হাজার বছর পুরনো টি হর্স রোডের খোঁজে
ঝং হঙ্গি হাঁটছেন আমার পাশে। বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলেই এগোচ্ছেন তিনি। তবে মাঝেমধ্যে চোখের কোনা দিয়ে নজর বুলিয়ে নিচ্ছেন হাতে থাকা স্মার্টফোনের দিকে। ওটার ডিসপ্লেতে একটা ম্যাপ খোলা আছে। একটু অদ্ভুতুড়ে এ ম্যাপটা এখানকার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েক হাজার বর্গমাইলের পাথুরে রুক্ষ উপত্যকার। আমরা এখন আছি দক্ষিণপশ্চিম চীনে।
আমরা যে পথ হারিয়েছি সেটা এতক্ষণে টের পেয়ে গেছি। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমাদের উদ্দেশ্য প্রাচীন টি হর্স সড়কটা খুঁজে বের করা। কিন্তু এই টি হর্স সড়কটা কী?
গত নয় বছর ধরে আমি পৃথিবীর পথে হাঁটছি। আমার পূর্বমুখী এ যাত্রা শুরু হয়েছে হোমো স্যাপিয়েন্সদের আদিভূমি আফ্রিকা থেকে। বিগত ছয় মাস টি হর্স সড়ক আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার পথসঙ্গী ঝং হঙ্গি একজন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার। কোনো কিছুতেই তার ক্লান্তি নেই। কোথাও যেন তার হারিয়ে যাওয়ার মানা নেই।
টি হর্স সড়কের কথা
বিখ্যাত সিল্ক রোড বা রেশম পথের কথা কে না জানে। এ বাণিজ্যিক মহাসড়ক থেকে দক্ষিণে যে শাখা রাস্তাটি বেরিয়ে গিয়েছিল সেটিই হচ্ছে টি হর্স রোড। প্রায় দুর্ভেদ্য কিছু ট্রেইল আর হাঁটাপথের তৈরি এই সড়ক বেশ কয়েক শতাব্দী পুরনো। অনেকে তো মনে করেন টি হর্স সড়কের বয়স ২০০০ বছরেরও বেশি।
সে আমলের বণিকেরা এ সড়ক ধরে ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশ থেকে চা-পাতার খণ্ড (তখনকার দিনে চা-পাতাকে চেপে ইটের টুকরার মতো করে পরিবহন করা হতো) নিয়ে চলে যেতেন তিব্বতে। তার বিনিময়ে তারা তিব্বত থেকে নিয়ে আসতেন বলিষ্ঠ টাট্টু ঘোড়া।
শুধু কি তা-ই? হাতে তৈরি কাগজ, রেশম, জেড পাথর, আফিম, সোনা, ও লবণ; খচ্চর, ইয়ক, আর মানুষের পিঠে চড়ে এসব পণ্য চলে যেত দূরদূরান্তে। সেকালে এ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চীনকে সংযুক্ত করেছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও উত্তর ভারতের সাথে।
টি হর্স সড়কের বণিকেরা একবার পথে বেরোলে তাদের সে যাত্রা শেষ হতে হতে মাস, সপ্তাহ এমনকি বছরও পেরিয়ে যেত। মাঝপথে কখনো কখনো দস্যু হানা দিতো। মাস্কাট বন্দুকের ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে যেত যখন দস্যুদের সাথে বণিকদের লড়াই শুরু হতো। এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারেও সাহায্য করেছিলেন এ বণিকেরা।
সেকালের পর্যটকেরা
মিং গোত্রের শাসনকালে চীনে শু শায়াক নামে একজন বিখ্যাত পর্যটক, ভ্রমণকাহিনী লেখক, ও ভূগোলবিদ ছিলেন। ১৫৮৭ সালে জন্ম নেওয়া এ বোহেমিয়ানের পরিবার ছিল ভীষণ ধনী। কিন্তু সেসবের মায়া না করে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
পদব্রজে শু শায়াক চীনের পার্বত্য অঞ্চল ও নদী-আববাহিকায় হাজারো মাইল হেঁটে বেড়িয়েছিলে। তার ডায়েরিতে তিনি লিখে রেখেছিলেন মিং শাসনামলের সময় চীনের ভূতত্ত্ব, ভূগোল, উদ্ভিদবিজ্ঞান, স্থানীয় ইতিহাস ইত্যাদি।
চীনদেশে অনেক বিখ্যাত পর্যটকের জন্ম হয়েছিল। খ্রীস্টের জন্মের দুই শতাব্দী আগে মধ্য এশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন চীনা কূটনীতিক ঝ্যাং কিয়ান। এই পর্যটকের মাধ্যমেই বিখ্যাত সিল্ক পথের যাত্রা শুরু হয়। ছিলেন ঝেং হে-এর মতো চীনা নাবিক যিনি ১৫ শতকে বাণিজ্যপোত নিয়ে আফিকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন।
অন্য চীনা পর্যটকেরা সম্রাট বা সরকারের পক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। শু শায়াক ছিলেন তাদের চেয়ে আলাদা। প্রকৃতির প্রতি আগাধ ভালোবাসা ও নিজের ভ্রমণ পিপাসা মেটানোর জন্যই ধনী পরিবারের আরাম-আয়েশ ছেড়ে ভবঘুরে জীবনযাপনের পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
শায়াক শেষবারের মতো ভ্রমণ করেছিলেন ইয়ুনানের কঠোর, গ্রীষ্মপ্রধান পথে। তার পা পড়েছিল টি হর্স সড়কে। আজ চারশ বছর পরে আমরা তার মাড়ানো সেই টি হর্স সড়কে পা রাখলাম। তবে এখন এটাকে সড়ক বলার জো নেই। একসময়ের ব্যস্ত এই সড়কের বুকে এখন কেবল নির্দ্বিধায় বেড়ে ওঠা বুনো জঙ্গলের রাজত্ব।
মা শুন হি'র গল্প
বয়স নব্বই পেরিয়ে গেছে। শুইজাই-এ বাস করা মা শুন হি যৌবনে খচ্চর চালাতেন। ইউনানের এ গ্রামটি টি হর্স সড়কের পাশে বেড়ে ওঠা একটি দূরবর্তী গ্রাম। নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে আমাদের গল্প শোনাচ্ছিলেন এ বৃদ্ধ।
'আমরা সবকিছুই পরিবহন করতাম,' বলেন বুড়ো মা। দালি থেকে মায়ানমার সীমান্তে কয়েক দশক ধরে খচ্চরের ক্যারাভান চালাতেন তিনি। ভালোই আয় হতো তখন। 'ও কী বলে নিজেই ঠিকমতো জানে না,' আলাপের মাঝখানে বলে উঠলেন মা-এর অশীতিপর স্ত্রী ইয়াং ফেং জিন। 'আমার স্বামী বেজায় ভালো লোক ছিলেন। বণিকেরা তখন ভালোই ব্যবসায় করতো। এখন সে বুড়ো হয়ে গেছে। তার হাঁটু আর কাজ করে না,' জিন বলে চলেন।
টি হর্স-এর আরও একটু ইতিহাস
১৯৩০-এর দশক পর্যন্তও রমরমা ছিল টি হর্স বাণিজ্যপথ। ফরগটেন কিংডম বইয়ে হোয়াইট রাশিয়ান বণিক পিটার গুলার্ট বর্ণনা করেছেন কীভাবে দুর্ধর্ষগতিতে টি হর্স সড়ক ধরে চলতো ক্যারাভানগুলো। '(ক্যারাভানের) প্রাণীগুলোর ওপর সবসময় শ্রাব্য-অশ্রাব্য সব গালির বহর ছুটতো। তার পাশাপাশি তাদের জুটতো ছোট ছোট পাথরের ঢিল ও মাটির টুকরা,' লিখেছেন পিটার গুলার্ট।
৭০ বছর বয়সী ওয়ান চেংশেন একসময় টি হর্স সড়কে ইয়কের ক্যারাভান চালাতেন। বরফঢাকা সড়ক ধরে ৭০০ মাইল পাড়ি দিয়ে তার ক্যরাভান পৌঁছাত উত্তরের সিচুয়ান প্রদেশে। 'আপনি মশায় ভাবতেও পারবেন না ওই ক্যারাভানগুলো কতটা আনন্দ ও উত্তেজনার অনুভূতি সাথে করে নিয়ে আসতো। ক্যারাভানগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা পেতাম পুরো বাইরের দুনিয়াটা,' স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
একালের প্রহরীরা
রবিঠাকুরের ছোটগল্প রাজপথের কথায় এক সচল পথের অবদমিত পরিতাপের কথা ফুটে উঠেছে। 'আমি কিছুই পড়িয়া থাকিতে দিই না, হাসিও না, কান্নাও না। আমিই কেবল পড়িয়া আছি,' রাজপথের এই আক্ষেপ হয়তো টি হর্স সড়কেরও আছে। কিন্তু টি হর্স যেন কালের গর্ভে পড়ে না থাকে সেজন্য কাজ করছেন একালের অনেকেই।
নাশি আদিবাসী গোত্রের অ্যাঞ্জেলা ইয়ানফেং কান একজন পরিবেশবিশারদ। টি হর্স সড়কের পাশে এক গ্রামে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার পড়াশোনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশ্বজোড়া পাঠশালা তার। ওয়াইল্ড মাউন্টেইন নামের একটি অলাভজনক সংস্থা চালান তিনি।
তার এ সংস্থার উদ্দেশ্য স্থানীয় আদিবাসীদেরকে টেকসই উপায়ে পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে সহায়তা করা। তাদের লক্ষ্য স্থানীয় প্রাকৃতিক ও বাস্তুসংস্থানগত উপাদানগুলোর কোনো ক্ষতি না করে সামগ্রিক উন্নয়ন করা।
আপনাকে স্বাগতম জানানোর জন্য টি হর্স সড়কের পার্শবর্তী এসব গ্রামের ইয়ানফেং কানেরা অপেক্ষা করে আছে। তারা আপনাকে নিয়ে যাবে আরও উত্তরে, টি হর্স সড়ক বেয়ে।
টি হর্স সড়কের শেষ চিহ্নটুকু টিকিয়ে রাখতে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন জোসেফ ফ্রাংকিস চার্লস রক। নিজের জীবনের দীর্ঘ কয়েক বছর টি হর্স সড়কের ওপর গবেষণা করে কাটিয়েছেন এ বিজ্ঞানী। টি হর্সের গাছপালার নমুনা তুলে নিয়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন পশ্চিমের বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলোতে, অ্যাকাডেমিক নোট লিখেছেন টি হর্স সড়কের নৃতত্ত্ব নিয়ে। এ সড়কের ম্যাপের যেসব স্থান ফাঁকা ছিল, সেগুলোও পূরণ করেছেন চার্লস রক।
টি হর্স সড়কে আজও লোকেরা ঘুরতে আসে। তাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। তবে টি হর্সের ইতিহাসের পরতে পরতে সমৃদ্ধির ছোঁয়া। তাই এখানে যে যা-ই খুঁজুক না কেন, সেটা পেতে তাকে বেগ পেতে হয় না। স্রেফ একটু নিজের মতো করে খোঁজার অপেক্ষা। নিজের ঝাঁপি উজাড় করে দিতে সবসময়ই প্রস্তুত টি হর্স।
- ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে অনূদিত