ভোলার ঘটনায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের বক্তব্য
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সনাতন ধর্মের এক যুবকের বিচারের দাবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিভ্রান্তি এড়াতে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।
হতাহতের ঘটনায় সমবেদনা জ্ঞাপন করে রোববার (২০ অক্টোবর) রাতে দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামে নিজ ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার প্রেক্ষিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য (২৫) নামে এক যুবক রাত ৮টা ৫ মিনিটে ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন থানায় জিডি করেন। জিডি করার সময় থানায় অবস্থানকালেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য’র নম্বরে একটি কল আসে এবং তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ওসিকে জানান।
ওসি বিষয়টি ভোলা জেলার পুলিশ সুপারকে জানায়। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেদিন রাতের মধ্যেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য’র ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাককারী ও তার মোবাইলে ফোন দেয়া শরীফ এবং ইমন নামে দুই যুবককে যথাক্রমে পটুয়াখালী এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলা থেকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে বোরহান উদ্দিন থানায় আনা হয়।
ইতোমধ্যে শুভ’র ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে কথিত কমেন্টের জেরে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমান উত্তেজিত হতে থাকেন। ফেসবুকে ধর্মীয় মন্তব্যের অভিযোগে মন্তব্যকারীর ফাঁসি দাবি করেন স্থানীয় আলেম সমাজ। রোববার বেলা ১১টায় ঈদগাহ মাঠ ময়দানে তারা প্রতিবাদ সভার ঘোষণা দেন। জেলা প্রশাসক, ইউএনও, থানার অফিসার ইনচার্জ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আলেম সমাজের প্রতিনিধিগণের উপস্থিতিতে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে শনিবার সন্ধ্যায় বোরহান উদ্দিন থানায় দীর্ঘ সময় বিষয়টি আলোচনা হয়। আলেম সমাজের অভিযোগের ভিত্তিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যকে আটক দেখানো হয়। এ বিষয়ে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা পেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী আলেম সমাজ তাদের পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচি বাতিল ঘোষণা করেন।
সমাবেশ বাতিলের ঘোষণা সত্ত্বেও পুলিশ সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকে। এ অবস্থায় রোববার থেকেই কিছু লোক ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হতে থাকেন। ময়দানের বিভিন্ন পয়েন্টে বসানোর জন্য ১৭টি মাইক আনে একটি মহল। যেকোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সমবেত লোকজনকে সরিয়ে নিতে বললে উপস্থিত আলেমগণ নিশ্চিত করেন, লোকজন কোনো রকম বিশৃঙ্খলা করবে না। ইতোমধ্যেই এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় এবং যেকোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে স্থানীয় পুলিশকে সহায়তা দিতে সকালেই বরিশাল থেকে রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ভোলায় আসেন।
অতিরিক্ত ডিআইজি ও ইউএনও’কে নিয়ে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে প্রয়োজনীয় সকল আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে তাদেরকে বার বার আশ্বস্ত করেন। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সমবেত লোকজন ঈদগাহ্ ময়দান ত্যাগ করেন। উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য শেষে পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত ডিআইজিসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ মাদ্রাসার একটি কক্ষে অবস্থান নেন।
এরইমধ্যে অন্য একটি গ্রুপ ঈদগাহ ময়দানে প্রবেশ করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উত্তেজিত করতে থাকেন। তারপর সহসাই একদল লোক বিনা উস্কানিতে মাদ্রাসার অফিস কক্ষে অবস্থানরত কর্মকর্তাদের উপর আক্রমণ করেন।আক্রমণকারীদের একদল আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণকারীদের গুলিতে পুলিশের একজন মারাত্মক জখম হয়। মারাত্মক আহত হন পুলিশের আরেক সদস্য। বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিও আহত হন।
এই পরিস্থিতিতে ইউএনও ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এর নির্দেশে আত্মরক্ষার্থে ও সরকাররি জানমাল রক্ষার্থে ও উত্তেজিত লোকজনকে নিবৃত্ত করতে প্রথমে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে ও পরে শটগান চালায় পুলিশ। পরবর্তীতে পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
আক্রমণকারীদের গুলিতে মারাত্মক আহত পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ঘটনায় নিহত চার জনের মধ্যে অন্তত দুই জনের মাথা ভোতা অস্ত্র দ্বারা থ্যাতলানো বলে নিশ্চিত করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে ডিআইজি বরিশাল রেঞ্জকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, এসবি, পিবিআই এবং জেলা পুলিশ হতে একজন করে মোট চারজন কর্মকর্তা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।’’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অতএব সার্বিক ঘটনা পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, পুলিশ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে শুরু থেকে তৎপর থাকা সত্ত্বেও এবং আলেম সমাজ পুলিশ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখে কর্মসূচি স্থগিত করলেও, কোনো একটি স্বার্থান্বেসী মহল ধর্মকে পুঁজি করে একটি সামাজিক অস্থিরতা তৈরির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনাস্থলসহ সারাদেশে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।
‘‘গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট না করতে এবং কোনো অবস্থাতেই ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণ না করতে সাধারণ জনগনকে অনুরোধ জানাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। পাশাপাশি, গুজবে কান না দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য সকলের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ।’’
রোববার সকালে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে সনাতন সম্প্রদায়ের ওই যুবকের বিচারের দাবিতে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে সমাবেশ করা হয়। সেই সমাবেশ শেষে পুলিশের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন চারজন। এছাড়াও ১০ পুলিশ সদস্যসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
পুলিশের দাবি, সেই সংঘর্ষের একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি চালায় পুলিশ। কিন্তু মারমুখি জনতা পুলিশের উপর হামলা চালায়। এ সময় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
‘তৌহিদী জনতা’র নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন, পুলিশের গুলিতে তাদের চারজন কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি সেখানে চার প্লাটুন বিজিবি ও ১ প্লাটুন কোস্ট গার্ডমোতায়েন করা হয়েছে।