গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র কি পারবে এই চাহিদা মেটাতে?
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও ন্যাটো সামরিক জোটের সংঘাতের আশঙ্কায় আরও ঘনীভূত হচ্ছে জ্বালানি সংকট দেখা দেওয়ার ঝুঁকি। ইউরোপের প্রায় অর্ধেক গ্যাস চাহিদা মেটায় রাশিয়া। ন্যাটোর সাথে সরাসরি সংঘাত হলে, রুশ সরকার ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেবে- এমন আশঙ্কায় ত্রস্ত পশ্চিম ইউরোপিয় কয়েকটি দেশের সরকার প্রধানেরা। ইউরোপের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক গ্যাসই রাশিয়ার উদ্দেশ্যসাধনের শক্তি বা 'লেভারেজ'- যা দুর্বল করতে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অবদান।
প্রশ্ন হলো- বাইডেন প্রশাসন কী পারবে ইউরোপে ট্যাংকার জাহাজে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পাঠিয়ে রাশিয়ার সুবিধাকে দূর করতে? তারই বিশ্লেষণ করেছেন বৈশ্বিক জ্বালানি নীতি বিশেষজ্ঞ অ্যামি মেয়ার্স হ্যাফে।
ইউরোপ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর কতোটা নির্ভরশীল, প্রধান সরবরাহক কারা?
ইউরোপে মোট ব্যবহৃত প্রধান জ্বালানি পণ্যের এক-পঞ্চমাংশ হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। মহাদেশের ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস পুড়িয়ে। শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখতে গ্যাস চালিত হিটারসহ শিল্প উৎপাদনেও লাগে জ্বালানিটি।
ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের বৃহত্তম সরবরাহক রাশিয়া। মহাদেশটির ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটায় রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে আসা গ্যাস। পাইপলাইনে গ্যাস রপ্তানিতে তারপর আছে নরওয়ে (২২%), আলজেরিয়া (১৮%) এবং আজারবাইজান (৯%)। এছাড়া, জাহাজে করে এলএনজি-ও আমদানি করতে হয় ইউরোপকে।
সাম্প্রতিক কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উৎস থেকে এলএনজি আমদানি বাড়িয়েছে ইউরোপ। দৈনিক এ আমদানির পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট। আমদানির বিপুলতা বুঝতে হলে, জেনে রাখুন- একটি এলএনজি কার্গো জাহাজে প্রায় ১ লাখ ২৫ থেকে ৭৫ হাজার কিউবিক মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস বহন করা যায়। এ পরিমাণ জ্বালানি দিয়ে শীতকালে ব্রিটেনে এক কোটি ৭০ লাখ বাড়ি উষ্ণ রাখা যায়।
আমেরিকা থেকে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির বড় বাঁধাগুলো কী কী?
এলএনজি উৎপাদনের জন্য প্রথমে প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনে করে বন্দরে নিতে হয়, সেখানে তরলীকরণের প্ল্যান্টে তা প্রক্রিয়াকরণের পর বিশেষায়িত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ট্যাংকার জাহাজে ভরে সমুদ্রপথে পাঠানো হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাসকে শীতল করে তাপাঙ্ক মাইনাস ১৬২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নামিয়ে এনে এলএনজি তৈরি হয়। এতে গ্যাসের প্রসার ৬০০ গুণ কমে যায়।
এলএনজি গ্রহণের জন্য অফলোডিং বন্দরে অবশ্যই রিগ্যাসিফিকেশন (পুনঃগ্যাসীয়করণ) প্ল্যান্ট থাকতে হবে। ওই প্ল্যান্টে এলএনজিকে আবার গ্যাসে রূপ দিয়ে পাইপলাইনে করে মূল ভূখণ্ডের গ্রাহকদের কাছে পাঠাতে হয়।
এই ব্যবস্থায় একটি বড় সমস্যা বিনিয়োগ আর সময়। রিগ্যাসিফিকেশন ও লিকুইডিফিকেশন- উভয় ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপনের দরকার হয় শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ। স্থাপনে লেগে যায় একাধিক বছর।
এর আগে ২০০৯ সালে ইউক্রেনের সাথে এক আর্থিক বিবাদের জের ধরে রাশিয়া দেশটিতে গ্যাস সরবরাহ ২০ দিনের জন্য স্থগিত রাখে। ইউক্রেন হয়ে পাইপলাইনে ইউরোপে আসতো রাশিয়ার গ্যাস। সেটি ব্যাহত হওয়ায় তখন ইউরোপকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হয়। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো তাদের রিগ্যাসিফিকেশন অবকাঠামোর সংখ্যা তখন থেকেই পর্যায়ক্রমে ২৯টিতে উন্নীত করে।
ইউরোপের পুনঃগ্যাসীকরণ প্ল্যান্টে বর্তমানে বাড়তি সক্ষমতা রয়েছে। আরও আছে মজুদ রাখার সুবিশাল অবকাঠামো, যাতে দীর্ঘসময় ধরে এলএনজি রাখা যাবে।
এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা সরবরাহের উৎসে। বিশ্বের শীর্ষ এলএনজি রপ্তানিকারকরা এখনই তাদের সক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রপ্তানি করছে। যতটুকু তারা রপ্তানি করছে তার চেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন বা তরলীকরণের ক্ষমতাও নেই তাদের হাতে।
এলএনজির বিশ্ববাজারে অবশ্য খানিকটা নমনীয়তা রয়েছে। নির্ধারিত গন্তব্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী চুক্তির অধীনে বিক্রি হয় বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ এলএনজি। দীর্ঘমেয়াদি ক্রয়চুক্তিতে এগিয়ে আছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন। কিন্তু, রাশিয়ার রপ্তানি বন্ধের কারণে ইউরোপে সংকট গুরুতর হলে এই দেশগুলোর সরবরাহকরা তাদের জন্য নির্ধারিত চালানকে ইউরোপমুখী করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সরবরাহকরা কি আগেও এভাবে তাদের শিপমেন্টের গন্তব্য বদলেছে?
এক্ষেত্রে প্রধান উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল ২০১১ সালের ভয়াল সুনামি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাপানের ফুকুশিমা দাইচি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র। অন্যান্য স্থাপনাতেও এমন বিপর্যয় দেখা দিলে মোকাবিলার জন্য কতোটা প্রস্তুতি আছে তা নিরূপণে এসময় নিজেদের সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখে জাপান।
এসময় এলএনজি রপ্তানিকারকরা জাপানের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেয়, অন্য দেশের জন্য নির্ধারিত চালান দিয়ে সাহায্য করে । ফলে জরুরি পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের শক্তি পায় টোকিও।
আজকাল বিশ্লেষকরা বলছেন, সরবরাহক দেশগুলি এবং আমদানিকারকরা যৌথভাবে চেষ্টা চালিয়ে যে পরিমাণ চালানের গন্তব্য বদলাতে পারবে, তা দিয়ে ঘাটতির মাত্র ১০-১৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। যদিও সেজন্য তাদের বর্তমানে চেয়ে অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে।
ইউরোপে এলএনজি চালান বাড়ালে কী মার্কিন ক্রেতাদের জন্য দাম বেড়ে যাবে?
বিগত কয়েক মাস ধরে পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি রপ্তানির সকল অবকাঠামো।
বাজারদর বেশি থাকায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার মোট এলএনজি শিপমেন্টের প্রায় অর্ধেকই ইউরোপে যায়। এর আগে মার্কিন এলএনজির বৃহত্তর অংশ রপ্তানি হতো চীনে। দেশটিতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ক্ষরার কারণে পানির অভাবে পড়ায় তাদের শক্তি উৎপাদন কমে যায়। বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণে আমেরিকা থেকে গ্যাস আমদানি বাড়িয়েছিল বেইজিং।
অর্থাৎ, চীনের জন্য নির্ধারিত চালান ইউরোপে আগেও পাঠাতে পেরেছে মার্কিন কোম্পানিগুলো। তবে তা না করলে ওই গ্যাস স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা যেত।
জ্বালানি নীতি বিশেষজ্ঞ অ্যামি মেয়ার্স হ্যাফে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে যদি প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম আগামী কয়েক সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে; তাহলে এলএনজি রপ্তানির চেয়ে স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল রাখাই তখন অগ্রাধিকার পাবে।
- লেখক: অ্যামি মেয়ার্স হ্যাফে যুক্তরাষ্ট্রের টুফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসিতে গবেষণা অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত আছেন।
- সূত্র: সাইটেক ডেইলি