গণ-টিকাদান কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেও অব্যবস্থাপনায় মানুষের ভোগান্তি
টিকাকেন্দ্রে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়, তাদের অনেকেই গাদাগাদি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টিকা না পেয়েই বাড়ি ফিরেছেন। দুপুর না গড়াতেই কোন কোন কেন্দ্রে টিকাদান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানে প্রতিবাদও করেছেন অনেকে। এই ছিল দেশে গণ টিকাকরণ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে অব্যবস্থাপনার কয়েকটি দৃশ্য।
দ্বিতীয় দিনে, সিটি করপোরেশন এলাকা ও প্রথম দিন যেসব এলাকায় টিকা দেওয়া হয়নি- সেসব এলাকার মানুষ টিকা দেওয়া হয়।
কিন্তু, প্রথম দিনের মতোই দ্বিতীয় দিনেও ভোগান্তি ও দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন টিকা নিতে আসা ব্যক্তিরা। কেন্দ্রগুলোতে টিকার অপর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল যার প্রধান কারণ। এছাড়া, গাদাগাদি ভিড় করে মানুষকে অপেক্ষা করতে হওয়ায় টিকাদান কর্মসূচি কোভিড সুপারস্প্রেডার ইভেন্ট হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন টিকা নিতে মানুষের সাড়া পাওয়া নিয়ে আর উদ্বেগ নেই, বরং মূল উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ব্যবস্থাপনাকে ঘিরে।
তারপরও, মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতেই জোর দিচ্ছে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। রোববার (৯ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ছয় দিনের গণ-টিকাকরণ কর্মসূচিতে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ টিকার আওতায় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এনিয়ে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বলেছেন, প্রথম দিনে ২৯ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন, যা আমাদের টার্গেটের কাছাকাছি। আমাদের ধারণা এটি ৩৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। টিকারও কোন সংকট হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৯ আগস্ট টিকা দেওয়া হবে দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায়। আর ১০-১২ আগস্ট পর্যন্ত ৫৫ বছরের বেশি বয়সী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে টিকা কর্মসূচি চলবে।
ডা. শামসুল হক বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে সোমবার থেকে থানচি উপজেলার ভিতরে হেলিকপ্টারে করে টিকা নিয়ে গিয়ে কর্মীরা টিকাদানের কাজ করবে। সম্প্রসারিত এ কর্মসূচির অধীনে গ্রামে সিনোফার্ম ও (শহরে) সিটি করপোরেশন এলাকায় মর্ডানার ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।
আজকের মতো টিকা দেওয়া শেষ': টিকা না নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন মানুষজন
গত শনিবার গণটিকা কর্মসূচির প্রথমদিন সকালে প্রভাতী হাই স্কুল কেন্দ্রে টিকা নিতে এসেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীন ৩৫ নং ওয়ার্ডের দিলু রোডের বাসিন্দা জাহিদুর রহমান। তবে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও টিকা পাননি। তাই টিকাদান সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হলেও রোববার ভোর সাড়ে পাঁচটায় এসে তিনি টিকা কেন্দ্রের সামনে বসে অপেক্ষা করছিলেন। তবে বেলা ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরই কেন্দ্রের ভিতরে থাকা সিটি করপোরেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, সেদিনের মতো টিকাদান শেষ হয়ে গেছে।
জাহিদুর রহমান একা নন, তার সঙ্গে অপেক্ষমাণ আরও প্রায় এক হাজার জন টিকা না পেয়ে ফেরত চলে যান।
ঢাকার অন্যান্য কেন্দ্রেও এমন অভিযোগ শোনা গেছে।
সবাই কমিশনারের লোকজন:
ঢাকার অনেক টিকাকেন্দ্রে আসা নাগরিকরা অভিযোগ করেছেন যে, স্বেচ্ছাসেবী এবং রাজনৈতিক দলের লোকজন কে টিকা পাবেন আর কে পাবেন না- তা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন।
প্রভাতী হাই স্কুল কেন্দ্রে আসা নির্মল দাস জানান, তাঁর সিরিয়াল নাম্বার ৫৫ হওয়ার পরেও তিনি ভোর থেকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "এখন তারা (টিকা কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ) গেট বন্ধ করে বলছে আজকের দিনের মতো টিকার মজুদ শেষ হয়ে গেছে। অথচ সকাল থেকে তারা স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের অনুমোদিত লোকজনকে টিকা দিয়েছে।"
একই কেন্দ্রে শনি ও রোববার টানা দুইদিন লাইনে অপেক্ষা করেও টিকা পাননি শামীমা বেগম।
তিনি টিবিএস'কে বলেন, "এখানে সব নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় কমিশনার ও দলীয় লোকজন। দলীয় ৫০ জন টিকা নেওয়ার পরেই টিকাদান আজকের মতো সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।"
বিক্ষোভ:
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন গাউছিয়া রেস্টুরেন্ট টিকাকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ (১৮ নং ওয়ার্ড, হাতিরপুল) সাড়ে এগারোটার দিকেই টিকাদান শেষ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলে সেখানে সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
আকস্মিক এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন তারা। পরে পুলিশ এসে মানুষকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করে।
রোববার দেশজুড়েই এমন নাগরিক প্রতিবাদের কথা জানা গেছে।
সুপারস্প্রেডিং ইভেন্ট?
যেসব আয়োজন বা জমায়েত বিপুল পরিমাণ মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর উৎস হয়ে ওঠে- সেগুলোকেই বলা হয় সুপারস্প্রেডিং ইভেন্ট।
গত শনিবার শিশুদের মধ্যে নিয়মিত সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হওয়ায় এদিন নোয়াখালীর পাঁচটি ইউনিয়ন ছিল কোভিডের গণটিকা কর্মসূচির বাইরে। এসব ইউনিয়নে রোববার থেকে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন স্থানীয়রা।
তবে ইউনিয়ন পর্যায়ের কেন্দ্রগুলোয় ছিল নির্বাচনের দিনের মতো দীর্ঘ সাড়ি। সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। টিকা নিতে আগ্রহীরা গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন।
প্রথমবারের মতো টিকা নিতে আসা এক নারী জানান, সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়ে এখন ১১টা বাজতে চললেও অপেক্ষা করছেন। ওই নারীর আগে লাইনে ছিলেন কমপক্ষে ১৫ জন আর তাঁর পিছনে ছিলেন ৩০-৩৫ জন।
সোহেল নামে নোয়াখালীর আরেক টিকা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি বলেছেন, তিনি লাইনে দাঁড়ানো প্রায় কারো মুখেই মাস্ক দেখেননি।
"এধরনের জমায়েত মানুষের উপকারের পরিবর্তে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে," মন্তব্য করেন তিনি।
বাদ সেধেছে বৃষ্টিও:
গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে গণ-টিকাদানের দ্বিতীয় দিনেও দেখা গেছে অপেক্ষমানদের দীর্ঘ সাড়ি। তার ওপর ভ্যাকসিন নিবন্ধনের সমস্যা এবং বৃষ্টির কারণে টিকাদান কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, আগামী তিন দিনে তারা জেলায় এক লাখের বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনার আশা করছেন।
'এসএমএস পাওয়ার পর কেন্দ্রে আসবেন'
এদিকে রোববার দৈনিক বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেছেন, মুঠোফোনে বার্তা পাওয়ার পর নাগরিকদের কেন্দ্রে আসার জন্য তারা বারবার অনুরোধ করেছেন।
"সবাইকে মাস্ক পরে টিকাকেন্দ্রে আসতে হবে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।"
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টিকাকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। সকলে মিলে সহযোগিতা করলে আগামী দিনে বর্তমান সমস্যাগুলো দূর হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আরও ২৪১ জনের মৃত্যু:
এদিকে আজ রোববার (৮ আগস্ট) সকাল আটটা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৪১ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত মারা গেছেন। এনিয়ে দেশে আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর হার ২২,৬৫২ জনে উন্নীত হয়।
টানা ১৫ দিন ধরে দৈনিক দুই শতাধিক মৃত্যু ঘটছে।
রোববার নাগাদ গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্তের সংখ্যাও বেড়েছে। এসময় শনাক্ত হন আরও ১০,২৯৯ জন। একদিন আগে যা ছিল ৮,১৩৬ জন। আর এপর্যন্ত মোট শনাক্তের সংখ্যা ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯৫।
তবে একইসময় পরীক্ষার বিপরীতে পজিটিভ শনাক্তের হার বা পজিটিভিটি রেট কমে ২৪.৫২ শতাংশে নেমেছে। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পজিটিভিটি রেট কমে আসা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।