কোনো সম্পর্ক নেই বলে প্রচার করা বেশ বিভ্রান্তিকর।
অবশ্যই, এক মিনিটের একটি বিজ্ঞাপনে বছরের পর বছর ধরে চলা রাজনৈতিক বার্তাটি তুলে ধরা বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে সম্ভবত এই ধরণের অসাবধানতা নিয়ে প্রচারণা করার প্রয়োজন ছিল না।
এক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে কিছু তুলে ধরতে না পারলে কিছু না করাই বরং ভালো। কেননা পরিশেষে আমরা শুধু ভাবছি যে, বিজ্ঞাপনটি কী নিয়ে ছিল? যদিও তা ভাইরাল হয়েছে; তবে সেটা কীভাবে তা বিবেচ্য বিষয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধটিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে না