বাইক্কাবিলে কমেছে পাখি, বেড়েছে প্রজাতি
শীতের এই সময়ে পরিযায়ী পাখিতে মুখরিত থাকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরের বাইক্কাবিল। এখানে নানা জাত-প্রজাতির রঙ বেরঙের পাখির কলকাকলি, খুনসুটি, ওড়াউড়ি ও পানির ভিতর ডুব দেওয়া আর দলবেঁধে সাঁতার কাটার দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। তবে এ বছর অন্যান্য বছরে মতো পাখির দেখা নেই। কমেছে পাখির সংখ্যা; তবে বেড়েছে পাখির প্রজাতি।
২০০৩ সালে হাইল হাওরের প্রায় ১২০ একরের বাইক্কাবিলকে অভয়াশ্রম ঘোষণার শুরু থেকেই বাইক্কাবিলের জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করে আসছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন’। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর পাখির সংখ্যা মারাত্মক ভাবে কমে এসেছে। এ জন্য প্রধানত জলজ বন কমে যাওয়া এবং শীত কম থাকাকে দায়ী করছে সংগঠনটি।
সেই সঙ্গে বাইক্কা বিলের ভেতরে পাখি শিকার বন্ধ থাকলেও হাইল হাওরের বিশাল একালায় বন্ধ করা যাচ্ছে না পাখি শিকার। প্রতি রাতেই বিষটোপ এবং বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করে নতুন নতুন পদ্ধতিতে পাখি শিকার করছে চোরা শিকারীরা।
বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা’র সভাপতি আবদুস সোবান চৌধুরী বলেন, চলতি বছর শীত বেশি পড়েনি। তার উপর প্রাকৃতিক কারণে কমে গেছে জলজ বন। পরিযায়ী পাখীদের বড় একটি অংশ পানিফল, হেলেঞ্চা, বল্লুয়া, চাল্লিয়া ইত্যাদিসহ পদ্ম পাতাকে ঘিরে বসবাস করে। এছাড়া এসব জলজ বন থেকে নানা ধরণের উদ্ভিদ এবং পোকা খেতে তারা পছন্দ করে। কিন্তু গত বর্ষায় প্রচুর পরিমাণ কচুরিপানা থাকায় পানির নিচে থাকা জলজ বন নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে জলচর পাখীদের সংখ্যা কমে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১২০ হেক্টরের বাইক্কাবিলের আয়তন বেড়েছে। বর্তমানে এর আয়তন প্রায় ৩০০ হেক্টর। আমাদের ৬ জন প্রহরী বাইক্কাবিলকে চোরা শিকার থেকে মুক্ত রাখতে পারলেও হাইল হাওরের মত বিশাল এলাকাতে সামলাতে প্রচুর জনবল প্রয়োজন।
সরেজমিনে বাইক্কাবিল ঘুরে দেখা গেছে, পাখির আগমন ঘটলেও তা খুবই কম। বাইক্কাবিলের ওয়াচ টাওয়ারের সামনের অংশে অন্যান্য বছর জলজবনে যেভাবে পাখির উপস্থিতি দেখা মিলত এই বছর তা নেই। ওয়াচ টাওয়ারের বাম পাশের কিছু অংশ ছাড়া বিশাল অংশ জলজবন শূন্য। জলজ বন কমে গেছে অন্তত ৫০ শতাংশ। গত বছর বাইক্কাবিলে ৩৯ প্রজাতির পাখির দেখা মিললেও এই বছর এখন পর্যন্ত (৫ জানুয়ারি) ৭০ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। যা নানা প্রজাতির পাখির জন্য বাইক্কাবিল আদর্শ জায়গা হিসেবে প্রমাণ করে ।
বাইক্কাবিলে পাখির ছবি তুলতে এসেছেন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার পাখি প্রেমী সামিয়াত জামান খান জিকো। তিনি বলেন, প্রতি বছর এই মৌসুমে পাখির ছবি তুলতে আমি বাইক্কাবিল আসি। এ বছর পাখির উপস্থিতি অন্যান্য বছর থেকে কম। তবে আমি প্রায় ৭০ প্রজাতির পাখির দেখা পেয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজ সরালি, সরালি, বালি হাঁস, পাতি তিলি হাঁস,মরচে রঙ ভুতিহাস, গিরিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, গয়ার/সাপপাখি, পাতি কূট, পাতি পানমুরগি, বেগুনি-কালেম, পানকৌড়ি, কানিবক, ডাহুক, জল ময়ূর, ছোট ডুবুরী, ধলাবক, বেগুনি বক, ধূপনি বক, মাছ রাঙ্গা, গোবক, লাল ফিদ্দা, বড় গুটি ঈগল, পুবের পানকাপাসি,পালাসি কুরাঈগল, শঙ্খচিল, প্রায় ৫/৭ প্রজাতির ফুটকি, কালা লেজ জৌরালি, তিলা লালপা, বিল বাটান, গেওয়ালা বাটান, কালাপাখ ঠেঙ্গি, লাল লতিকা টিটি, মেটেমাথা-টিটি, রাঙাচ্যাগা, ইত্যাদি।
অভিযোগ রয়েছে বাইক্কাবিল এবং হাইল হাওর থেকে রাতের আধারে প্রতিদিন পাখি শিকার করছে চোরা শিকারিরা। যা ভোরের আলো ফোটার আগেই মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট হাতে এবং স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। বিষ টোপ দিয়ে পাখি হত্যার প্রমাণও মিলেছে ছবিতে।
পাখিপ্রেমী খোকন সিংহ জানান, তিনি প্রতি সপ্তাহে বাইক্কাবিল আসেন তিনি। বাইক্কাবিলে অনেক সময় বিষটোপ দিয়ে হত্যা মৃত পাখি পড়ে থাকার ছবি তিনি তুলেছেন।
পাখি শিকারের বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ) আবদুল ওয়াদুদ জানান, পাখীদের কেউ যেনো শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা অতিরিক্ত সতর্ক আছি। তবে আমাদের জনবল দিয়ে বিশাল এলাকা পাহারা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণ জনগণ সচেতন হলে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয় ।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য মতে, প্রতি বছরই বাইক্কাবিলে অতিথি পাখি আসে। ২০১৮ সালে ১০ বছরের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ পাখি আসে বাইক্কাবিলে। ২০১৯ সালের পাখি শুমারিতে ৩৯ প্রজাতির ১১ হাজার ৬১৫টি পাখির দেখা মিলে। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়ে বিপন্ন ৫ প্রজাতি বড়গুটি ঈগল, পালসি কুড়া ঈগল, উদয়ী গয়ার, কালা মাথা কাস্তেচরা ও মরচেং ভূতিহাঁস পাখি ছিল উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পাখিবিদ ড. ইনাম আল হক জানান, এ বছর যেহেতু এখনো পাখি শুমারি হয়নি, তাই বলা যাবে না পাখি কম এসেছে নাকি বেশি এসেছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি বাইক্কাবিলে ঘুরে গেছেন জানিয়ে বলেন, আমার চোখে অনেক প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। তবে পাখি যদি কম এসে থাকে সেটা হবে দুঃখজনক। এই মাসের (জানুয়ারি) শেষেই আমরা পাখি শুমারি করব, তখন নিশ্চিত হওয়া যাবে পাখি কম নাকি বেশি এসেছে ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহ্বায়ক আ স ম সালেহ সুয়েল জানান, পাখি শিকারিরা বিভিন্ন কায়দায় পাখি ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। তাই এসব অতিথি পাখি আর বাইক্কা বিলকে নিরাপদ ভাবছে না। ফলে কমছে অতিথি পাখির সংখ্যা। সেই সঙ্গে নিয়ম না মেনে বাইক্কা বিলের আশেপাশে তৈরি করা হচ্ছে ফিসারি যার কারণে উদ্ভিদ ও জলজ বৈচিত্র্য নেই। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এই স্থানটিকে নিরাপদ রাখতে পারলে সারা বছর এখানে পাখি থাকবে।
তিনি আরও বলেন, জলজ উদ্ভিদের ভিতর লুকিয়ে থেকে পরিযায়ী পাখিরা নিজেকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে এবং খাবার সংগ্রহ করে। জলজবনে জল ময়ুরসহ অনেক প্রজাতির পাখি ডিম পাড়ে তাই জলজবন না থাকলে পাখি আসবেনা।