ভাড়া রেখে আগুন নেভাতে নেমে গেলেন সিএনজিচালক
মৌলভীবাজার শহরের সাইফুর রহমান রোডের একটি জুতার দোকানে হঠাৎ আগুন। সে আগুন নেভাতে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট। তাদের সঙ্গে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এর বাইরে অনেকেই ফেসবুকে লাইভে ব্যস্ত ছিলেন। ঠিক সে সময়ে নিজের সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি দূরে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে আগুন নেভাতে যোগ দেন মকলিস মিয়া।
এ সাহস ও দায়িত্ববোধের কারণে বিভিন্ন মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কালেঙ্গা এলাকার মকলিস শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। ঘটনার সময় তিনি সদর উপজেলার কামালপুরে যাত্রী নামিয়ে আরও কয়েকজন যাত্রীকে নিয়ে শহরের ভেতর দিয়ে কুলাউড়া উপজেলার যাওয়ার জন্য রওনা দেন।
কুসুমবাগ পয়েন্টে আসার পর মকলিসের গাড়ি আটকে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। ওই সময় পুলিশ সদস্যরা তাকে জানান, সাইফুর রহমান রোডে আগুন লেগেছে বলে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই কথা শুনে ডান দিকে ২০০ মিটার দূরে হাটবাজার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন মকলিস।
তিনি যাত্রীদের বলেন, "আমি যেতে পারব না। আপনারা অন্য একটি সিএনজি নিয়ে চলে যান।"
যাত্রী নামিয়ে হাটবাজার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে অরক্ষিত অবস্থায় অটোরিকশা রেখে মকলিস দৌড়ে চলে যান আগুন লাগার স্থান শহরের সেন্ট্রাল রোডের পিংকি শু স্টোরের সামনে। এসে যোগ দেন আগুন নেভানোর কাজে।
এই বিষয়ে মকলিস জানান, তিনি দৌড়ে গিয়ে দেখেন ভয়াবহ আগুন জ্বলছে। ওই সময় তিনি মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা চালু করতে করতে দৌড়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, শত শত মানুষ ভিডিও করছে; কিন্তু কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না।
মকলিস জানান, আগুনের ভয়াবহতা দেখে তিনি মোবাইল বন্ধ করে নেমে পড়েন নেভানোর কাজে। প্রথমে পাশের বিল্ডিং থেকে চেষ্টা করেন কুড়াল দিয়ে টিন কাটতে। টিন কেটে ভেতরে পানি ঢোকাতে ফায়ার সার্ভিসকে সাহায্য করেন। এরই মধ্যে বালু চলে এলে বালু দিয়ে গ্যাসের রাইজার থেকে আগুনের উৎস বন্ধ করতে বালু দেন তিনি।
তিনি আরও জানান, ফায়ার সার্ভিসের প্রথম দলের সাথে পাইপ নিয়ে ভেতর পর্যন্ত যান। পানির পাইপ টানতে টানতে কীভাবে চলে গেছে ২ ঘণ্টা, তা টেরই পাননি।
অগ্নিকাণ্ডের পর নেভানো পর্যন্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ব্যবসায়ী নেতা সুমন আহমদ বলেন, নিজের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে একজন সিএনজি চালক তার গাড়ি ফেলে রেখে যেভাবে আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করেছেন, তা খুব কম দেখা যায়। গতকালের ঘটনার সময় অনেকেই ব্যস্ত ছিলেন মোবাইলে ছবি ও ভিডিও ধারণ নিয়ে। পুলিশকে বারবার অতি উৎসাহী মানুষ সরানোর কাজ করতে হয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পরিমল দাস। তিনি জানান, কোনো কিছু ঘটলে সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ছবি তোলা এবং ফেইসবুকে লাইভ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এমন একটি সময়ে একজন সাধারণ অটোরিকশাচালক যেভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার ।
তিনি আরও জানান, অনেক সাধারণ মানুষ সাহায্য করেছে এবং ফায়ার সার্ভিসের কঠোর পরিশ্রমের কারণে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে।
মৌলভীবাজার ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, "আমরা সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করছি। কোনো একটি ঘটনা ঘটলে ছবি বা ভিডিও করতে গিয়ে কিছু অতি উৎসাহী মানুষ আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটায়। তবে এর মধ্যেও কিছু সাধারণ মানুষ মাঝে মাঝে পাই, যারা সত্যিই অসাধারণ।"
তিনি বলেন, "গতকালের (মঙ্গলবার) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে ছেলেটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করল, সে একজন সিএনজিচালক। কিন্তু তার সামাজিক দায়িত্ববোধ অবাক করার মতো।"
মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে মৌলভীবাজার শহরের সাইফুর রহমান রোডের পিংকি শু স্টোরে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে। ওই সময় দোকানের উপরের বাসায় সবাই আটকা পড়ে।
আটকা পড়াদের মধ্যে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
নিহতরা হলেন পিংকি শু স্টোরের মালিক সুভাষ রায় (৬৫), তার মেয়ে প্রিয়া রায় (১৯), সুভাষের ভাইয়ের স্ত্রী দিপ্তী রায় (৪৮), সুভাষের শ্যালকের স্ত্রী দীপা রায় (৩৫) ও দীপার মেয়ে বৈশাখী রায় (৩)।