বেগমের একটি ঈদসংখ্যা ও ১৬৯টি লেখা-বিজ্ঞাপনের গল্প
১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক বেগম ৩৭ বছর পূর্ণ করে। সে বছর বেগমের ঈদসংখ্যা বের হয় জুনের ২০ তারিখে। মোট ২৪৬ পৃষ্ঠা ছিল বেগমের ঈদ উপহার। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ মিলিয়ে মোট লেখা ছিল ১৬৯টি।
বেগমের ওই ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল তিনটি গোলাপ ফুলের ছবি। প্রচ্ছদের আলোকচিত্রটি তুলেছিলেন মোস্তফা জাহাঙ্গীর আলম। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন আইনুল হক মুন্না। ভেতরের অঙ্গসজ্জায় ছিলেন প্রাণেশ কুমার মণ্ডল ও আইনুল হক মুন্না। প্রচ্ছদের পরই ৬ পৃষ্ঠা পুরো পাতা বিজ্ঞাপন। প্রথমটি তানিন রঙিন টেলিভিশনের, যারা নিজেদের রঙিন টিভির জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঘোষণা করছে। তারপর কমান্ডার সোপ কোম্পানী লিমিটেডের (১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা) কসকো গ্লিসারিন সাবানের (দেশের প্রথম স্বচ্ছ বা ট্রান্সপারেন্ট সাবান, ১৯৯০ পর্যন্ত শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল) বিজ্ঞাপন। পরের পাতায় প্রিমিয়ার সোপ ফ্যাক্টরি ও প্রিমিয়ার অয়েল মিলসের ফুল মার্কা কাপড় কাচার সাবান, হাঁস মার্কা কাপড় কাচার সাবান, হাঁস মার্কা বল সাবান ও হাঁস মার্কা খাঁটি সরিষার তেলের বিজ্ঞাপন।
রিগার্ডের গোলাপ জলের (পোলাও, বিরিয়ানি বা মাংসে ফ্লোরাল ফ্লেভার আনতে এটি ব্যবহার করা হয়) বিজ্ঞাপনও রয়েছে পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে। তারপর মন্নু সিরামিকস, নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ও সোয়ানটেক্স ফ্যাশনের বিজ্ঞাপন শেষে সূচিপত্র। কবিতা 'ঈদ অর্থ খুশি' লিখছেন কাজী লতিফা হক, 'স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা' লিখেছেন বেগম আজিজা এন মোহাম্মদ, বিনু আহমেদ লিখেছেন 'সবার জন্য ঈদ', হামিদা রহমান লিখেছেন 'এবারের ঈদ '৮৫'।
এছাড়া 'শাওয়াল প্রিয়া' নামের কবিতা লিখেছেন মোমতাজ বেগম, কামরুন নাজ সিদ্দিকা অরু লিখেছেন 'বেহেস্তী সুরা', সৈয়দ কানিজ ফাতেমা হোসেন বুলবুল লিখেছেন 'ঈদের শপথ'। 'ঈদের গান', 'ঈদের অনুভূতি', 'ঈদ তুমি এলে', 'ঈদের ব্যাখ্যা', 'রোজা তোমার লাগি', 'ঈদ প্রতিশ্রুতি', 'অপেক্ষার শেষ' নামের কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে। বেগম গুরুত্ব দিয়েই প্রতি সংখ্যার সব লেখিকাদের মুখচ্ছবি প্রকাশ করত।
পঁচাশির ঈদ সংখ্যায় যারা লিখেছিলেন তারা হলেন সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, সামস রশীদ, জোবেদা খানম, অধ্যক্ষ খোদেজা খাতুন, ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী, রাজিয়া মাহবুব, জাহানারা আরজু, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, রিজিয়া রহমান, মকবুলা মনজুর, জুবাইদা গুলশান আরা, সুচিত্রা বর্মন, ঝর্নাদাশ পুরকায়স্থ, সাইদা খানম, খালেদা এদিব চৌধুরী, বেলা দাউদ, বিনু আহমেদ, মালিকা আল রাজী, ফোরকান বেগম, দিল মনোয়ারা মনু, সুরাইয়া আলমগীর বনলক্ষ্মী।
সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো নগরীতে লেখা সুফিয়া কামালের 'মস্কোতে রোজার চাঁদ' নামের কবিতাটি ছাপা হয়েছিল ওই ঈদসংখ্যায়। তার প্রথম চারটি লাইন এমন:
চিরপুরাতন সেই চাঁদ! আজ নতুন করিয়া এল
চিরপুরাতন তবুও লাবণ্য কি করিয়া সে পেল
এসেছে ভুবন ভরিয়া এসেছে, এই তুষারের দেশে
আমার বাংলাদেশের মতোই স্নিগ্ধ মধুর হেসে।
এবার বেগমের কয়েকজন লেখিকা সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলা যেতে পারে। ড. নীলিমা ইব্রাহিম (১৯২১-২০০২) ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমির অবৈতনিক মহাপরিচালক ছিলেন। তাঁর বহুলপঠিত গ্রন্থ আমি বীরাঙ্গনা বলছি ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশ পায়।
ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী (১৯২০-২০০৬) ছিলেন বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দ্বিতীয় থেকে নবম ও দশম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যপুস্তকের অন্যতম লেখিকা। ১৯৮২ সালে সাহিত্য ও গবেষণায় অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার লাভ করেন।
জাহানারা আরজুর জন্ম ১৯৩২ সালে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মহিলা সাপ্তাহিক 'সুলতানা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে নীলস্বপ্ন, রৌদ্র ঝরা গান, ক্রন্দসী আত্মজা, আমার শব্দে আজন্ম আমি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রিজিয়া রহমান (১৯৩৯-২০১৯) ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে বিচরণ করেছেন। প্রথম উপন্যাস ঘর ভাঙা ঘর তিনি লিখতে শুরু করেন ১৯৬৭ সালে। তাঁর বং থেকে বাংলা-ও বহুল পঠিত উপন্যাস। উপন্যাসে অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে পান একুশে পদক।
মকবুলা মনজুর (১৯৩৮-২০২০) বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে (এখন রূপালী ব্যাংক) অফিসার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তবে ইচ্ছা ছিল শিক্ষক হওয়ার, তাই প্রায় অর্ধেক বেতনে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন হলিক্রস উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরে তিনি ইউনিভার্সিটি উইমেন্স কলেজ ও সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। তিনি প্রায় ২৫ বছর সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার ফিচার সম্পাদক ছিলেন।
ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত শিশুসাহিত্যিক ও গীতিকার। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০২২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুগ্রন্থ মুশকিল আসান মামা, ইভানের কাজলা দিদি, রং মাখা শার্ট ইত্যাদি।
সাইদা খানম (১৯৩৭-২০২০) দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী। তিনি বেগম পত্রিকার আলোকচিত্রী ১৯৫৬ সাল থেকে। ১৯৬২ সালে চিত্রালী পত্রিকার হয়ে তিনি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবি তোলেন। পরে সত্যজিৎ রায়ের তিনটি ছবিতেও তিনি আলোকচিত্রী হিসাবে কাজ করেন। জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়।
মালিকা আল রাজী (১৯১৯-২০০০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে লন্ডনে গিয়ে পিএইচডি করেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে মেরিকুরী ও আলবার্ট আইনস্টাইন, গীতি মিতালী (গান), নব নব ধারা (কবিতা) উল্লেখযোগ্য।
সূচীপত্র পেরিয়ে আবার বিজ্ঞাপন। আর্মানীটোলার আর্মানিয়ান স্ট্রিটে ছিল আয়ুর্বেদীয় ফার্মাসী। বাজারে তাদের ছিল সুরভিত এপি১৫ কেশ তেল। এপির মধু আজো বাজারে আছে। ২০২০ সালের জাতীয় মৌ মেলায় প্রথম পুরস্কারও পেয়েছে।
তারপর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজ্ঞাপন পেলাম। বিমানের ট্যাগ লাইন তখন ছিল 'ঘরোয়া পরিবেশে ভ্রমণ করুন'। বিমান কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের প্রতি একটি চিঠি লিখেছে, তার কিছুটা এখানে রইল—'সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ, বিশ্বের তিনটি মহাদেশের ২৩টি মহানগরীতে চলাচলকারী আমাদের সুপরিসর ডিসি ১০-৩০ ও বোয়িং ৭০৭ বিমান শতকরা ৮৭ ভাগেরও বেশি সময়ানুবর্তিতা অর্জন করেছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটে আমাদের এফ-২৮ ও এফ-২৭ বিমান দেশের ৮টি গন্তব্যস্থলে নিয়মিত যাতায়াত করছে।… আমাদের সঙ্গে আপনার ভ্রমণ হবে আনন্দদায়ক ও আরামদায়ক।'
তারপর ওয়ান্ডার সাইন পাবলিসিটির তৈরি গংগা হারবাল হেয়ার টনিকের বিজ্ঞাপন দেখলাম। উল্লেখ্য, টিপু সুলতান রোডের ওয়ান্ডার সাইন অনেকদিন রাস্তার ধারের বিলবোর্ড জগতে আধিপত্য বজায় রেখেছিল।
তারপর শায়লা হক মিতার তোলা দুটি ছবির একটি হলো নদীর পাড়ে বেদে শিশুরা খেলছে, আরেকটি রেল প্লাটফর্মে ঘুম (বিশ্রাম)।
তারপর কয়েকটি গদ্য রচনা—'আমাদের জীবনে রোজার প্রভাব', 'জাকাত দানের গুরুত্ব' এবং 'দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের প্রয়োজনীয়তা'।
এ সংখ্যায় গল্প লিখেছেন আফসারুন্নেসা ও রাজিয়া মাহবুব, নাম যথাক্রমে 'রৌদ্র মেঘের খেলা' ও 'স্ফুলিঙ্গ'।
তারপর দুই পৃষ্ঠাজুড়ে শিরীন সুলতানার আলোকচিত্র, শিরোনাম—ওরা কাজ করে, গাভীর পরিচর্যা, গ্রামের খাল পার হচ্ছে, জেলেনী জাল বুনছে এবং কৃষিকাজে তরুণী। ছাপা হয়েছে আনজুমান আর বেগমের উপন্যাস—অনেকদিনের পরে।
এরপর হাবিবা খাতুনের সাহিত্য সংস্কৃতিতে মুঘল মহিলাদের অবদান শীর্ষক বেশ উপভোগ্য একটা লেখা ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, মুঘল মহিলা কবিদের মধ্যে গুলরুখ বেগম (গুলবদনের বোন), সেলিমা সুলতানা বেগম (বৈরাম খাঁর স্ত্রী ও পরে আকবরের স্ত্রী), সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, রাজকুমারী জাহানারা, জেবুন্নেসা প্রমুখের নাম সবার জানা। পারিবারিক তুর্কী ভাষা ছাড়াও তাঁরা ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখতেন। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান উন্নত সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি মেয়েদের নতুন নতুন পোশাক তৈরি ও আতর বানাতে জানতেন। তিনি অনুষ্ঠানুযায়ী খুশবু ব্যবহার করতেন। শাহজাহান-কন্যা জাহানারা ১৬৭১ সালে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির জীবনী ও তার বংশ পরিচয় সংবলিত পুস্তক রচনা করেন। রাজদুহিতা জেবুন্নিসা কোরান শরীফ হেফজ করেছিলেন। তাঁর লেখা কবিতাগুচ্ছ ও লিপিগুচ্ছ যথাক্রমে দেওয়ানী মাখফী ও জীযুল মুনাত।
এরপর পাওয়া গেল শ্রদ্ধাজ্ঞাপনমূলক একটি গবেষণামূলক লেখা। দিল মনোয়ারা মনুর লেখাটির শিরোনাম, 'যাদের লেখায় বেগম-এর প্রথম বর্ষ ছিল সমৃদ্ধ'। এ থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম প্রকাশিত হয় বেগম। বাংলা ভাষায় মেয়েদের আর কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল না। বলা হচ্ছে, আজ (১৯৮৫) থেকে ৩৭ বছর আগে প্রথম বর্ষে যাদের রচনা সম্ভারে বেগম এর অগ্রযাত্রা সাবলীল হয়ে ওঠে তারা হলেন—কবি বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, কবি মাহমুদা সিদ্দিকা, কবি জাহানারা আরজু, রাজিয়া খাতুন, রোকেয়া আনোয়ার, আশাপূর্ণা দেবী, হাসিরাশি দেবী, মাজেদা খাতুন, সেলিনা পন্নী, লায়লা সামাদ, সাইদা খানম, নূরজাহান বেগম, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী প্রমুখ।
প্রথম সংখ্যায় কবি সুফিয়া কামালের শুভেচ্ছাবাণীর কিছু অংশ এমন: 'বর্তমানে এই নবজাগরণের দিনে নতুন জাতীয় সংগঠনের এই যুগ সন্ধিক্ষণে মুসলিম নারীদের এই লজ্জাকর দারিদ্র্য আরো করুণ চেহারায় আমাদের অন্তর ব্যথিত করিয়া তুলিতেছে। এই জন্যই বহুবিধ বাধাবিঘ্ন ও অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমরা সাপ্তাহিক বেগম লইয়া মুসলিম নারী সমাজের খেদমতে হাজির হইলাম। প্রথমসংখ্যার লেখিকাদের মধ্যে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক লেখক ও রাজনীতিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রোকেয়া জীবনী, শিশুর শিক্ষা ইত্যাদি। কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা পঞ্চাশ বছর ধরে কবিতার জগতে বিচরণ করেছেন। বেগমের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল আমৃত্যু। মন ও মৃত্তিকা, অরণ্যের সুর তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। রাজিয়া খাতুন (পরে রাজিয়া মজিদ) মূলত ছোটগল্পকার। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ করাচীর চিঠি, দিগন্তের স্বপ্ন, ভ্রান্তিবিলাস ইত্যাদি। রোকেয়া আনোয়ার ছিলেন লেখিকা ও সমাজকর্মী। বেগমে তিনি প্রবন্ধ ও ফিচার লিখতেন। বেগমের প্রথম সংখ্যায় তিনি 'মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড' নামের প্রবন্ধ লিখেছেন। সেটির কিছু অংশ এমন—কিছুকাল পূর্ব হইতে ভারতীয় রাজনীতিতে বিভিন্নমুখী নীতিধারা অবলম্বন করিবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়াছে। এই প্রয়োজনের তাড়নায় মুসলিমলীগ মনোনিবেশ করিল মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সংগঠনে। হাসিরাশি দেবীও ছিলেন ছোটগল্পকার। এছাড়া নূরন নাহার কছির প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন লেখার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। বেগমে চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন হুসনা বানু খানম। হোসনে আর খালেদা খানম লিখতেন মূলত গল্প ও ফিচার। তাকে বলা হয় প্রথম মুসলিম মহিলা সাংবাদিক।'
এরপর বেগম ঈদসংখ্যা '৮৫-এর আরেকটি লেখা মনোযোগ আকর্ষণ করল। সেটির নাম 'জগৎজোড়া পাখির মেলা'। সেখান থেকে জানা গেল, ঠোঁট, পা, পালকভেদে পাখিদের আলাদা করা হয়। পাখিদের মূলত দুই ভাগ—ডাঙার পাখি ও জলচর। লম্বা ও চোখা চঞ্চুবিশিষ্ট পাখিরা উভচর। এরা লম্বা ঠোঁটের সাহায্যে মাছ ধরে খায় যেমন মাছরাঙা, বক ইত্যাদি। জলের পাখিদের পা হয় হাঁসের মতো, যেমন পানকৌড়ি, প্যালিকান। পাখির স্ত্রী-পুরুষ চেনা যায় পালকের বর্ণ দেখে। স্ত্রী পাখির রঙ পুরুষ পাখির তুলনায় অনুজ্জ্বল হয়, কারণ তারা লতা-পাতায় মিশে গিয়ে ডিমে তা দেয়।
তারপর আরেকটি গবেষণামূলক লেখা পেলাম, 'আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান'। রীনা ইয়াসমিন মিতি লিখেছেন 'ঘর সাজানো রুচির পরিচয়'। 'স্ত্রীর স্মৃতিতর্পণে রবীন্দ্রনাথ' লেখাটি লিখেছেন তাহমিনা বানু বিএবিটি।
চার পাতাজুড়ে কার্টুন ছাপা হয়েছে এ সংখ্যায়। এর শিরোনাম 'কথা আর কাজের ব্যবধান'। এর বিষয় হলো নারী অধিকার আন্দোলনের নেতা জনসভায় যা বলছেন তার উল্টোটা করছেন গিয়ে ঘরে।
একটি বুটিক শপের বিজ্ঞাপন পেলাম শেষদিকে গিয়ে। ইস্ট ওয়েস্ট ডিসপ্লে নামের শপটি ছিল ধানমন্ডিতে। যারা বলছে, রং ডিজাইন, পরিপাট্য ও উজ্জ্বলতার বিচারে মনের মতো পোশাকটি আমাদের কাছেই পাবেন। আরো বলছে, মহিলা পুরুষ ও ছোট্টমনিদের সবার প্রয়োজনই আমরা মেটাই। সপ্তাহের প্রতিদিনই খোলা সকাল ৯টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, বেগমের কার্যালয় কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় ১৯৫০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তখনকার সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। পরে এর সম্পাদক হন নূরজাহান বেগম। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি আর মূল্য ছিল চার আনা। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার ছবি।
বেগমের প্রথম ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। তাতে ৬২ জন নারী লেখকের লেখা ছাপা হয়। মূল্য ধরা হয়েছিল ২ টাকা। ১৯৫৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ। সেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ক্লাব। ১৯৭০ সালে ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকায় আসার পর বেগমের নতুন ঠিকানা হয় পুরনো ঢাকার পাটুয়াটুলিতে। সাপ্তাহিক বেগম এখন মাসিক পত্রিকা। নূরজাহান বেগম প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর কন্যা ফ্লোরা নাসরিন খান এর সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ সালে, চাঁদপুরে। ১৯৪২ সালে তিনি বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। তারপর লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, নূরজাহান বেগম শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, নিজের মেধা এবং যোগ্যতা দিয়ে বেগম গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬০ এবং সত্তরের দশকে বেগমের প্রচার সংখ্যা ছিল ২৫ হাজারের মতো।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেছেন, বেগম পত্রিকা শুধু নারীদের উদ্দেশ্য করেই গোড়াপত্তন হলেও এর পাঠক শুধু নারীরাই ছিলেন না। ধীরে ধীরে এই পত্রিকা পুরুষদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, তখনকার সমাজে মুসলিম নারী লেখক তৈরিতে বেগম পত্রিকার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। পঞ্চাশের দশকে এই বেগম পত্রিকা শিক্ষিত মুসলিম নারী লেখকদের একটি বড় প্লাটফর্ম হয়ে ওঠে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, বেগম পত্রিকা তৎকালীন সমাজে নারী পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা এবং তাদের জন্য সাংস্কৃতিক বিনোদন দেবার একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, আসছে জুলাইয়ে বেগমের বয়স ৭৫ হবে।