মুজিববর্ষের সফল উদ্যোগ দুই জেলার ‘মৎস্য গ্রাম’
মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরের একটি উদ্যোগের মাধ্যমে নেত্রকোনা ও শরীয়তপুর জেলার দুটি গ্রামকে 'মৎস গ্রাম' হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের দু'টি গ্রামকে 'মৎস্য গ্রাম' বা 'ফিশার ভিলেজ' হিসেবে গড়ে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করে মৎস অধিদপ্তর। এর মধ্যে একটি গ্রাম হচ্ছে নেত্রকোনা সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া। আর অন্যটি হলো শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার ইউনিয়নের হালইসার গ্রাম। সরেজমিনে ঘুরে এসে এ দুটি মৎস গ্রাম নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নেত্রকোনা ও শরীয়তপুর প্রতিনিধি।
কৃষিনির্ভর দক্ষিণ বিশিউড়া এখন 'মৎস্য গ্রাম'
নেত্রকোনা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি প্রত্যন্ত গ্রাম দক্ষিণ বিশিউড়া। এক বছর আগেও এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ একমাত্র কৃষির আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। অনেকের বাড়িতে পুকুর থাকলেও তারা সেখানে সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতেন। কিন্তু মুজিববর্ষ উপলক্ষে মৎস্য অধিদপ্তরের একটি উদ্যোগ পুরো গ্রামটিকে আমূল বদলে দিয়েছে। ছোট্ট গ্রামটির ২০২টি পুকুরে একযোগে হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাছ চাষ। তাই ইতিমধ্যে গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে 'মৎস্য গ্রাম' হিসেবে। লাভের মুখ দেখায় কৃষির পাশাপাশি মাছ চাষকেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। গত এক বছরে গ্রামটিতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকার মাছ। স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রাম থেকে এখন মাছ সরবরাহ হচ্ছে আশপাশের অন্যান্য জেলায়ও।
জানা গেছে, নেত্রকোনা সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া নামে ছোট্ট এই গ্রামটিতে ১৩৬ জন ব্যক্তির ২৫ দশমিক ৬ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট ২০২টি পুকুর রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ৭ দশমিক ৭৩ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট আইলী বিল ও ওয়াইল বিল নামে দু'টি বড় বিল। এর পাশাপাশি রয়েছে ১ দশমিক ৯৩ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট বেজখালি খাল নামে একটি খাল। 'মৎস্য গ্রাাম' কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে উল্লিখিত প্রত্যেকটি জলাশয়কে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের আওতায় নেয়া হয়। গঠন করা হয় মৎস্যচাষীদের ২০টি দল। একজন করে দলনেতা (ফলাফল প্রদর্শক) দলগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেবাশীষ ঘোষ জানান, 'মৎস্য গ্রাম' কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে ওই গ্রামের ১২০ জন পুরুষ ও ৬০ জন নারীকে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ চাষ, শিং মাছ চাষ, মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ, পাঙ্গাস ও কার্প মাছ চাষ, কার্প মিশ্র (রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি) চাষ এবং গুড একুয়া কালচার এন্ড সেফটিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৩০ হাজার মাছের পোনা (শিং, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, কার্প ও কার্প মিশ্র) দিয়ে ২১টি পুকুরে স্থাপন করা হয়েছে প্রদর্শনী খামার- যেখানে হাতেকলমে মাছচাষ পদ্ধতি শিখছেন চাষীরা। এর বাইরে ওই গ্রামের আইলী বিলটিকে গড়ে তোলা হয়েছে 'মৎস্য অভয়াশ্রম' হিসেবে। দেবাশীষ ঘোষ আরও জানান, এ গ্রামে প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী, উপকরণ, খাল খনন ও পোনা অবমুক্তকরণসহ বিভিন্ন খাতে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এর পাশাপাশি চাষীরা নিজেরাও অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
জানা গেছে, ২০ জন ফলাফল প্রদর্শক (টিম লিডার) চাষীর মৎস্যচাষ বাবদ গত এক বছরে ব্যয় হয়েছে ২৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। তারা ইতিমধ্যে বিক্রি করেছে ৪২ লাখ ৮২ হাজার ৩শ ৭০ টাকা। অর্থাৎ এ ২০ জন এক বছরে লাভ পেয়েছেন ১৬ লাখ ৩ হাজার ৩শ ৭০ টাকা। এর বাইরে বাকি ১শ ১৬ জন চাষী আরও প্রায় তিন কোটি টাকার ওপরে মাছ বিক্রি করেছে। এর মধ্যে তারা লাভ পেয়েছেন কোটি টাকার বেশি। ওই গ্রামের মাছ চাষী হায়দার আলী টিপু জানান, তিনি তিনটি পুকুরে মাছ চাষ বাবদ গত এক বছরে ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টাকা বিক্রি করতে পেরেছেন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা লাভ পেয়েছেন তিনি। সাব্বির আহমেদ বাবু নামে অপর এক চাষী জানান, তিনি ১৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। লাভ পেয়েছেন প্রায় ৯ লাখ টাকা। তবে আসাদুজ্জামান নামে চাষী বলেন, 'করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এ বছর মাছের বাজার দর কিছুটা মন্দা। তাই আশানুরূপ লাভ হয়নি এ বছর। কিন্তু বাজার চাঙ্গা হলে এ মাছ চাষ বাবদ এ গ্রাম থেকে বছরে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
এদিকে গ্রামটিতে মাছ চাষীদের সুবিধার্তে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি করেছেন মাছ চাষীরা। মাছ চাষী রফিকুল ইসলাম ও তাজরিন জাহান মুর্শিদা বলেন, 'আমাদের গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এলাকায় মাছের কোন আড়ত নেই। দূরের আড়তে গিয়ে মাছ বিক্রি করতে হয়। তাছাড়া পুকুরে অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য এরেটর মেশিন এবং খাবার প্রয়োগের জন্য অটোমেটিক ফিডারের সঙ্কট রয়েছে। সরকারিভাবে এই সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে পারলে খুব ভালো হয়।'
জানা গেছে, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী (বর্তমান সরকারের সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী) মোঃ আশরাফ আলী খান খসরু এমপি, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, উপ-পরিচালক, বিভিন্ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, জেলা প্রশাসক এবং মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রাম পরিদর্শনসহ মাছ চাষীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। তারা মাছ চাষীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রতি দিয়েছেন।
শরীয়তপুরে হচ্ছে 'মৎস গ্রাম'
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার ইউনিয়নের হালইসার গ্রাম হবে "মৎস গ্রাম"। মুজিব শতবর্ষ উযাদপন উপলক্ষে মৎস বিভাগ এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে । সকল দপ্তরের সমন্বয়ে ২৭ টি কর্মসূচি এখন শেষ পর্যায়ে।
জেলা মৎস কর্মকর্তা প্রণব কুমার বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি কর্তৃক মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় এর আওতায় মৎস অধিদপ্তরের অনুমোদিত কর্মসূচির সকল পর্যায়ে বাস্তবায়িত কর্মসূচি হালইসার গ্রামে বাস্তবায়ন এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়ন হলে হালইসার হবে একটি আর্দশ মৎস গ্রাম। পদ্মা মেঘনা, কীর্তিনাশা ও জয়ন্তীকাসহ ছোট বড় অসংখ্য নদী দিয়ে ঘেরা শরীয়তপুর জেলা। এই জেলা জাতীয় মাছ ইলিশ উৎপাদনে অনেক এগিয়ে। মাছ উৎপাদন ও বিপণনে এ জেলা হতে পারে অনুকরণীয়। প্রতি বছরই শরীয়তপুরে প্রাকৃতিক ও মৎস চাষ করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নড়িয়ার হালইসার গ্রামকে বেছে নেয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে গ্রামটি একেবারে পদ্মা ঘেষা। হালইসার ইলিশ অধ্যুসিত এলাকা। এই গ্রামে মৎস জীবিদের বসবাস বেশি। এখানে একটি বড় মৎস আড়ৎ রয়েছে। মৎস ল্যান্ডিং পয়েন্ট থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ সহজেই চলে যাচ্ছে। তাই এখানে যে সম্পদগুলো আছে সেই সম্পদগুলো কাজে লাগতে পারলে মৎস সেক্টর আরও সম্প্রসারিত হবে, মৎস জীবিদের জীবন ও জীবিকা আরও এগিয়ে যাবে। এই উদ্দেশ্যেই হালইসার গ্রামকে বেছে নেয়া হয়েছে এবং সমন্বিত কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়িত হবে। আগামী ডিসেম্বর থেকে দেশের মৎস জীবিদের কাছে এ গ্রামটি হবে একটি আদর্শ মৎস গ্রাম।
নড়িয়া উপজেলা মৎস কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, জেলেদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য সরকার দুটি গ্রামকে মৎস গ্রাম ঘোষণা করেছে নেত্রকোনায় একটি আর শরীয়তপুরের নড়িয়ায় একটি। নেত্রকোনার গ্রামটিকে চাষ প্রধান আর হালইসারকে মৎস আহরণ প্রধান হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এই গ্রামটি জেলে সম্প্রদায় ঘেড়া ছোট্ট একটি গ্রাম। যেখানে ৩৭৬ জেলে পরিবারের বসবাস। এসব জেলে মাছ আহরণের সাথেই বেশি জড়িত। জেলেরা যাতে মৎস আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। মৎস বিভাগে যে সব নিষেধাজ্ঞা আছে তা মেনে চলে। ইলিশ মাছ, জাটকা আহরণ এবং অন্যান্য যে সব ক্যাটফিসের পোনা অহরণ থেকে বিরত থাকে এ জন্যই মূলত ওই গ্রামটাকে বেছে নেয়া। গ্রামটিতে ইতোমধ্যে অনেকগুলো প্রোগ্রাম শেষ করা হয়েছে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ এং বিভিন্ন প্রর্দশনী দেয়া হয়েছে। জেলেদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানে উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। সমন্বিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পর মৎসজীবিদের মাঝে সুফল বয়ে আসবে। এক্ষেত্রে সাফল্য পেলে তা সারাদেশে মডেল হিসেবে ছড়িয়ে দেয়া হবে। আশা করি এর ফলে মৎস সেক্টরে পজেটিভ পরিবর্তন আসবে।