ভ্যাকসিন সংরক্ষণ: বাংলাদেশের বড় প্রতিবন্ধকতা ‘কোল্ড চেইন’
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যখন স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি ঠিক রাখতে লড়াই করে যাচ্ছে, তখন এ লড়াইয়ে বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হয়ে উঠেছে একটি কার্যকর টিকা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি করা বেশ কয়েকটি টিকা এই মুহুর্তে ট্রায়ালের শেষ ধাপে আছে। নভেম্বর জুড়ে নিয়মিত এসব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আশার কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে যদি এসব ভ্যাকসিন আসেও, দেশীয় বাস্তবতায় কার্যকর হিমাগার ব্যবস্থা এবং দক্ষ লোকবলের অভাব এই টিকাদানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর টিকাদানের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাই টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারকে টেকসই সমাধান, স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিক ব্যবস্থার প্রণয়ন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক ওয়েবিনারে এমন মতই দিয়েছেন বক্তারা। 'অ্যান্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য কোল্ড চেইন চ্যালেঞ্জ ফর অ্যা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন' শিরোনামে যৌথভাবে এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশন ও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, হেরিয়ট-ওয়াট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিট এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দেখানোর চেষ্টা করেন, কীভাবে কম খরচে এবং টেকসই মেয়াদে বাংলাদেশের এই প্রতিন্ধকতাগুলোর মোকাবিলা করা যায়।
ওয়েবিনারে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের কোল্ড ইকোনমির অধ্যাপক টবি পিটারস বলেন, "কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কোল্ড চেইন প্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ টেকসই করতে নীতিনির্ধারকদের সহায়তা করতে একটি ফার্স্ট ট্র্যাক প্রোগ্রামের ডিজাইনে আমরা নেতৃত্ব দিচ্ছি।"
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন হলো সর্বোচ্চ পন্থা। সেকারণে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার, বিভিন্ন সংস্থা এবং বেসরকারি খাত থেকেও ভ্যাকসিনের ডেভেলপমেন্ট এবং গবেষণার জন্য প্রচুর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
অধ্যাপক টবির মতে, হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে মোট জনসংখ্যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে সারাবিশ্বের ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন মানুষকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া লাগবে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রে যদি দুই ডোজ করেও লাগে তাহলে মোট ১১ থেকে ১২ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে হবে।
যেহেতু ভ্যাকসিন অত্যন্ত তাপমাত্রা সংবেদী তাই সফল ইমিউনাইজেশনের বিষয়টি শক্তিশালী কোল্ড চেইন ব্যবস্থার উপর নির্ভর করবে বলে তিনি জানান।
পুরো এই প্রক্রিয়াটিকে 'এখন পর্যন্ত মোকাবিলা করা সবচেয়ে বড় লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ' হিসবে উল্লেখ করেন তিনি।
বিশ্বের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে সমন্বিত কোল্ড চেইন ব্যবস্থার অভাবের কারণে ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিনের সার্বজনীন প্রবেশাধিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
ওই ওয়েবিনারে বলা হয়, বিশ্বের সবগুলো দেশে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের বণ্টন হলে মৃত্যুর হার ৬১ শতাংশ কমানো সম্ভব। তবে অনেক সংস্থারই উদ্বেগ রয়েছে, প্রথমে ধনী দেশগুলোতেই ভ্যাকসিনেশন শুরু হবে। সেক্ষেত্রে মাত্র ৩৩ শতাংশ মৃত্যু কমানো সম্ভব হবে।
প্রতিবন্ধকতা কী কী?
অধ্যাপক টবি পিটার এর মতে, প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত ধারণক্ষমতা, অপর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং এনার্জি অ্যাকসেসের ক্ষেত্রে সংকট।
তিনি মনে করেন, কোল্ড চেইনগুলো এনার্জি ইনটেনসিভ এবং এগুলোর মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়তে পারে। সুতরাং পরিবেশের ক্ষতি করে দ্রুত ভিত্তিতে এই চেইনের সম্প্রসারণ করাও উচিত হবে না। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার এই সুযোগেই এজন্য টেকসই একটি সমাধান বের করে নিতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতির উদাহরণ তুলে ধরে ইউনিসেফের কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমো হোজুমি বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবছর ৩৯ লাখ শিশুকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনে যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৪ শতাংশ।
গ্যাভির নেতৃত্বাধীন ভ্যাকসিন জোট কোভ্যাক্স, কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি অনুযায়ী, ভ্যাকসিন আসার শুরুতেই ২৯ শতাংশ মানুষকে এর আওতায় আনতে হবে। এরমধ্যে ফ্রন্টলাইনার এবং সমাজকর্মী থাকবেন ৩ শতাংশ এবং ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির ১৭ শতাংশ মানুষ থাকবেন।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি টিকা আরও ৯ শতাংশ লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
শিশুদের জন্য চলমান ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচিকে অক্ষুণ্ণ রেখেই নতুন এই কর্মসূচি চালিয়ে নিতে হবে। সেকারণে করোনার ইমিউনাইজেশন সিস্টেমকে নজিরবিহীন মাত্রায় নিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে, বলছিলেন টোমো হোজুমি।
এই ইমিউনাইজেশনের অন্যতম মৌলিক অংশ হলো কোল্ড চেইন প্রক্রিয়া।
হোজুমি বলেন, কোল্ড চেইন সিস্টেমের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে, কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক অতিরিক্ত কোল্ড চেইন সুবিধা এবং সরঞ্জামাদি সরবরাহ, প্রচুর পরিমাণে কোল্ড চেইন সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করা, ভ্যাকসিন পরিবহন, সেগুলি সংরক্ষণ ও পরিচালনা, অতিরিক্ত লোকবলের প্রশিক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণ।
বাংলাদেশে কোল্ড চেইন প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার জন্য ইউনিসেফ, গ্যাভি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারের সঙ্গে কাজ করছে বলে জানান তিনি।
প্রাথমিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ইউনিসেফের এই কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, যদি ৫ শতাংশ মানুষকেও ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হয় এবং যদি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়, যা মাইনাস ২ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা সংরক্ষণ করতে হয় তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান যে অবকাঠামো সক্ষমতা, তা দ্বিগুণ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানার তৈরি কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনটি মাইনাস ১৫ থেকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। এই ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও তা খুবই সামান্য। এই সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে বড় করতে সরকারকে যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। তবে ফাইজার এবং বায়োএনটয়েকের তৈরি ভ্যাকসিন যা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, তা বাংলাদেশের নাগালের বাইরে থাকবে বলেই ওয়েবিনারে মত দেন এই বিশেষজ্ঞ।