দেশজুড়ে অবৈধ আবাসন প্রকল্পের ছড়াছড়ি
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে অবৈধভাবে প্রায় দেড় হাজার বেসরকারি আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। নদী, জলাশয়, আবাদি জমি, বনভূমি, প্লাবনভূমি ও খাস জমি দখল করার পর বালু-মাটি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে এসব প্রকল্প।
তবে শেষপর্যন্ত সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর প্রায় ১০ হাজার একর জমি অবৈধভাবে দখল এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন লংঘন করে গড়ে তোলা এসব প্রকল্প চিহ্নিত করেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর এখন এসব অবৈধ প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং ইতোমধ্যেই কয়েকটি ভেঙে দিয়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন ছাড়াই নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জের নলপাথর এলাকায় প্রবাসী পল্লী গ্রুপের আবাসন প্রকল্প, স্বদেশ প্রোপাটিজের স্বর্নালী আবাসন প্রকল্প ও পূর্বাচল আমেরিকান সিটির মতো কিছু বেসরকারি আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে।
রাজধানীর উপকণ্ঠে সরকারের সবচেয়ে বড় আবাসিক প্রকল্প পূর্বাচল নতুন শহরের কাছেই এসব অবৈধ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে যুক্ত বিভিন্ন খাল ভরাট করে প্রকল্পগুলি তৈরি করা হয়েছে। অথচ এই এলাকা রাজধানীর 'ফ্লাড ফ্লো-জোন' বা বন্যার পানি নিঃসরণের প্লাবনভূমি হিসেবে নির্ধারিত।
বালু ভরাট করে এ এলাকার খাস জমি ও জলাশয় দখল করার অভিযোগও রয়েছে আলোচিত প্রকল্পগুলির কর্তাদের বিরুদ্ধে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মাদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, 'গত ২০ বছরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প কেন্দ্র করে এরকম শতাধিক বেসরকারি ভূইফোঁড় আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এগুলোর বেশিরভাগ খাস জমি, জলাশয়, বনভূমি, আবাদি জমি এবং প্লাবনভূমি দখল করে নির্মাণ করা হয়, যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী অবৈধ।'
'রাজধানীর চারপাশে এরকম আরও ৪০০ অবৈধ আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে। যাদের বেশিরভাগের অবস্থান রাজধানীর মোহ্ম্মদপুরের বসিলা, আমিনবাজার, কেরানীগঞ্জ, মাওয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়া ইত্যাদি এলাকায়।'
তিনি জানান, 'পরিবেশ অধিদপ্তর রাজধানীর আশপাশের এলাকায় এরকম প্রায় ৫০০ প্রকল্পের তালিকা করেছে। ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে বেশ কয়েকটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তারা সরেজমিন তদন্ত করছেন। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রগুলি জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি এরমধ্যেই প্রায় ৫০টি প্রকল্প তদন্ত করেছে।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হুদা বলেন, আবাসন প্রকল্পের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। তাই এসব অবৈধ প্রকল্প বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।
রাজউকের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ২০০ প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদনপত্র জমা আছে সংস্থাটির কাছে। তবে যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় এখন পর্যন্ত তাদেরকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
কর্মকর্তারা বলছেন, আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা, ২০০৪ (সংশোধিত ২০১২ ও ২০১৫) ভঙ্গ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই আবাসন কোম্পানিগুলো তাদের প্রকল্প গড়ে তুলেছে।
রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রাজধানীর আশেপাশের এলাকায় অধিকাংশ বেসরকারি আবাসন প্রকল্প রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে তোলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম অনেকগুলো প্রজেক্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।'
নাম না প্রকাশের শর্তে রাজউকের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০০৪ সালের পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কোনো বেসরকারি প্লট প্রকল্প অনুমোদন করেনি।
তিনি বলেন, ওয়েলকেয়ার সিটি, মাসকো গ্রুপের ছায়াকুঞ্জ আবাসিক এলাকা, নর্থ টাউন আবাসিক প্রকল্প এবং উত্তরা প্রবর্তন সিটি এবং রুপগঞ্জে মালুম সিটিসহ প্রায় ২০টি প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে রাজউক।
তবে সূত্রমতে, ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও এসব প্রকল্প তাদের প্লট বিক্রির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, 'ঢাকার আশপাশে যারা কৃষিজমি ভরাট করে অবৈধ আবাসন প্রকল্প তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। ফলে ভূমিদস্যুরা মানুষের সাথে প্রতারণার সুযোগ পাচ্ছে।'
তিনি বলেন, এতে আবাদি জমি ধ্বংস, বনাঞ্চল উজার, প্লাবনভূমি এবং নদী-জলাশয় ভরাটের ফলে প্রকৃতিক পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব টিবিএসকে বলেন, 'আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, রাজধানীর যেকোনো প্রকল্পের জন্য রাজউকের অনুমোদন নিতে হবে। রাজউকের ডিটেইল্ড এরিয়া প্লান- ড্যাপ এর বর্তমান সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে এসব প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে।'
এসব ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জোরোলো ভূমিকা নিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
'তবে পরিবেশ অধিদপ্তরে জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সারাদেশে পরিবেশগত নানা ইস্যুতে অভিযান পরিচলনার জন্য অধিদপ্তরে মাত্র ১৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে, যা রীতিমতো হাস্যকর।'
ঢাকার বাইরে হাজারো অবৈধ প্রকল্প:
পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সুত্র জানিয়েছে, রাজধাধানী ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের উপকণ্ঠে এরকম গড়ে ওঠা আরও প্রায় ১,০০০ অবৈধ আবাসন প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের রয়েছে প্রায় ২৫০টি, রাজশাহী বিভাগে ১৫০টি, খুলনা বিভাগে ১০০টি, রংপুরে ৫০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮০টি, বরিশালে ৮০টি এবং সিলেটে ২৫০টি।
পরিবশে অধিদপ্তর বলছে, রাজউক ছাড়াও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্প অনুমোদন করতে পারে। কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় আলাদা কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে, যাদের কাছ থেকে প্রকল্পের অনুমোদন নেওয়া যায়। এছাড়া জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন জেলা শহরে আবাসন প্রকল্প করার ব্যবস্থা রয়েছে।
তবে তার আগে কোনো প্রকল্পকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। ঢাকার বাইরে চিহ্নিত করা কোনো প্রকল্পই এমন অনুমোদন পায়নি।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিহ্যাব) এর বর্তমান সদস্য ১২০০টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে প্রায় ১৫০ প্রতিষ্ঠানের আবাসন প্রকল্প করার অনুমোদন রয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একাধিক প্রকল্প রয়েছে।
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন টিবিএসকে বলেন, 'যারা নিয়ম না মেনে প্রকল্প করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই উচিত।'
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'অনুমোদন ছাড়া এরকম কোনো প্রকল্প হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।'