পাতা, ফল, ছাল-বাকল: ‘প্রকৃতির ফার্মেসি’ নিমের যতো গুণ
আয়ুর্বেদে নিমগাছকে বলে 'প্রকৃতির ফার্মেসি'। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় নিম এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
নিমগাছে আছে ১৩০টির অধিক অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের ভারতীয় প্রতিবেদক নীতা লালা লিখেছেন, জীবদ্দশায় তিনি তার দাদুকে কখনো টুথপেস্ট বা টুথব্রাশ ব্যবহার করতে দেখেন নি। নিজেদের উঠোনের নিম গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে তা দিয়েই প্রতিদিন দাঁত মেজে নিতেন নীতার দাদু। ইম্যুনিটি বাড়াতে তিনি কখনো নিমের পাতা চিবোতেন, মাথায় নিমের তেল মাখতেন আবার মশামাছি তাড়াতে নিম গাছের বাকল সেদ্ধ পানি ঘরে ছিটিয়ে দিতেন। নীতার দাদুর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা শতাব্দীর পর শতাব্দী নিমকে বিশ্বের সবচেয়ে বহুমুখী ওষধি গাছ হিসাবে প্রচার করেছেন; এটি এমনই এক উদ্ভিদ যার প্রতিটি অংশ কোন না কোনভাবে উপকারে লাগবেই!
ভারতের ইয়োগা এবং আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ ভারতী রাঘব নিমের উপকারিতা নিয়ে বলেন, "নিমের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য একে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের বিরুদ্ধে কার্যকর করে তোলে।"
আয়ুর্বেদ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে নিম কীভাবে চর্মরোগ, চুলের সমস্যা, ক্ষত নিরাময় করে, ক্ষুধা ও হজমশক্তি বাড়ায় এবং বমি ভাব দূর করে।
দিল্লি-ভিত্তিক আরেকজন যোগব্যায়াম এবং আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ বিবেক আচার্য দিয়েছেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। তিনি বলেন, নিম অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ভ্রমণের সময় কিংবা সচরাচর নিমগাছ পাওয়া যায় না, এমন স্থানে গেলে শুকনো এবং গুঁড়ো করা নিম সাথে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিবেক। নিমের গুঁড়া দীর্ঘদিন ভাল থাকে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে নিমের কদর এখন সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। নিমগাছ রোপণ করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রান্তে।
তবু যেসব দেশে নিম গাছ জন্মে না, সেখানেও এখন অনলাইনে নিমের সাপ্লিমেন্টস এবং বিভিন্ন ওষুধ মেলে। নিম ক্যাপসুল, টিংচার, গুঁড়া, প্রসাধনী, তেল, ক্রিম, শ্যাম্পু, মাউথওয়াশ, টুথপেস্ট- নিমের উপস্থিতি এখন ব্যাপক।
আধুনিক গবেষণাও নিমের স্বাস্থ্যগত দিকগুলোকে হাইলাইট করেছে। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের একটি রিপোর্ট নিমের ঔষধি এবং অন্যান্য গুণকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেয়।
সেখানে বলা হয়, উদ্ভিদের মধ্যে নিম সবচেয়ে সম্ভাবনাময়; এটি এমনই এক উদ্ভিদ যার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে এই গ্রহের প্রতিটি মানুষ।
"কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে এই বৃক্ষ একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে, স্বল্প খরচে ঔষধ সরবরাহ করতে পারে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে দিতে পারে, ভূমিক্ষয়, বন উজাড় এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাসেও ভূমিকা রাখতে পারে।"
সে প্রতিবেদন প্রকাশের তিন দশক পেরিয়েছে; নিম নিয়ে গবেষণা থেমে থাকেনি। ক্যান্সার থেকে করোনাভাইরাস- একের পর এক উন্মোচিত হয়েছে নিমের গুণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটি এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের বিজ্ঞানীদের নতুন সমীক্ষা অনুসারে, নিম গাছের বাকলের নির্যাস করোনাভাইরাসের বিস্তার কমাতে সক্ষম।
নিমের যতো উপকারিতা
নিমের ডাল- অনেকেই নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মেজে থাকেন। নিমের ডাল জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে, লালায় ক্ষারীয় ভারসাম্য বজায় রাখে, ব্যাকটেরিয়াকে দূরে রাখে, মাড়ির প্রদাহ মোকাবেলা করে, দাঁত পরিষ্কার রাখে এবং প্লাক ও ক্যাভিটি রোধ করে। ডাল চিবোলে মুখের পেশীর ব্যায়ামও হয়ে থাকে।
নিমতেল- কসমেটিকস শিল্প এবং রূপচর্চায় নিমের নির্যাস থেকে প্রাপ্ত তেলের প্রচুর চাহিদা। এতে আছে অ্যান্টি-এজিং প্রপার্টিজ, যা ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। এটি চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মশা তাড়াতে 'মসকুইটো রেপেলেন্ট' হিসেবে এর ব্যবহার হচ্ছে ইদানীং। মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করলে নিমের তেল চুলকে মজবুত করে, চুল পড়া রোধ করে এবং খুশকি নিরাময় করে।
নিমের ছাল- এ গাছের ছাল ম্যালেরিয়া, পাকস্থলী ও অন্ত্রের আলসার, চর্মরোগ এবং জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি দাঁতের বিভিন্ন রোগও সারিয়ে তোলে।
নিমপাতা- নিমপাতার ব্যবহার বলে শেষ করা যাবে না। এশিয়ার অনেক অঞ্চলে মাথার উকুন, চর্মরোগ, ক্ষত এবং আলসারের চিকিৎসায় নিমপাতা বাটা ব্যবহৃত হয়। 'মসকুইটো রেপেলেন্ট' হিসেবে এর ব্যবহার রয়েছে, এলার্জি বা চুলকানির সমস্যায় পাতা বেটে লাগানো যায়। পাতা সেদ্ধ পানি ছেঁকে ত্বকের অ্যান্টি-সেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। খাবার হিসেবেও নিমপাতা গুঁড়ো সেবন করেন অনেকে।
নিম ফল- নতুন চুল গজাতে এবং খুশকি ও উকুন দূর করার জন্য নিম ফল পিষে তেল বের করা হয়। কারখানায় তৈরি রুম ফ্রেশনারগুলিতে নিম ফলের ব্যবহার আছে।
নিমের ফুল- নিমের ছোট ছোট সাদা ফুল কুলিং এজেন্ট বা শীতলকারক উপাদানে সমৃদ্ধ। গরমের সময় ভারতীয়রা ডাল, ফ্লাওয়ার রাইসের মতো অনেক ডিশে এই ফুল ব্যবহার করে। কেউ কেউ আবার পরিবেশনের সময় খাবারের ওপর ছিটিয়ে দেয় শুভ্র ফুল।
এলার্জি প্রতিরোধক উপাদান থাকলেও কারো কারো নিম থেকেই এলার্জি দেখা দিতে পারে। সরাসরি নিম বা নিমের পণ্য ত্বকে ব্যবহারের আগে 'প্যাচ টেস্ট' করার পরামর্শ তাই বিশেষজ্ঞদের।
- সূত্র- সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট