লেবানন থেকে ফিরে বাবা-মাকে চমকে দিতে চেয়েছিল রনি
বাবা-মাকে না জানিয়েই হুট করে দেশে চলে আসবেন, অবাক করে দেওয়ার জন্য। শুধুমাত্র ছোট বোন জেসমিন আক্তার হ্যাপি জানবেন ভাইয়ের দেশে ফেরার খবর। বাবা-মাকে চমকে দেওয়ার জন্যই ভাই-বোন মিলে এ পরিকল্পনা। বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটাও শেষ, বাকি ছিলো শুধু বিমানের টিকিট বুকিংয়ের কাজটা। কিন্তু হঠাৎ মহামারির থাবায় পুরো পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেল।
করোনাভাইরাস প্রার্দুভাবের কারণে লকাডাউন শুরু হয়ে গেল, লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ মেহেদী হাসান রনিরও (২৫) দেশে ফেরা আটকে গেল। আজ বুধবার (৫ আগস্ট) সকালে খবর এল রনি আর কোনো দিনই ফিরবে না। গতকাল মঙ্গলবার (৪ আগস্ট) লেবাননের বৈরুতে বিস্ফোরণের ঘটনায় রনি প্রাণ হারিয়েছে।
একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন বাবা তাজুল ইসলাম। আর মা ইনরা বেগম ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
লেবাননে আয়-রোজগার কম হওয়ায়- অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা ইউনিয়নের ভাদেশ্বরা গ্রামের রনি। করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চ থেকে কাজ বন্ধ থাকায় বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছিলেন না তিনি। পরিবারে ঋণের চাপও বাড়ছিলো।
এনিয়ে কিছুটা হতাশাগ্রস্ত ছিলেন রনি। মাথায় ঋণের চাপ আর পরিবারের সুখের কথা ভেবে লেবানন থেকে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন। এজন্য পরিবারের কাছে অনুমতিও চেয়েছিলেন। কিন্তু নিয়তি তাকে নিয়ে গেল না ফেরার দেশে।
রনির পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন রনি। গ্রামের এক স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু দারিদ্রের কারণে পড়াশোনা বেশিদূর আর এগোয়নি। বাহরাইন প্রবাসী বাবা তাজুল ইসলাম সুবিধা করতে না পারায়, পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে রনিও বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
সুদে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ লেবাননে পাড়ি জমান রনি। এর মধ্যে আর একবারও দেশে আসা হয়নি তার। ইতোমধ্যেই রনির বাবা তাজুল ইসলামও বাহরাইন থেকে দেশে ফেরত আসেন। ফলে পরিবারের পুরো চাপ পড়ে রনির ওপর।
তবে পরিবারের জন্য হাসিমুখেই কাজ করে যাচ্ছিলেন রনি। লেবাবনের বৈরুতে একটি বিপণীবিতানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন তিনি। মাসে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে পারতেন বাড়িতে। কিন্তু এতো অল্প বেতনের টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করতে পারছিলেন না। এখনও দুই লাখ টাকার মতো ঋণ শোধ বাকি আছে।
একটু বেশি বেতনে কাজ করার জন্য অন্য কোনো দেশে কাজ খুঁজছিলেন রনি। কিন্তু ঋণের টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি থেকে অন্য দেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি পরিবার। মাঝখানে, অভিমান করে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে অন্য দেশে চলে যাওয়ার কথাও ছোট বোন জেসমিন আক্তার হ্যাপিকে বলেছিলেন।
এখন ছেলের মা-বাবা-বোনের চোখের জলে ভারি হয়ে আছে পুরো বাড়ির পরিবেশ। ছবি হাতে নিয়ে নির্বাক হয়ে বসে আছেন বাবা তাজুল ইসলাম। মা ইনারা বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন বাড়ির উঠানে। প্রতিবেশিরা সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
রনির বাবা তাজুল ইসলাম জানান, গতকাল দুপুরে সর্বশেষ ছেলে রনির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়েছে তার। বাবার সঙ্গে কথা বলে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন রনি। এরপর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি তার সঙ্গে।
গতরাতে রনির এক সহকর্মী ফোন করে জানান তিনি অসুস্থ, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর আজ (বুধবার, ৫ আগস্ট) ভোরে আবার ফোন করে ওই সহকর্মী জানান রনি মারা গেছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা বাবা এখন আশা করছেন সরকার তার ছেলের মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা নেবে।
শোকার্ত ছোট বোন জেসমিন আক্তার বলেন, ''বিস্ফোরণের পর শুনেছি আমার ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নামাজ পড়ে দোয়া করেছি আর আল্লাহ্'র কাছে ভিক্ষা চেয়েছি। বলেছি আল্লাহ্ তুমি আমার ভাইয়ের পা নাও, হাত নাও কিন্তু প্রাণ নিও না। আজকে ভোরে শুনি আমার ভাই নাই।''
''প্রতিদিন কাজে যাওয়ার আগে ভিডিও কল দিয়ে আমার দুই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতো, ভাই আমার। দেশে আসবে বলে দুই ভাগ্নির জন্য চকলেট ও খেলনা কিনে রেখেছিল। বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করেছে। কিন্তু লকডাউনের কারণে দেশে ফিরতে পারছিল না। গত পহেলা বৈশাখে ভাইয়ের জন্মদিনে মা নিজ হাতে কেক বানিয়েছিল। ভিডিও কলে আমরা সেই কেক কেটেছিলাম। এখন সব শেষ। ভাইয়ের ভাইয়ের মরদেহটা চাই আমরা...'' আহাজারির মেশানো কণ্ঠে বলেন জেসমিন।
মাছিহাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল আমিনুল হক পাভেল বলেন, ''ঘটনার পর থেকেই আমি রনির পরিবারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। মরদেহ দেশে আনার জন্য কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। সেজন্য আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করছি। মরদেহ আনার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।''