টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ: মূল পরিকল্পনাকারীসহ গ্রেপ্তার ১০
টাঙ্গাইলের মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী রতন হোসেনসহ ডাকাত চক্রের ১০ জন সদস্যকে ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১২ ও র্যাব-১৪ এর আভিযানিক দল গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার কর।
গ্রেপ্তারকৃতরা হল- মূল পরিকল্পনাকারী মোঃ রতন হোসেন (২১), মোঃ আলাউদ্দিন (২৪), মোঃ সোহাগ মন্ডল (২০), খন্দকার মোঃ হাসমত আলী দীপু (২৩), মোঃ বাবু হোসেন জুলহাস (২১), মোঃ জীবন (২১), মোঃ আব্দুল মান্নান (২২), মোঃ নাঈম সরকার (১৯), রাসেল তালুকদার (৩২), মোঃ আসলাম তালুকদার রায়হান (১৮)।
তাদের থেকে উদ্ধার করা হয় ২০টি মোবাইল, ০২টি রূপার চুড়ি, ১৪টি সিমকার্ড ও ডাকাতিতে ব্যবহৃত ০১টি দেশিয় অস্ত্র (ক্ষুর)।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত রতন মিয়া বাস ডাকাতির ৩ দিন আগে তার সহযোগী ডাকাত রাজা মিয়াকে বাস ডাকাতির প্রস্তাব দিলে রাজা মিয়া দলের অন্যান্য ডাকাতদের সংঘটিত করার কথা বলে।
পরবর্তীতে গ্রেপ্তারকৃত রতন, মান্নান, জীবন, দীপু, আউয়াল ও নুরনবীকে ডাকাতির পরিকল্পনার কথা জানায় এবং ডাকাত মান্নান তার সহযোগী সোহাগ, আসলাম, রাসেল, নাঈম ও আলাউদ্দিনকে নিয়ে ডাকাতিতে যোগ দেয়।
ডাকাতিতে রতনের নেতৃত্বে মোট ১৩ জন ডাকাত অংশ নেয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রতনের নেতৃত্বে গত ২ আগস্ট দুপুরবেলা গাজীপুরের জিরানী বাজার এলকায় সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বাসে ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। মূল পরিকল্পনাকারী রতন উক্ত ডাকাতি কাজে যাবতীয় প্রস্তুতির আর্থিক খরচাদি বহন করে।
চক্রের সদস্যদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে প্রত্যেকের কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রতন ডাকাত ২ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড়ের একটি দোকান থেকে ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত ৪টি চাকু, ২টি ধারালো কাঁচি ও ০১টি ক্ষুর সংগ্রহ করে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাকাতির রাতে ডাকাত রাজাসহ চক্রের অন্যান্য সদস্যরা সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে থাকে। রাত আনুমানিক ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় পৌছালে ডাকাত রাজা বাসটিকে থামার সংকেত দেয় এবং যাত্রীবেশে প্রথমে রতন, রাজা, মান্নান ও নুরনবী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহন বাসটিতে ওঠে।
পরবর্তীতে আরো দুই দফায় ডাকাতচক্রের অন্য সদস্যরা বাসটিতে যাত্রীবেশে আরোহন করে। বাসটিতে ২৪ জন সাধারণ যাত্রী থাকায় ডাকাত চক্রের অধিকাংশ সদস্য বাসের পিছনের দিকে বসে। বাসটি বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু এলাকা অতিক্রম করছে গ্রেপ্তারকৃত রতন ডাকাত দলের সদস্যদেরকে চাকু ও ধারালো কাঁচি দেয় ।
আউয়াল ডাকাত ধূমপানের কথা বলে বাসের গেটের কাছে যায় এবং অন্যান্যদের ইশারা দিলে রাজা, রতন, মান্নান ও নূরনবী ড্রাইভিং সীটের কাছে গিয়ে ড্রাইভারকে মারধর করে এবং ডাকাত রতন বাসের ড্রাইভিং সিটে বসে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা বাসের চালক ও সুপারভাইজার, হেলপারসহ অন্যান্য সাধারণ যাত্রীদেরকে হাত মুখ বেঁধে সিট কভার দিয়ে মুখে মুখোশ পড়িয়ে মুখমন্ডল ঢেকে দেয় এবং যাত্রীদের সাথে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে এবং ধর্ষণ করে।
পরবর্তীতে টাঙ্গাইলের হাটুভাঙ্গা মোড় হয়ে মধুপুরে যাওয়ার পথে মধুপুরের রক্তিপড়া এলাকায় গ্রেপ্তারকৃত রতন গাড়ি চালনার সময় লুটকৃত মালামাল নিয়ে ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে বাক-বিতন্ডার কারণে রতন পিছনে তাকালে বাসটি রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক খুটি ও বালুর সাথে বাসের সংঘর্ষ হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একপাশে হেলে পড়ে।
তৎক্ষনাৎ ডাকাতদলের সবাই লুটকৃত মালামালসহ বাস থেকে নেমে পালিয়ে যায়।
পরবর্তীতে বাসে করে ডাকাত চক্রের সদস্যরা টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় যায় এবং অটোরিক্সাযোগে মধুপুরের কুড়ালিয়া এলাকায় রতনের নিকটাত্মীয়ের ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে লুন্ঠিত মালামাল নিজেদের মধ্যে বন্টন করে। এরপর ডাকাত রতন গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় আত্মগোপন করে।
গ্রেফতারকৃত মান্নান, আলাউদ্দিন ও বাবু পৃথকভাবে আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকায় আত্মগোপন করে। ডাকাত আসলাম, নাঈম, রাসেল প্রথমে নিজের এলাকায় ও পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ এলাকায় আত্মগোপন করে। ডাকাত জীবন কোনাবাড়ীতে আত্মগোপন করে।
ডাকাত দীপু প্রথমে টাঙ্গাইলের পিরোজপুর গ্রামে ও পরবর্তীতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় আত্মগোপন করে। ডাকাত সোহাগ প্রথমে জিরানী বাজার ও পরবর্তীতে জামালপুর জেলায় এবং পুনরায় জিরানী বাজারে আত্মগোপন করে।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত রতন হোসেন উক্ত ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী।সে পেশায় গাড়ীর হেলপার, তার বিরুদ্ধে পূর্বেও ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত রতন ২০১৮ সালে গ্রেপ্তারকৃত নূরনবী, জীবন ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে রাস্তা ব্লক করে সাভার পরিবহনের একটি বাস ডাকাতি করে। ঐ বাস ডাকাতির ঘটনায় রতন গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে ২০২০ সালে পুনরায় গ্রেফতারকৃত নূরনবী, জীবন ও আউয়ালকে নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি অটোরিক্সা ছিনতাই করে।
তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা জীবনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে। উক্ত ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে রতন প্রায় ১ বছর কারাভোগ করে। কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে সে তার সিন্ডিকেট নিয়ে সাভার, গাজীপুর বা সিরাজগঞ্জ এলাকায় মহাসড়কে আরো বেশ কয়েকটি ডাকাতি করে।
গ্রেপ্তারকৃত জীবন পেশায় গাড়ির হেলপার। এই পেশার আড়ালে সে বেশ কয়েকটি পরিবহন ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে। বর্ণিত ডাকাতিতে সে যাত্রীদের মালামাল লুটের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। ইতোপূর্বে সে ২০১৮ ও ২০২০ সালে দুটি ডাকাতির মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে।
গ্রেপ্তারকৃত মান্নান গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস এ চাকরী করত। সে ২০১৯ সালে আশুলিয়া থানায় একটি চুরির মামলায় কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। তার নেতৃত্বে ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন গার্মেন্টসে চাকুরীরত গ্রেফতারকৃত আলাউদ্দিন, সোহাগ, বাবু, দীপু, রাসেল, রায়হান, নাঈম উক্ত ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে।
গত ২ আগস্ট দিবাগত রাত আনুমানিক ১টায় কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস টাঙ্গাইল অতিক্রম করার সময় ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় এক যাত্রী বাদি হয়ে মধুপুর থানায় অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করে।