গণটিকা কার্যক্রমের প্রথম দিনে ব্যাপক সাড়া, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছয় দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রথমবারের মত ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে সারাদেশে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গণটিকাদান শুরু হয়েছে। ক্যাম্পেইনের প্রথম দিন শনিবার (৭ আগস্ট) টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। কোথাও কোথাও ব্যবস্থাপনা ভালো থাকলেও অধিকাংশ টিকাদান কেন্দ্রে বরাদ্দকৃত টিকার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি মানুষ টিকা নিতে এসেছিল। উপেক্ষিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ক্যাম্পেইনে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। টিকা নেয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হলে সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ক্যাম্পেইনের প্রথম দিন সারাদেশে টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন প্রায় ২৮ লাখ মানুষ। গ্রামে সিনোফার্মা ও শহরে মর্ডানার টিকা দেয়া হয়েছে। অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও এনআইডি কার্ড দেখিয়ে ক্যাম্পেইনে টিকা নিতে পারছে ২৫ ঊর্ধ্ব নাগরিকেরা।
টিকা নিতে শনিবার সকাল সাড়ে আটটায় রাজধানীর ২৮ নং ওয়ার্ডের কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমিতে সিরিয়ালে দাঁড়ান মো. বজলুর রহমান। বেলা একটার সময় তাকে জানানো হয়, 'টিকা শেষ বাড়িতে চলে যান'।
আবার যারা টিকা নিতে পেরেছেন তাদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমিতে টিকা নেয়া ফাতেমা আক্তার টিবিএসকে বলেন, "সকাল ৯টার দিকে এসেছি। ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে ভ্যাকসিন দিতে পেরেছি। এত মানুষের মধ্যে করোনা ভ্যাকসিন নিতে এসে উল্টো করোনায় আক্রান্ত হওয়ারই ঝুঁকি বেশি"।
ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড ভিত্তিক টিকাকেন্দ্রগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সবকটি কেন্দ্রেই বরাদ্দকৃত টিকার তুলনায় তিনগুণেরও বেশি মানুষ সকাল থেকে ভিড় করে ছিল। অনেকে ভোর ৬টা থেকে টিকাকেন্দ্রে টিকা নেওয়ার জন্য অপেক্ষারত ছিলেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৪, ১৮, ২৩ নং ওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলো ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, "সঠিক পরিকল্পনার অভাবে গণটিকায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়ন বা সিটি কর্পোরেশনের সেন্টারগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবকসহ ১০-১২ জনের একটি টিম যদি দশদিন ধরে যত মানুষকে ভ্যাকসিন দিবে তাদের এনআইডি নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে মেসেজ দিত তাহলে অতিরিক্ত মানুষ সেন্টারে যেত না। এখন মানুষ জানে না কে ভ্যাকসিন পাবে বা কে পাবেনা, তাই অনেক মানুষ সেন্টারে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন সেন্টারগুলো এখন সংক্রমণের উৎস হচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে বয়স্করা ভ্যাকসিন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে"।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, "সংক্রমণ রোধে গণটিকার সুফল খুব একটা পাওয়া যাবেনা। ভ্যাকসিন মৃত্যু কমায়। তাই ক্যাম্পেইন না করে বয়স্ক, ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দিলে মৃত্যু কমতো। ভ্যাকসিনে মানুষের যেমন আগ্রহ তৈরি হয়েছে. তেমন মাস্কের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি করতে হবে। তাহলে সংক্রমণ কমবে"।
বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনার জন্য প্রথমে ছয়দিন ধরে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে পরবর্তীতে টিকার স্বল্পতায় সেই সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে।
সরকার প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করে টিকা দেয়ার নিয়ম চালু করলেও এবার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়েই টিকা নিতে পারছে মানুষ।
ডিএনসিসির ২৭ নং ওয়ার্ডের কেন্দ্র রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩০০ জনকে টিকা দেওয়া হয়। অধিকাংশই টিকা দিতে না পেরে চলে যান।
ডিএনসিসির (অঞ্চল ৫) আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদ হোসেন বলেন, "আমাদের এ কেন্দ্রে ৩০০ টিকা বরাদ্দ। যারা আজকে (শনিবার) দিতে পারেনি তাদেরকে আগামীকাল নিতে আসতে বলে দেওয়া হচ্ছে"।
ডিএনসিসি'র ২৮ নং ওয়ার্ডের কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমিতে শনিবার ভোর ৭টা থেকেই মানুষ জড়ো হতে থাকে টিকা গ্রহণের জন্য। এখানে নির্ধারিত ৩৫০ জনকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, বাকিদের আগামী দিনগুলোতে এসে টিকা গ্রহণের জন্য বলা হয়। গতকাল সকাল থেকে এক হাজারের উপরে মানুষ এ কেন্দ্রটিতে আসেন বলে জানান স্বেচ্ছাসেবকরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১২ আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পেইন চলবে। এই ক্যাম্পেইনের আওতায় সারা দেশে চার হাজার ৬০০টি ইউনিয়ন, এক হাজার ৫৪টি পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৪৩৩টি ওয়ার্ডে ৩২ হাজার ৭০৬ জন টিকাদানকারী এবং ৪৮ হাজার ৪৫৯ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে। ৮ ও ৯ আগস্ট ইউনিয়ন ও পৌরসভার বাদ পড়া ওয়ার্ডে এবং ৭ থেকে ৯ আগস্ট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় টিকাদান কর্মসূচি চলবে। দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৮ ও ৯ আগস্ট ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চালু থাকবে। এছাড়া ১০ থেকে ১২ আগস্ট জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর ৫৫ বছর বয়সীদের মধ্যে কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, "টিকা আমরা গ্রামে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। শহরের লোকেরা টিকা মোটামুটি পেয়েছে। গ্রামের বয়স্ক, দরিদ্র লোকেরা সেভাবে টিকা গ্রহণ করেনি। তাদের মধ্যে অনীহাও ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে মৃত্যু বেশি। তাদের জন্য আমাদের এই ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন"।