রাশিয়ায় দাড়ি, ডেনমার্কে গরু: বিচিত্র সব কর আরোপের কাহিনী
জন্ম, মৃত্যুর মতো করও যে অবধারিত, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে করের ধরন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষের দাড়ি, স্তন ও কাপড়চোপড়ের উপর কর আরোপ করেছে পূর্বের অনেক সরকার। কর আরোপ করা হয়েছে তেল, সাবানের মতো অনেক পণ্যের উপরও। চলুন দেখে নেওয়া যাক ইতিহাসের অদ্ভুত সব করের দৃষ্টান্তকে-
ফ্যাশন নাৎসি পিটারের দাড়ি কর
একবার ইউরোপ ভ্রমণ করে রাশিয়ান জার পিটার দ্য গ্রেট এতোই মুগ্ধ হন যে দেশে ফিরে নিজের মাতৃভূমিকে 'ইউরোপীয়করণ' করার প্রকল্প হাতে নেন তিনি। এই ইউরোপীয়করণের ফাঁদে প্রথম কাটা পড়ে জনগণের দাড়ি!
দাড়ির উপর ভালোরকম কর আরোপ করেন পিটার। আর এই কর আদায়ের জন্য বর্বরতম আচরণ করতেও দ্বিধা বোধ করেনি পিটারের পুলিশ বাহিনী। সেসময় রাস্তায় দাড়িওয়ালা কাউকে পেলেই গাছের শিকড় বা ভোঁতা কিছু দিয়ে তাদের দাড়ি টেনে তোলা হতো, মাঝে মধ্যে দাড়ির সঙ্গে উঠে আসতো গালের চামড়াও।
দাড়ি-কর কিন্তু পিটারের একমাত্র ফ্যাশন-ফ্যাসিজম ছিল না। প্রজাদেরকে তাদের পরিচিত দীর্ঘ রাশিয়ান ওভারকোটগুলোকে ফেলে দিয়ে ফরাসি বা হাঙ্গেরিয়ান জ্যাকেট পরার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। চিরায়ত রাশিয়ান ধারার কাপড়-চোপড় পরে কেউ রাস্তায় বের হলে জারের পুলিশ তৎক্ষণাৎ কাপড় ছিঁড়ে ফেলার অধিকার রাখত!
কেরালার স্তন কর
উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে নিম্ন বর্ণের হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশে কাপড় পরার রীতি ছিল না। দক্ষিণ ভারতের কেরালায় এই রীতি নিয়ে কড়াকড়ি অবস্থানে চলে যায় প্রদেশের তৎকালীন রাজা। নিম্ন বর্ণের নারীদের স্তনের উপর করই আরোপ করে বসেন তিনি।
বুকের ওপর কোনো কাপড় পরতে চাইলে তখন স্তন কর দিতে হতো নারীদের। স্তনের আকারের উপর নির্ভর করতো সে করের পরিমাণ।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের চেরথালার এজহাভা গোত্রের নিম্ন বর্ণের এক হিন্দু নারী আত্মঘাতী প্রতিবাদ করেন এই করের বিরুদ্ধে। অর্থাভাবে স্তন কর দিতে অপারগ নাঙ্গেলি নামের সেই তরুণী শুল্ক সংগ্রাহকদের উপস্থিতিতে নিজের দুই স্তন কেটে তাদেরকে দেন। অতিরিক্ত রক্তপাতে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয় ঠিকই, কিন্তু এই আত্মোৎসর্গের বদৌলতে পরিবর্তিত হয় বর্বরোচিত আইনটি। নাঙ্গেলির আত্মোৎসর্গকে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন আধুনিক নারীবাদীরা।
প্রাচীন রোমের মূত্র কর
প্রাচীন রোমে মানব মূত্রকে একটি মূল্যবান পণ্য হিসেবে দেখা হতো। প্রস্রাবের অ্যামোনিয়া ব্যবহার করে অনেক কিছুই পরিষ্কার করতো রোমানরা। কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে দাঁত মাজা, মূত্রের ব্যবহার ছিল সব জায়গায়।
সুযোগ বুঝে তাই গণ শৌচাগারের মূত্র থেকে চলা ব্যবসার উপর কর বসিয়ে দেন সম্রাট ভেসপাসিয়ান (খৃস্টপূর্ব ৬৯-৭৯)। রোমের তৎকালীন অভিজাত সমাজ এই করের নিন্দা জানালেও কর সংগ্রহ বন্ধ করেননি সম্রাট। বরং, অদ্ভুত এই কর থেকে ভালো পরিমাণ রাজস্ব তুলতে সক্ষম হন তিনি।
ব্রিটিশ রাজের সাবান কর
একটা সময় ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণী নিম্নবিত্তদের 'দুর্গন্ধযুক্ত কীট' বলে গালাগাল করত। কিন্তু তাদের গালাগালে যে ব্যাপারটি উঠে আসত না সেটি হচ্ছে, নিম্নবিত্তের গায়ের গন্ধের পিছনে রয়েছে তাদের প্রশ্রয়ে জারি হওয়া এক কালো আইন।
১৭৭২ সালে সাবানের উপর বিশাল পরিমাণ কর আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ রাজ। যার কারণে সাবানের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। নিম্নবিত্তরা সাবান কেনার সামর্থ্যই হারিয়ে ফেলে। করের ধকল না নিতে পেরে সাবান প্রস্তুতকারীরা কালো বাজারে সাবান বিক্রি শুরু করে।
প্রায় দেড়শ বছর এভাবে চলার পর ১৮৫৩ সালে এই আইন পরিবর্তন করা হয়।
মিশরের তেল কর
প্রাচীন মিশরে প্রচলিত ছিল এই কর। তেলের ব্যবসা একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ফারাওয়ের সৈন্য সামন্তরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরদারি করত কেউ ভাজা তেল ব্যবহার করে রান্না করছে কি না, কিংবা তেল ব্যতীত অন্য কোনো সস্তা বিকল্প দিয়ে রান্না করছে কি না।
কারো বাড়িতে হেরফের ধরা পরলে তাকে জরিমানা গুণতে হতো। জরিমানার অর্থ সরাসরি যেত ফারাওয়ের কাছে।
কানাডার অভিবাসী কর
বর্তমানে নিজেদের অভিবাসীবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করে ফেলা কানাডায় একসময় প্রচলিত ছিল বেশ বর্ণবাদী এক কর। ১৮৮৫ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত চীন থেকে আসা অভিবাসীদের বিশাল অঙ্কের কর দিয়ে প্রবেশ করতে হতো কানাডায়। সুদূর প্রাচ্য থেকে অভিবাসীদের কানাডায় প্রবেশে নিরুৎসাহিত করতেই চালু হয়েছিল এই কর।
ইউরোপের ইন্টারনেট ট্যাক্স
আধুনিক যুগেও কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু আছে অনেক অদ্ভুত কর ব্যবস্থা। ফ্রান্সসহ ইউরোপের বেশ কিছু রাষ্ট্রে চালু রয়েছে 'গাফা ট্যাক্স' নামের এক ধরনের ইন্টারনেট কর।
দেশের জনগণের ডাটা ব্যবহার করার জন্য গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক এবং অ্যামাজনের উপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর আরোপ করে দেশগুলো। ফ্রান্স প্রথম দেশ হিসেবে এই কর আরোপ শুরু করে। এই চার কোম্পানির বার্ষিক আয়ের উপর ৩ শতাংশ কর তুলে দেশটি।
ডেনমার্কের গরু কর
গ্রিনহাউজ গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে একটি অদ্ভুত কর প্রচলিত আছে ইউরোপে। গরুর বায়ুত্যাগ থেকে ক্ষতিকর মিথেন নিঃসৃত হওয়ায় গরুর উপরই কর আরোপ করে ইউরোপের অনেক দেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর আদায় করে ডেনমার্ক। প্রতি গরুর জন্য প্রায় ১০ হাজার টাকা কর নেয় দেশটি।