দুযোর্গ ঠেকাতে তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামের ঝুঁকিপুর্ণ পাহাড় ও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার নকশা
পাহাড় ধসসহ দুযোর্গ থেকে মানুষকে রক্ষা ও পাহাড়গুলোকে সংরক্ষণের জন্য চট্টগ্রামের ঝুঁকিপুর্ণ পাহাড় ও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার নকশা তৈরি করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
২০০৭ সালের এক দিনে চট্টগ্রামের সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। গত ১৫ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে প্রায় চার শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
মূলত নরম পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত পাহাড়ে অপরিকল্পিত আবাসনের কারণে এসব ঘটনা ঘটে থাকে।
এ দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষায় চলতি মাস থেকে জরিপ কাজ শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগ।
জরিপ দলের নেতৃত্বে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্স ডিপার্টমেন্টের ড. মো. জিল্লুর রহমান।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে নকশাটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছেন গবেষক দল।
১২ সদস্যের জরিপকারী দল ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় সার্ভে পরিচালানা করেছেন। সংগ্রহ করেছেন পাহাড়ের মাটি, পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের ডাটা।
অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে চট্টগ্রামের পাহাড় ও ভূমির গঠন আলাদা। এখানকার পাহাড়গুলো নরম রক সয়েল ও পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। এ কারণে এখানে বৃষ্টি হলেই ভূমি ধসের ঘটনা ঘটে।"
"এখন আমরা চট্টগ্রামের ল্যান্ডস্কেপের একটি নকশা প্রণয়নের জন্য কাজ করছি, যার মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীসহ আশপাশের পাহাড়গুলোর মাটির অবস্থা সম্পর্কে পুর্নাঙ্গ চিত্র ফুটে উঠবে,"
"এ জন্য আমরা সরেজমিন সার্ভের পাশাপাশি, ডাটা কালেকশন ও ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহ করছি। এসব ম্যাটেরিয়ালের যেমন ফিল্ড টেষ্ট হয়েছে, তেমনি ল্যাবরেটরিতেও টেষ্ট করা হবে। এর মাধ্যমে শহরের পাহাড়গুলোর মধ্যে কোনগুলো বেশি ঝুঁকিপুর্ণ তা আমরা চিহ্নিত করবো। সেগুলোর ঝুঁকি কিভাবে কমানো যায় সেটা নিয়েও আমাদের গবেষণা করছি," যোগ করেন তিনি।
এছাড়া ভুমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোকেও এই নকশায় আইডেন্টিফাই করা হবে বলে জানান তিনি। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে ফলাফল আমরা পরামর্শ আকারে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান ড. জিল্লুর রহমান।
এখন পর্যন্ত গবেষক দলের পাওয়া তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকায় রয়েছে-বাটালি হিল, লালখান বাজারের মতিঝর্ণা, পশ্চিম খুলশী, ফৌজদাহাট-বায়েজীদ সংযোগ সড়ক ও এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটি এলাকা।
জরিপ কাজে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ফাহিম ফারুক জানান, সিলেট ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তারা গবেষণার কাজ করছেন। তবে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানকার পাহাড়গুলোর ধসে পড়ার ঝুঁকি বেশি।
তিনি বলেন, "কাঠামো অনুযায়ী কোন পাহাড়ের গঠন কেমন তা বের হয়ে আসবে এই জরিপের মাধ্যমে। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো কেমন আছে। সেগুলো কিভাবে মিটিগেট করা হবে। কোন ধরনের মাটিতে কেমন ভূমি ধস হবে সেটি আমরা আইডেন্টিভাই করেছি। এই জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরি হবে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর ধসের ঝুঁকি মানচিত্র।"
১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটারের মহা-পরিকল্পনা
বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের আয়তন ১৬৫ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু আগামীর বন্দরনগরীর জন্য ১ হাজার ১৫২ কিলোমিটার জুড়ে পরিকল্পিত নগর গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষ।
এ লক্ষ্যে চট্টগ্রাম নগরের মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) প্রণয়নের কাজ চলছে। এই কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়গুলোর ঝুঁকি নকশা তৈরির এ জরিপকাজ চলছে।
মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নকশা প্রণয়নের এই কাজটি শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরকে কেন্দ্র করে হচ্ছে না। বিশেষ করে উত্তরে হাটহাজারীর সরকার হাট, সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়া, পূর্বে রাঙ্গুনিয়া ও দক্ষিনে সাঙ্গু নদী পর্যন্ত এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচেনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে সীতাকুণ্ড-হাটহাজারীসহ অধিকাংশ এলাকা পাহাড়ি হওয়ায় পাহাড়গুলোর ঝুঁকি নকশা তৈরির এ কাজ প্রকল্পের গুরুত্বপুর্ণ অংশ।"
"চট্টগ্রামে যেহেতু প্রতি বছর পাহাড় ধসে মানুষ মারা যায় এবং জানমালের ক্ষতি হয়। তাই আমরা এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এবং আগাম পরিকল্পনা করতে সঠিক তথ্য জানতে জরিপ করছি। এর মাধ্যমে আমরা জেনে যাব কোন পাহাড়গুলোতে বসতি করা যাবে, কোনগুলোতে করা যাবে না। এ ছাড়া বসতি করলেও কীভাবে করা যাবে, তা নিয়ে গাইডলাইন পাওয়া যাবে। এ জন্যই এ কাজ করা হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
আবু ঈসা আরো বলেন, "এ নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে কোথায় রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং হবে, কোথায় কমার্শিয়াল বিল্ডিং হবে, কোন এলাকায় ইন্ডাস্ট্রি হবে তা নির্ধারণ করা হবে। এর মাধ্যমে কোন প্রকল্প কোথায় করলে লাভজনক হবে তাও নির্ধারণ করা হবে। কারণ নরম মাটিতে যদি কমার্শিয়াল বিল্ডিং করা হয় তাহলে খরচ বেশি হবে। তাই নরম মাটিতে খেলার মাঠ বা লো হাইটের ভবনগুলো নির্মাণ করে শক্ত মাটিতে বড় ভবন তৈরী করে ১০০ গুণ টাকা সেভ করা সম্ভব হবে।"
অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যেহেতু আমাদের ভুমির সমস্যা রয়েছে, তাই পাহাড়ে যদি স্থাপনা করতেই হয় তাহলে কোনো কোন পাহাড়ে তা করা যাবে, কী পরিমাণে করা যাবে তা নির্ধারণ করা হবে ম্যাপের মাধ্যমে।"
তিনি জানান, ঝুঁকিপুর্ণ পাহাড়গুলো যদি রি-লোকেট করা না যায় তাহলে ওই সব পাহাড় থেকে বসতি ও স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে।
"আর যেগুলা কস্ট ইফেক্টিভ হবে। সেখানে লোকজন না সরিয়ে কিভাবে পাহাড় রক্ষা করা যায় সে ব্যাবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে রিটার্নিং ওয়াল দিয়ে পাহাড়ের স্লোপগুলোকে রি-ডিজাইন করতে পারি," যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পূর্ববর্তী মাস্টারপ্ল্যানগুলোতে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মাঠ জরিপের মাধ্যমে অনেক কিছু করা হয়তো সম্ভব হয়নি।
"বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতায় আমরা জরিপের মাধ্যমে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারি। ঝুঁকিপুর্ণ পাহাড় ও ভূমিকম্প প্রবন এলাকার নকশার কারণে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যাবে ভবন অনুমোদনের ক্ষেত্রে। এই মানচিত্রে যদি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে দেওয়া হয়, তাহলে সেসব এলাকায় ভবন করার অনুমোদন পাবে না। আর অনুমোদন পেতে হলেও ঝুঁকি বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করা হবে," বলেন তিনি।