গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা...‘আমাদের অপেক্ষা কি শেষ হবে না?’
গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে মানববন্ধনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস পালন করেছে মানবাধিকার সংস্থা মায়ের ডাক।
আজ মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) সকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে প্রায় ৪০টি পরিবার এতে অংশ নেন, তারা প্রত্যেকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়। কারো বাবা, কারো ভাইকে ফিরে পাওয়ার আকুতি প্রকাশ করছিলেন।
মায়ের সাথে এসেছিল শিশু ইনাম। প্রায় ৫ বছর বয়সী এই শিশুর গুম বা নিখোঁজ বিষয়টি নিয়ের অতোটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি তার। বাবাকে পাওয়ার এমন তীব্রতা ইনামের মলিন চাহনিতে খুব সহজেই বুঝতে পারেন মা নাসরিন জাহান স্মৃতি।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমার ছেলে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্যদের বাবা তাদের সন্তানদের আদর করছেন কিংবা একসাথে সময় কাটাচ্ছেন। এসব দেখে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। আমার এই ছোট ছেলে বড় হচ্ছে, এখন সে অন্যদের বাবাদের দেখলে আমার কাছে জানতে চায় 'আমাদের বাবা কই'। সে সময়ের কষ্টের কথা আমি কাউকে বলতে পারি না।"
তার স্বামী মিরপুরের কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন নিখোঁজ হন ২০১৯ সালের জুন মাসে। এরপর দীর্ঘ সময়ে ধরে আইনপ্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার দপ্তরে ঘুরে কোন সহযোগীতা পাচ্ছেন না তারা।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নাসরিন জাহান বলেন, "আমার এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে আমি যেন অথৈই সাগরে পড়েছি। এখন একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা আর কয়েকটি টিউশনি করে কোন রকমে বেঁচে আছি। কবে তাকে ফিরে পাবো? আমাদের এই অপেক্ষা কি শেষ হবে না?"
মঙ্গলবার গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবসের এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলো তাদের বড় মেয়ে আনিশা ইসলাম।
দশম শ্রেণী পড়ুয়া আনিশা তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "আপনি তো আপনার বাবাকে হারিয়েছেন তাহলে আমাদের বাবাকে হারানোর বিচার করছেন না কেন। আপনি আপনার বাবার জন্য দোয়া করতে পারেন আমি আমার বাবার জন্য দোয়া করতে পারি না। আমার বাবা বেঁচে আছে না মরে গেছে তা জানি না। আমি মোনাজাতে কী দোয়া করবো ভাবতে পারি না, কান্না করি।"
কুষ্টিয়ার সেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাজ্জাদ হোসেন সবুজের ছেলে সাহেদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "২০১৫ সালের আগস্ট বাবাকে গাজীপুর থেকে নিয়ে যায় র্যাব। তার সাথে আরও দুজন নেতা ছিলো যাদেরকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্ত আমার বাবাকে এখনো ছাড়েনি। আমরা এখন কারো সাপোর্ট পাচ্ছি না। পরিবারের সবাই অনিরাপদ জীবন পার করছি।"
মায়ের ডাকের এই আয়োজনে সংহতি প্রকাশ করে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল। তিনি বলেন, "আমরা বারবারই একটা প্রশ্ন নিয়েই হাজির হচ্ছি, আমাদের পরিবারের সদস্যরা কোথায় আছে? এর উত্তর সরকারকে দিতেই হবে। গুম, খুনের সঙ্গে সরকারি মহলই জড়িত। তবে বেশি দূর নয়। আমরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাব। আগামী দিনে আমরা এসব গুম, খুনের বিচার করব।"
এদিকে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই ও গুমের অভিযোগ তদন্তে সরকারকে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে গুমের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠে এসেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তুলে নেওয়ার কিছুদিন পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ বেরিয়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত তথ্যের বরাত দিয়ে আসক জানায়, ২০১৯-২০২২ এর মধ্যে ২৮ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫ জন ফেরত এসেছেন। বাকিরা এখনো নিখোঁজ আছেন।
এ প্রেক্ষাপটে ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান বিরোধী দিবসে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বাংলাদেশ সরকার ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে কয়েকটি দাবি জানিয়েছে। এতে গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিদের শিগগির খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করেছে সংগঠনটি।